শারদীয় আয়োজনে প্রাণে প্রাণে

অঞ্জলি প্রদান
অঞ্জলি প্রদান

উত্তমের মন ভালো নেই। সে জন্য কী করা যায়? ঊর্মি বললেন, চলুন না নিসর্গ নগরীকে একটু ওলট পালট করে দেখে নিই। মন কাড়া তার কথা। আমাদেরও ইচ্ছে ছিল। আল আইনে সেভাবে ঘোরার সুযোগ হয়ে ওঠে না। সব সময়ই ব্যস্ততা আর টানাপোড়েন। এবারও তাই, সুতরাং...। বলছি, ফেরার সময়কার কথা।

আসা যাক শারদীয়া উৎসবের মূল অনুষ্ঠানে। শুরু থেকেই তাক লাগিয়ে দেন শিল্পীরা। আনন্দের সংবাদ দেন। মুন্নী কর্মকার, নীপা পাল, প্রিয়াঙ্কা শর্মা। গানে গানে ব্যাখ্যায়িত হয় নির্ভাবনার সমাচার। ওরে মা এসেছে মোদের কী আর ভাবনা আছে ভাই। সংগীত পরিচালনায় ঊর্মি হাওলাদার শিল্পিত হাতে পর্বটি নিয়ন্ত্রণ করেন।

ওদিকে মাতানো গানের আসর চলতে থাকে। মহানবমীর গভীর রাতেও মঞ্চের কুশীলবরা ক্লান্ত হন না। শ্রোতারাও উচ্ছ্বসিত হন। মঞ্চ সঞ্চালনা করেন মিন্টু মল্লিক ও সুজন দত্ত। এত বড় আয়োজন! কর্মটি ক্লাসে শিক্ষার্থীদের নাম ডাকার মতো হলে চলে না। সেই বিবেচনায় মেধার দক্ষতা দেখান তারা।

সিঁদুর খেলায় একজন আরেকজনকে রঙিন করে তুলছেন
সিঁদুর খেলায় একজন আরেকজনকে রঙিন করে তুলছেন

প্রতি মুহূর্তে হলের দর্শকেরা সম্মানিত হয়েছেন। তাদের ইচ্ছে ও চাওয়া ধরে এগিয়ে গেছে মঞ্চ। রথিন মিত্র দরাজ ভরাট কণ্ঠে এনেছেন একগুচ্ছ পৌরাণিক গান। লোকগানের মিশেলে সে কথা দীপ্তিময় হয়ে ওঠে। নৃত্যে তিশা সেন ততোধিক ব্যঞ্জনাময় করে তোলেন সে প্রেক্ষাপট।

মার্কেন্ডেয় পুরাণে ৮১ থেকে ৯৩ পর্যন্ত তেরোটি অধ্যায় নিয়ে আছে দুর্গা মাহাত্ম্য। মহামায়া দেবী মাহাত্ম্য অংশে মন্ত্র সংখ্যা সাত শ। অনেক নামে দুর্গার পূজা হয়। সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় মহাশক্তি নিয়ে বিশ্বভুবনে আবির্ভাব দেবীর।

সেদিন সে দুর্গার চরিত্রে আল আইনের একদল তরুণী মা। ইংকিং রায়, জেনি ঘোষ ও শুভ্রা শীল নামেন রীতিমতো কোমরে আঁচল বেঁধে। সীমা রায় রুপা নেতৃত্ব দেন এ পর্যায়ে। তরুণেরা শৃঙ্খলা ধরে রাখেন। হল আলাদা রূপ নেয়। সংবাদ প্রবাহ চলতে থাকে নির্দিষ্ট সময় পরপর। আমি চলতি সে মুহূর্তগুলো যুক্ত করি চলমান এ প্রক্রিয়ায়।

ছড়াকার লুৎফর রহমানের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি বলেন, পূজার্চনা সনাতন ধর্মীদের হলেও এর উৎসব আমেজের ভাগ সবার। অসাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি তিনি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন। উৎসব পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক মিহির কান্তি ফাঁকে ফাঁকে আসেন আমার কাছে। একটু কথা বললে বুঝি ভালো লাগে! বার্তা দেন, তাদের সংগঠন বিপদে আপদে সবার সঙ্গে থাকতে চায়। আমি বন্ধুত্বের হাত মেলাই।

বিশেষ মুহূর্ত
বিশেষ মুহূর্ত

পূজামণ্ডপ নারী, পুরুষ ও শিশুদের আগমনে ছিল মুখরিত। দর্শনার্থী ও পূজারিরা হৃদয়ের ভক্তি নিবেদন করেন দেবীর পাদপদ্মে। তারা কথা বলেন একজন আরেকজনকে নিয়ে। কখনো বা কয়েক জনের মধ্যে। এই যে পূজা বা ভাব-ভক্তি, এর অর্থ ঈশ্বরকেই ভালোবাসা। বলা হয়, এমন আয়োজনের মাধ্যমেই সর্বজনীনতার উন্মেষ ঘটে। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সুন্দরের সম্মেলনও ঘটে এমনি করে।

