দন্ত সমাচার

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

চিৎ হয়ে শুয়ে আছি। চিতপাত ছাড়া উপায়ও নাই। শুনেছি, খাস পাঠানরা নাকি চিৎ হয়ে শোয় না। ওদের কৌশল হচ্ছে উপুড় হয়ে শোয়া। সৈয়দ সাহেব তাই জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন? পাঠানের উত্তর, চিৎ হয়ে শুলে শুধু আকাশই দেখবে আর কিছু না। এখানে আকাশ দেখলে আর বাঁচার উপায় নেই। আফগান মুলুকে যে পরিমাণ গোলাগুলি হয়, যখন-তখন চিৎ না উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে হয়। উপুড় হলে মাথা সামান্য এদিক-ওদিক করে কারও সাহায্য চাইতে সুবিধা। কিন্তু চিৎ হলে তো শুধু আকাশ দেখা ছাড়া কারও সাহায্য চাওয়ার সুযোগ নেই। মনে আছে, ছোটবেলায় কচ্ছপ নিয়ে খেলার সময় ওদেরকে চিৎ করে দিতাম। বেচারা চার পা ছোড়াছুড়ি করতই শুধু। কিন্তু চলতে পারত না মোটেও। আমার এখন কচ্ছপ-দশা।

ডেন্টাল হাইজেনিস্ট বয়স্ক নারী। তবে গলার স্বর কর্কশ না একেবারেই। ছেলেদের মতো ছোট করে ছাঁটা চুল। গোলগাল মুখ, দেখতে ভারী মিষ্টি। নার্সের ইউনিফরম পরনে। হাসপাতালের মতো সাদা না, গাঢ় নীল রঙের ইউনিফর্ম। সুন্দর করে একটা হাসি দিয়ে মোহনীয় সুরে বললেন, ‘শুয়ে থাক চুপচাপ। ডক্টর এখনই আসছেন।’ হাতে একটা রিমোট ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ইচ্ছে করলে শুয়ে শুয়ে টিভিও দেখতে পার।’

সেই থেকে চিৎ হয়ে শুয়ে ওপরে তাকিয়ে আছি। চোখের দৃষ্টি অবারিত নীলাকাশে না। আটকে আছে ঘিয়ে রঙের ফলস সিলিংয়ের দিকে। নির্দিষ্ট করে বললে, সিলিংয়ের সঙ্গে লাগানো টিভিটার দিকে। তবে ঠিক আরাম বোধ হচ্ছে না তেমন। সোফা-চেয়ারে বসে টিভি দেখার অভ্যাস। নিদেনপক্ষে খাটে শুয়ে মাথা কাত করে দেখি মাঝেমধ্যে। তাই বলে ডেন্টিস্টের চেয়ারে একেবারে চিৎপটাং হয়ে টিভি দেখা? তাও আবার নির্বাক যুগের শব্দহীন ছবির মতো। সেই যুগে চার্লি চ্যাপলিন কত রকম ক্যারিকেচার করেছেন কোনোরকম শব্দ ছাড়াই। এখন শুধু দেখা না, শোনারও যুগ। টিভিতে এখন চার্লির কোনো ক্ল্যাসিক কসরত দেখানো হচ্ছে না।

বয়স্ক নারী মাথার কাছে একটা হেডফোন রেখে দিয়েছেন, ‘ইচ্ছে হলে শব্দও শুনতে পার।’ কিন্তু আমার ইচ্ছে করছে না। হাত নাড়িয়ে, মাথা ঘুরিয়ে হেডফোনটা কানে লাগানোর কোনো তাড়া অনুভব করছি না। শব্দ দিয়ে আমি কী করব? একটা রান্নার অনুষ্ঠান হচ্ছে টিভিতে। খাদ্যদ্রব্য দেখা আর খাওয়ার জিনিস। শোনাশুনির কোনো ব্যাপার নাই এতে। জীবনে কোনো দিন রান্নার অনুষ্ঠান টিভিতে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। অথচ আমি অতি মনোযোগ দিয়েই রান্নার অনুষ্ঠান দেখছি এখন। তিনজন শেফ রান্না করছেন। এপেটাইজার, মেইন কোর্স আর ডেজার্ট। কে কত দ্রুত ও সুস্বাদু রান্না করতে পারে তার একটা প্রতিযোগিতা চলছে অনুষ্ঠানে। দুটি এপেটাইজার করছে ওরা-বিফ ওয়েলিংটন আর ওয়াইল্ড মাশরুম টার্টলেট। দুটিই শিঙারা-সমুচারই ভিন্ন কোনো সংস্করণ।

