বিপুল প্রচার ও জমজমাট আয়োজন

সংগীত পরিবেশনে শিল্পীরা
সংগীত পরিবেশনে শিল্পীরা

সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল আইনের শারদ উৎসব বিপুল প্রচার পেয়েছে এবার। এখানে সারা আমিরাত থেকে এসেছেন মানুষ। ভারতীয়রা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করেছেন, আমরা আল আইনে যাচ্ছি কিনা!

এর আগে উৎসব আয়োজনের নেতারা এলেন আমাদের বাসভবনে। তখনই বুঝেছি, এদের গতি অপ্রতিরোধ্য। তিল পরিমাণ জায়গাও বাদ রাখবেন না গণনা থেকে। আবুধাবি, দুবাই, আজমান, শারজাহ ও রাস আল খাইমা—কোথাও নিমন্ত্রণ করতে বাদ রাখা হয়নি। আমরা ওই দিনই আমন্ত্রণ নিশ্চিত করলাম।

আমাদের আসার দিনক্ষণ আগে থেকেই ছিল নির্দিষ্ট। কন্যার স্কুল শেষে ঘর থেকে বেরোতে হবে, কাজেই দেরি অনিবার্য। আর একটি অনুষঙ্গও এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। আবুধাবির পূজা সম্পর্কিত দায়িত্বটুকুও সেরে আসতে হবে। নবমীর পূজা দেখলাম সকালে। লিখলাম প্রাণের প্রথম আলোর জন্য। ছবিসহ সে লেখা পাঠালাম ঢাকায়। তারপর রওনা।

অর্ঘ্য হাতে তরুণীরা
অর্ঘ্য হাতে তরুণীরা

ঊর্মি হাওলাদার সংগীতের মূল দল পরিচালনা করেছেন। পুরো পাঁচ দিনই হল ছিল জমজমাট। শুরুতেই বার্তা দেন, মর্ত্যলোকে আসছে এবার শারদীয় মা। এরপর হৃদয়গ্রাহী এক সংযোজন। মঙ্গল দীপ জ্বেলে অন্ধকারে দু’চোখ আলোয় ভরো প্রভু!—প্রার্থনা সংগীত।

দারুণ আবেদন আনে সংগীতের মূল পর্ব। গানে সবার কল্যাণ কামনা করা হয়। সমবেত কণ্ঠে সে ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে। সীমা সাহা উচ্চকিত হন। জেনি ঘোষ মনপ্রাণ সঁপে দেন। শুভ্রা শীল মানুষের উদ্দেশ্যে হৃদয়ের ভালোবাসা ধরে রাখতে পারেন না।

সবকিছু শৃঙ্খলার মধ্যে রাখার চেষ্টা। সময় সম্পর্কেও ছিল সচেতনতা। আমরা গাড়ি নিইনি। এ জন্য বাসস্ট্যান্ড থেকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন উৎসব কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী বিকো রায়। গুছিয়ে কথা বলেন। আগে আগেই জেনে নিলাম বাংলাদেশ থেকে রথিন মিত্র এসেছেন তার পাঁচ সদস্যের বাউল দল নিয়ে। মাতিয়ে রাখছেন অনুষ্ঠান আয়োজনকে। আধ্যাত্মিক গানে তার দখল এ ক্ষেত্রে দারুণ সহায়তা করেছে।

তরুণীরা সেলফি তুলতে ব্যস্ত
তরুণীরা সেলফি তুলতে ব্যস্ত

আবুধাবির অতিথিরা এলেন একই সন্ধ্যায়। দূতাবাসের রাজনীতি ও প্রশাসনবিষয়ক মিনিস্টার ইকবাল হোসেন খান বক্তব্য রেখেছেন। তিনি দুর্গা পূজার পৌরাণিক পটভূমি তুলে ধরেন। তার কথায় বিমুগ্ধ শ্রোতারা। বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ইফতেখার হোসেন বাবুল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় শুভেচ্ছা জানালেন। পেলেন পূজা কর্মীদের ভালোবাসা। বক্তব্য রাখেন জনতা ব্যাংকের নির্বাহী কর্মকর্তা আমিরুল হাসান। সুসংগঠিত আয়োজনে তারও ভালো লাগার প্রকাশ।