জেনি ঘোষ, ইংকিং রায় কাছে আসেন। বলেন, দাদার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে। নৃত্য ও গান দুই-ই আমার পছন্দ। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি। বলি, সে জন্য আমার কাছেও এই সময়টি বড় তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠছে। সীমা সাহা বলেন, তার প্রিয় ভূমি রংপুরের গল্প। জানাই, একবার আমি তিস্তার নিভৃত পল্লিতে গিয়েছিলাম। আসে ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ প্রসঙ্গ। বাকের ভাইকে টেনে আনেন সামনে। বলি, সেই ছাত্র জীবন থেকে আসাদুজ্জামান নূর প্রিয় একটি নাম। তরুণীও গুণী এই নাট্যজনের প্রতি শ্রদ্ধা ঢেলে দেন।

আয়োজনে মরু তীর্থ গীতা সংঘ, লোকনাথ সেবাশ্রম, সৎ সংঘ ও মারখানিয়া গীতা সংঘ সহযোগিতা করেছে। শংকর সূত্রধরের তত্ত্বাবধানে গত চার দিনে প্রসাদ প্রস্তুতিতে রূপণ, রাজু দাশ ও রনি সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেছেন। কিশোর চক্রবর্তী ও প্রকৌশলী বিকো রায় আমাকে তথ্যগুলো ধরিয়ে দেন। উদ্‌যাপন পরিষদ তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। আমি এ সব নথিবদ্ধ করি।

সব কাজের আরেক কাজী ঊর্মি। রাঁধা, চুল বাঁধা—সবই তার অভ্যাসের অন্তর্গত। তাদের বাসভবনেই আমরা উঠলাম। গভীর রাতে ঘরে ফেরা। ভোগের প্রসাদ এনেছেন। সেটাই যথেষ্ট, বললাম আমরা। কিন্তু তারতো আপ্যায়নের মন। পারেনও। পিরোজপুরের মেয়ে! আমের টক যুক্ত করতে দেরি হলো না। আরও আরও ব্যঞ্জনার সঙ্গে তৃপ্তি নিয়ে খেলাম। ভোরে উঠতে হবে। আমাদের জন্য সব প্রস্তুত করে রাখলেন।

একদল যুবক অনুষ্ঠান করতে নিরলস কাজ করেছেন। অতিথিদের হলে আনা, আপ্যায়ন—সবকিছুতেই ছিল তাদের আন্তরিক দৃষ্টি। কথা হচ্ছিল তাদেরই সঙ্গে। পঙ্কজ ঘোষ সদা তৎপর। আমন্ত্রিতদের আপ্যায়ন ত্রুটিমুক্ত হতে হবে। তাইতো নিজেই এগিয়ে যান। এদের প্রশংসা না করে পারি না।

দুবাই-আবুধাবির অতিথিদের সঙ্গে স্বাগতিকেরা
দুবাই-আবুধাবির অতিথিদের সঙ্গে স্বাগতিকেরা

বাদল রায়ের নেতৃত্ব ঈর্ষণীয়। সদা তৎপর কাজে। সঞ্জয় পাল নামটি আসে সবার কণ্ঠে। বিভিন্ন অঞ্চলে নিমন্ত্রণ পৌঁছে দেওয়ার জন্য ছুটে গেছেন উত্তর আমিরাতের শারজাহ, ফুজাইরা ও রাস আল খাইমা পর্যন্ত। বিপ্লব চৌধুরী আমাদের বিপরীত দিক থেকে আসছেন। নমস্কার প্রতি-নমস্কার শেষে তিনি ঢুকলেন হলে। বুঝলাম, এতক্ষণ সাংগঠনিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। পলাশ চৌধুরী দৌড়াচ্ছেন এখান থেকে সেখানে। উৎসব মানে অস্তিত্ব, যেকোনো মূল্যে এর মর্যাদা ধরে রাখতে হবে। তিনি নিবেদিত সর্বক্ষণ।

আবুধাবির অতিথিরা বসেছেন এক দিকে। তাদের সঙ্গে একটু সময় কাটাই। জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপক আবদুর রাজ্জাক মুখে মিষ্টি তুলে দেন। তার প্রাণময় হাসি আমাকে আনন্দ দেয়। দুবাই থেকে এসেছেন ব্রততী সরকার, মিতা সাহা, ইতি রায় ও সুমনা দাস। অন্য বহরে লাবণি-লক্ষণ দম্পতি। লাকি হালদার উল্কা মিলে গেলেন তাদের সঙ্গে। আনন্দের একটি মুহূর্ত! প্রাণের ভাই লক্ষণ এ পর্যায়ে সময়টির গুরুত্ব দিলেন।