মেইন কোর্সে বিফ টেন্ডারলইন। সঙ্গে ম্যাশ পটেটো আর গ্রেভি। প্লেটে রঙের বাহারের জন্য গাজর আর ব্রকলির কয়েক টুকরো আছে। দুই ফালি করে কাটা গ্রিন হালাপিনো আর অ্যাস পারাগাছের ডাঁটাও আছে কয়েকটা। দেখতে ভীষণ লোভনীয়। কিন্তু খেতে কুৎসিত কিছু একটা হবে নিশ্চয়। কারণ, গরুর মাংস পুরোপুরি রান্না হয়নি। মাংসের মাঝখানে তাজা লাল রক্তের ছোপ দেখা যাচ্ছে। এরা বলে মিডিয়াম ডান। গরুর মাংস খেতে কোনো আপত্তি নেই আমার। তাই বলে রক্ত খাব কেন? ওয়াক থু!

ডেজার্ট দেখতে আরও চমকপ্রদ। পিরামিড চকলেট কেক, সঙ্গে কয়েকটা স্ট্রবেরি আর ব্লুবেরি। বেলজিয়াম ডার্ক চকলেট আর ক্যারামেল হ্যাজেলনাট ক্রিমে মাখানো-ভারী চমৎকার দেখতে। কিন্তু মুখে দিলে ওই জলবৎ তরলং। উহু, কথাটা মম হলো না। থোড় বড়ি খাঁড়া, খাঁড়া বড়ি থোড় বললে মানানসই লাগে বোধ করি। এরাতো আর কাচা রস জ্বাল দিয়ে খেজুর গুড়ের পায়েস খায়নি কখনো। ডেজার্টের স্বাদ কেমনে বুঝবে?

টিভিতে দেখা যাচ্ছে, তিনজন শেফ মিলে কিচেনে হুলুস্থল করে ফেলেছেন। স্কুল খুইলাছেরে মাওলা টাইপের ধুন্ধুমার কাণ্ড। কত রকমের যে স্পাইস আছে! একসময় দেখি মাংসের মধ্যে একটু ব্রান্ডিও ঢেলে দিল। মদও যে রান্নার উপকরণ, ভিরমি লাগে আচানক! তবে প্লেটে এদের খাবার পরিবেশনা ফরাসি চিত্রকরদের বিখ্যাত শিল্পকেও ছাড়িয়ে যায়। একেকটা ডিশ এমনভাবে সাজিয়ে রেখেছে যে, গলা পর্যন্ত ভরা থাকলেও এখনই ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। পেটের না হলেও চোখের ক্ষুধার একটা দাম আছে না! চোখের ক্ষুধাই এ দেশের বৃহৎ কাম্য। পশ্চিমের তাই দৃষ্টিসীমার সবকিছু পরিপাটি করার দিকেই অসীম ঝোঁক। ভেতরে যতই গোলমাল থাকুক না কেন।

শুয়ে শুয়েই আবোল-তাবোল সব ভাবছি। কী আর করব। নাই কাজ তো মটরশুঁটি ভাঁজ। খই আমার মোটেও পছন্দের না। তবে মটরশুঁটি ভেজে মুড়ি আর সরিষার তেল দিয়ে মাখিয়ে দিলে, ওয়াও! এক বসায় এক গামলা খেয়ে ফেলতে পারি। রুমের দেয়ালে প্রাইউডের দুটি বড় বোর্ড লাগানো। বোর্ডে পুশপিন দিয়ে অনেকগুলো শিশুর হাস্যোজ্জ্বল মুখের ছবি সাঁটানো আছে। কেমন ফুলের মতো লাগছে ওদের। নিষ্পাপ শিশুগুলো দাঁত বের করে আছে, পুরোটা। দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য হচ্ছে শিশুর হাসিমুখ। আর ফোকলা দাঁত হলেতো কথাই নেই। দৃশ্যটা তখন সৌন্দর্যের মগডাল ছেড়ে পাতার আগায় চলে যায়।