রাজধানী থেকে আসা এ বহরে আরও ছিলেন একই সংগঠনের দুই সহসভাপতি শওকত আকবর ও ইমরাদ হোসেন ইমু। এসেছিলেন সাধারণ সম্পাদক নাসির তালুকদার। সেখানে আরও বক্তব্য রাখেন আল আইন বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এমএ হান্নান হিরু।

নৃত্য কন্যা তিশা সেন নৃত্য করেন দেবদাস চলচ্চিত্রের গানে। রাধাকৃষ্ণের দুষ্টুমি আর মিষ্টি ভরা কথার সুর তালে চরাচর এগোয় নতুন পথে। এরপর নাচেন আধ্যাত্মিক সংগীতে। প্রকৃতি খুঁজে পায় নতুন দিগন্ত।

মণ্ডপে ধূপের ধোঁয়ার আরতিতে মনে হয়েছিল মেঘের মধ্যে দেবী দুর্গার পরিবার! ডান পাশে লক্ষ্মী ও গণেশ। যথাক্রমে ঐশ্বর্য, সম্পদ ও সিদ্ধিদাতা গণঐক্যের প্রতীক। বাম পাশে জ্ঞানের প্রতীক সরস্বতী ও শৌর্য-বীর্যের প্রতীক কার্তিক। পুরাণে বর্ণনা আছে, দুর্গা হিমালয় ও মেনকা দম্পতির কন্যা এবং শিবের পত্নী। সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় মহাশক্তি নিয়ে বিশ্বভুবনে আবির্ভাব মহামায়া দুর্গার।

শারদীয় উৎসব উদ্‌যাপন পরিষদের সদস্যরা
শারদীয় উৎসব উদ্‌যাপন পরিষদের সদস্যরা

দুর্গার আরেক নাম উমা। দেবী উমা থাকেন কৈলাসে পতিগৃহে। তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বাবা-মায়ের ঘরে আসেন। মর্ত্যে আগমনের প্রতীক্ষায় মা মেনকার সে কী ব্যাকুলতা! তারপর বিশ্বভুবনে মায়ের বাড়িতে দুর্গা তার পরিবারসহ কয়েক দিন থাকার পর ফিরে যান কৈলাসে। বিজয়া দশমী সেই ফিরে যাওয়ার ক্ষণ। এই ক্ষণ ছিল উৎসবমুখর।

আমি সংবাদ পড়ি। সে সংবাদে সবার প্রতি প্রাণের ভালোবাসা প্রকাশ পায়। জনসংযোগ শুরু হয় আসার পরপরই। কত কিছু নিয়েই না কথা বললেন উৎসব উদ্‌যাপন পরিষদ সভাপতি বাদল রায়। তার কামনা পূজার এই ধারা যেন অব্যাহত থাকে। উপদেষ্টা প্রকৌশলী উত্তম কুমার হাওলাদারও হৃদয়ের চাওয়া প্রকাশ করেন। বলেন, সবাই মিলে একসঙ্গে থাকতে চাই বলেই এ প্রয়াসের নাম সনাতনীদের উদ্যোগে। মঞ্চ থেকে গান ভেসে আসে।

ষষ্ঠী থেকে দশমী, পূজায় ব্যবহারের কয়েকটি পদ থাকে। পঞ্চপল্লব, পঞ্চশস্য, পঞ্চগব্য, ফুল-ফল, দুর্বা, তুলসী ইত্যাদি। রামায়ণে আছে—রামচন্দ্র দুর্গাপূজায় দেবীকে এক শ আটটি নীলপদ্ম অঞ্জলি দেওয়ার সময় একটি কম পড়ে যায়। এ অবস্থায় তিনি নিজের চোখ তুলে নিতে উদ্যত হন। দেবী মুগ্ধ হয়ে রামচন্দ্রকে রক্ষা করেন। সেই থেকে সুন্দর চোখকে পদ্মের সঙ্গে তুলনা করা হয়। পূজায় থাকে নবপত্রিকা। এর অর্থ নয়টি গাছের উপকরণ। যে গাছের কাছে দেবী দুর্গা আশ্রয় নিতেন। এই নবপত্রিকা বসুন্ধরার প্রতীক।