সামনে কন্যাকে নিয়ে প্রকৌশলী হিরেন্দ্র দেব। এসেছেন প্রকৌশলী সুব্রত মজুমদার। সঙ্গে চন্দনা মজুমদার। দ্বিতীয়জন সিঁদুর খেলায় অংশ নিলেন। পূজা শেষে নারীরা মেতে ওঠেন সিঁদুর খেলায়। দেবীর চরণে সিঁদুর অর্পণের পর কৌটার সিঁদুর একে অন্যের সিঁথি-গালে মেখে রাঙিয়ে দেন। এর তাৎপর্য, শাখা-সিঁদুর অক্ষুণ্ন রেখে পরিবারের মঙ্গল কামনা। একই সঙ্গে দেবীকে পুনরায় আগমনের আমন্ত্রণ।

পাঁচতারা ডানাট হোটেলের পাঁচ দিনের অনুষ্ঠান। আল আইনের এ আয়োজন হয়েও যেন হয় না শেষ।

দশমীর দিন সকালে তার কৈলাসে যাওয়া নয়, বরং নিজেদের মনে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করা। তাইতো যুবতী নারীরা মেতে ওঠেন সিঁদুর খেলায়। এর আগে রাধাকৃষ্ণের লীলা দেখি। সুজন-প্রিয়াঙ্কা দম্পতি এখনকার কনিষ্ঠ জুটি। ঢাকের তালে তারা দ্বাপর যুগের দৃশ্যপট তুলে আনে। রঙে রাঙিয়ে দেয় একজন আরেকজনকে। অনন্য এক চেহারায় সাজে এ ক্ষণটি। আনন্দের কাব্য রচিত হয়।

দুবাইয়ের অতিথিরা
দুবাইয়ের অতিথিরা

বিজয়ার তিথিতে বেনারসি শাড়ি পরিহিতা দেবী দুর্গার রেশ ধরে মেয়েরা পড়েছিলেন বেনারসি শাড়ি। প্রায় সবার পরনে ছিল ঝলমলে রঙিন শাড়ির সঙ্গে কোমরে বিছা, নাকে নথ, পায়ে নূপুর। তারা মেতে উঠেছিলেন সিঁদুর খেলায়। হৃদয়ে ছিল উচ্ছ্বাস। ছেলেদের পরনে ছিল বাহারি পাঞ্জাবি ও কুঁচি দেওয়া গরদের ধুতিসহ নানা রঙের ধুতি। আনন্দে শামিল হয় তরুণ-তরুণীরা। টানাটানি করে আমাকে। আমি ওদের উৎসাহ দিই। সুজন শর্মা, প্রিয়াঙ্কা, সীমা সাহা, উর্মি হাওলাদার, জেনি ঘোষ, ইংকিং রায় ও শুভ্রা শীল নাচে। মাটি প্রকৃতি বৃন্দাবন হয়ে ওঠে।

শিশুরা নৃত্য করে। অভিষেক রায়, অর্পণ রায়, অঙ্কিতা রায়, অঞ্জলি কর্মকার, সুপ্রিয়া শর্মা, ঝিলান শীল মঞ্চ জমিয়ে তোলে। নৃত্য নয় শুধু, তারা তাদের শ্রেষ্ঠ অভিনয়ও ফুটিয়ে তোলে। আর প্রকৃতির কন্যা রাপাঞ্জেল এরিন ইয়ানা আছে সব সময়। নাচের সব কটি পর্বে। কখনো দেবী দুর্গা সেজে, কখনো বা গোপী হয়ে। সকালে অঞ্জলি দেন নরনারীরা। বরাবরের মতো পৌরোহিত্য করেন ছোটন চক্রবর্তী। স্পষ্ট উচ্চারণে আলাদা আমেজ আনে চরচরে। সবাই পড়েন, ওম বিষ্ণু, ওম বিষ্ণু।

তারপর সত্যিই বিদায়। প্রতিমার কাঠামো খোলা হচ্ছে। দুবাইতে বিসর্জন দেওয়া হবে। বিদায়ের হাত মেলান সাধারণ সম্পাদক প্রমল কিশোর নাথ। শুভেচ্ছা বিনিময় হয় অর্থ সম্পাদক শংকর কুমার নাথের সঙ্গে।

এই আয়োজন এবার নতুন নতুন শিল্পী পেয়েছে। আবার পুরোনো শিল্পীদের জন্য হা-হুতাশও করেছে। এই এখানে উর্নিশা নেচেছে, গেয়েছে সময় মন উজাড় করে। এবার সে জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে, মেডিকেল সায়েন্স পড়ার জন্য উড়ে গিয়েছে সুদূর চীনে। মা-বাবার মন সে জন্যই ভার ভার। প্রকৌশলী উত্তম কুমার হাওলাদার সত্যিই চিন্তামগ্ন। এই রেশটি কীভাবে কাটাবেন, ভেবে পান না। আমরাও এমন চিন্তা থেকে মুক্ত, তা বলা যাবে না। দুই দিকের বিবেচনা থেকেই ঊর্মির নিসর্গ দেখার অভিপ্রায় আপাতত স্থগিত রাখতে হয়।

অগত্যা বোঝাপড়ার এই সন্ধিক্ষণে তারা আমাদের এগিয়ে দিলেন বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত। আমরা ছুটলাম আবুধাবির দিকে।
...