বোর্ড দুটির ওপরে ক্যাপশন লেখা-ক্যাভিটি ফ্রি হল অব ফেম। যে সকল শিশুর দাঁতে কোনো ছিদ্র নেই ওদেরই ছবি আছে এখানে। হল অব ফেমে সেসকল শিশুই স্থান পেয়েছে। হলিউডের বিখ্যাত ওয়াক অব ফেমের কথা মনে পড়ল কী? রাস্তার ফুটপাত জুড়ে শয়ে শয়ে স্টার, সেখানে তারকাদের নাম লেখা। কত কত বিখ্যাত তারকা আছে! সিনেমার অভিনেতা, টিভি ব্যক্তিত্ব-শো বিজের কে নেই সেখানে। গ্রেট ব্রুস লি আছেন, বব মারলে আছেন, চাঁদে যাওয়া নীল আর্মস্ট্রংও আছেন। এখনো পর্যন্ত ছাব্বিশ শরও বেশি তারকা হয়ে গেছে। অবশ্য আমার অতিপ্রিয় ক্লিন্ট ইস্টউড আর জুলিয়া রবার্টস ওয়াক অব ফেমে নেই। তাঁরা এই তারকা হতে বেশ কয়েকবারই না করে দিয়েছেন। এদিকে, কীভাবে কীভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পও এই তারকাদের মধ্যে চলে এসেছেন। ফেমাসদের মর্যাদাই ছোট করে ফেলল এই কুৎসিত নামটি।

হল অব ফেমে মুসলিম নাম বোধ হয় খুব বেশি নেই। তার মধ্যে মহান মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী আছেন। আলীর তারকাটি আবার একটু ভিন্নধর্মী। আলীকে বলা হয় তার নামে একটি তারা হবে ওয়াক অব ফেমে। আলী তাতে শর্ত জুড়ে দেন একটা। তাঁর নাম ইসলামের মহান নবীর নামে। তাই তিনি চান না কেউ তার নামের ওপর দিয়ে হেঁটে যাক। সে জন্যে একমাত্র আলীর তারকাটি ফুটপাতের পরিবর্তে দেয়ালে সাঁটানো। ধন্যবাদ মহান বীর। সে যা হোক, ক্যাভিটি ফ্রি বোর্ডের ছোট ছোট শিশুর মুখগুলোকে একেকজন যোদ্ধার মতোই লাগছে। আলীর দীপ্ত অবয়ব ওদের চেহারায়। নিয়মিত দাঁতের পরিচর্যা করে এরা। ব্যাকটেরিয়াদের সঙ্গে প্রাণপণ যুদ্ধ করে কোনো ক্ষতি করতে দেয়নি দাঁতের। একেবারেই ক্যাভিটি ফ্রি হাসিমুখ।

শুয়ে আছিতো আছিই। ডেন্টিস্টের কোনো খবর নেই। টিভিতে রান্নার প্রোগ্রামটা শেষ হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। নতুন একটা শেফ এসেছেন এখন। ভিন্ন রান্না হবে নিশ্চয়। অবাক লাগে! শুধু রান্না নিয়েই একটা টিভি চ্যানেল, আজব! হঠাৎ মিষ্টি গলার বয়স্ক ডেন্টাল হাইজেনিস্ট চলে আসেন। একটা এক্সরে করাতে হবে। মুখের মধ্যে কী একটা রেখে বোতামে চাপ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই পাশের কম্পিউটারে ভেসে উঠল আমার দাঁতের চিত্র। কৌতূহলী হয়ে তাকাই। মাই গড! কী বীভৎস রে বাবা! এ জন্যই কঙ্কাল দেখতে এত ভয়ংকর লাগে। রবীন্দ্রনাথের কঙ্কাল গল্পটা তাই একবারের বেশি দুবার পড়িনি কোনো দিন। পড়তে গেলেই কঙ্কালের বীভৎস চেহারা ভেসে ওঠে। মেজাজ খারাপ লাগে। ধুর! নিজের দাঁত দেখার খেতায় আগুন।

চোখ ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক দেখি আবার। ডেন্টিস্টদের ক্লিনিকগুলো এমনই হয়। নানা রকম যন্ত্রপাতি। একটা দিয়ে পানি ঢালে মুখের ভেতর। আবার অন্যটা দিয়ে টেনে বের করে। ছুড়ি-কাঁচির সমাহারতো আছেই। ডেন্টিস্টদের কাছে একবার গেলে কিন্তু আর রক্ষা নেই। দর্শন দেওয়া এরপর পৌনঃপুনিক হয়ে যায়। প্রথমে ক্লিনিং, এরপর স্কেলিং। রুট ক্যানাল করাবে, ক্রাউন পরাবে, শেষে দন্ত উৎপাটন। আবার পাশের দাঁতের ক্লিনিং থেকে শুরু। এভাবে বত্রিশটা উঠিয়ে ক্ষান্ত দেন তারা। এরপর বলেন, ‘ছেলেকে নিয়ে আসবেন। ক্লিনিং করে দেব।’