পূজার উপকরণ যুগিয়ে দিতে প্রয়োজন নিবেদিত এক নারীর। সেই মহিলা আর কে? সীমা সাহা। তিনি আছেন সব সময়, সব জায়গায়। এ ব্যাপারে তাকে সহযোগিতা করেন রুপা। বরাবরের মতো পূজায় পৌরোহিত্য করেন ছোটন চক্রবর্তী। স্পষ্ট উচ্চারণে আলাদা আমেজ আনে চরাচরে। সবাই পড়েন...সর্ব মঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে শরণ্যে ত্রম্বকে গৌরি নারায়নী নমস্তুতে...।

দুবাইয়ের অতিথিরা
দুবাইয়ের অতিথিরা

সমবেত কণ্ঠে গান গেয়েছেন শিল্পীরা। দুর্গে দুর্গে দুর্গতিনাশিনী তুমি মা মঙ্গলকারিনী। মহিষাসুর মর্দিনী জয় মা দুর্গা। সে দলে যুক্ত হয়েছিলেন আমার প্রাণপ্রিয় সহধর্মিণী লাকি হালদার উল্কা।

প্রিয়াঙ্কা শর্মা, ইংকিং রায়, মুন্নী কর্মকার, নীপা পাল রেখেছিলেন অনন্য ভূমিকা। সম্মিলিত সে দরজা ভরাট কণ্ঠ। কী এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এরপরই আনন্দ নৃত্য।

শারদীয় উৎসবের বিজয়া দশমীকে বলা হয় চিত্ত শুদ্ধির মিলনমেলা। উৎসবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘরে বয়ে যায় আনন্দধারা। তারা সকল ধর্মের মানুষকে নিমন্ত্রণ জানায়। গড়ে ওঠে সম্প্রীতির এক মেলবন্ধন। আয়োজনে বিভিন্ন রাজ্য থেকে অতিথি এসেছেন। তারা এখানে আনন্দ ভুবন রচনা করেন।

তরুণীরা এক হয়ে সেলফি তোলেন।

আবুধাবির অতিথিদের একাংশ
আবুধাবির অতিথিদের একাংশ

একপর্যায়ে দেবীর বিদায়ের ক্ষণ চলে আসে। পরিষদের সহসভাপতি কিশোর চক্রবর্তী দেবীর কাছ থেকে যার যা চাওয়ার চাইতে আহ্বান জানালেন। তার আকুলতা ভক্তের হৃদয় স্পর্শ করল। বিজয়া দশমীতে দেবী দুর্গা একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ার আহ্বান জানিয়ে স্বর্গলোকে ফিরলেন দোলা বা পালকিতে চেপে। তারা কাঁদলেন। কেউ কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলেন। পর্বটি ভিন্ন এক মাত্রা অর্জন করে।

ভক্তরা বিশ্বাস করেন, ইন্দ্রিয় পরিশুদ্ধ হয় হৃদয়ের ভক্তিতে। এই আলোকে, সুরশক্তির জয়ধ্বনি রচিত অসুর শক্তির বিনাশে। তাইতো বিজয়ার তিথিতে দেবীর চরণ ছুঁয়ে আশীর্বাদ নেয় নর নারী। এমনি এক সময়ে নারীদের শাখা-সিঁদুর অক্ষুণ্ন রাখার মানসে শেষ হলো শারদীয় দুর্গা উৎসব।

শুক্রবার বিজয়া দশমীর দিনে সর্বস্তরের মানুষের স্রোতোধারায় পরিণত হয়েছিল মিলনমেলা। ষষ্ঠী থেকে দশমী, আল আইনে পাঁচ তারা ডানাট হোটেলে পূজারিদের মিলনের পাঁচটি দিন যে কীভাবে ফুরিয়ে গেল...!