আমার সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। ওপরের মাড়ির একটা দাঁত তুলে ফেলতে হবে। বাকিগুলো কবে তুলে ফেলবে তার একটা অগ্রিম শিডিউল দিয়ে দিলে ভালো হতো। কাজের চাপে চ্যাপ্টা হয়ে আছি। আগে জানা থাকলে চট করে বিপদে পরতে হবে না। ডেন্টিস্টের সোজন বাদিয়ার ঘাটে পা দিয়েই ফেলেছি। মাড়ি ফুতুর না করে ছাড়বে না ওরা। হাইজেনিস্ট নারী এসে গোটা দু-এক ইনজেকশন দিয়ে গেছেন ইতিমধ্যে। ওপরের মাড়ি কেমন অসাড় হয়ে যাচ্ছে। কোনো বোধ-বালাই টের পাচ্ছি না। মুখ নাড়াতে পারছি কী না খোদাই জানেন। কাশি দিয়ে একটু কথা বলার চেষ্টা করলাম। গিটারের সবচেয়ে মোটা তারের বাজনার মতো কেমন একটা শব্দ বেরুল। তাড়াতাড়ি মুখ চাপা দিয়ে দাই। কোনো সময় আবার গলার স্বর জি-সার্পে চলে যায় কে জানে।

এতক্ষণ তাও মাথা ঘুড়িয়ে এদিক-ওদিক কিছু দেখছিলাম। এখন পাঁচ মনি মুখটা নড়ছে না, নাড়াতেও পারছি না। চিন্তাশক্তিও ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। প্যারালাইসিস রোগীদের কথা ভাবছি। সামান্য মুখের অসাড়তা নিয়ে আমি কাহিল। ওদিকে হাত-পা, শরীরের অর্ধাংশ আবার কারও কারও পুরো শরীর অবশ হয়ে যায়। কী কষ্ট তাদের! কথা নেই, বার্তা নেই একটা হাত বা একটা পা নাড়াতে পারছে না। এরা মনোপ্লেগিক। আর হেমিপ্লেগিকদের শরীরের একপাশের হাত এবং পা দুটিই অবশ হয়ে যায়। যাদের দুই পা অবশ তারা প্যারাপ্লিগিক। কিন্তু সবচেয়ে কষ্ট কোয়াড্রিপ্লেগিয়াতে-শরীরের চার হাত-পা সব অবশ হয়ে যায়। আহারে! কী কষ্ট!

আমারটা মনোপ্লেগিয়া হবে কী? যাই হোক না কেন, অবশ মুখে শুয়ে আছি ডেন্টাল চেয়ারে। চেয়ার বলা কি ঠিক হচ্ছে? ভালো করে বললে একে ডেন্টাল ইঞ্জিন বলা যায়। যন্ত্রপাতিতে ঠাসা আছে এই চেয়ার। আমার মুখে থুতু জমে যাচ্ছে। পিক করে থুতু ফেলার কোনো সুযোগ নেই। তা ছাড়া মুখওতো অসাড়। পিক শব্দ হবে কিনা সন্দেহ। হাত বাড়িয়ে সাকশন টিউবটা নিয়ে মুখের ভেতরটা পরিষ্কার করি নিজেই। ইতিমধ্যে ডা. ইকবাল মাওজি চলে এসেছেন। ভদ্রলোক পাকিস্তানি হবেন বোধ হয়। ভারতীয়, আফগানি বা ইরানিও হতে পারেন। লম্বা দীর্ঘ দেহ ভদ্রলোকের। খাস পাঠান সন্দেহ নেই। সারাক্ষণই মুখে মাস্ক আর চোখে ম্যাগনিফাইং চশমা লাগানো বিধায় ভদ্রলোকের চেহারা দেখিনি কোনো দিন।

‘কী খবর? ভালো আছেন?’ মাওজি সাহেব হাসতে হাসতে বলেন। ডাক্তারদের হাসতে হয়। ক্যালগেরির ডাক্তারদের মেডিকেলের প্রশিক্ষণের আগেই হাসার প্র্যাকটিস করে নিতে হয় শুরুতে। অতি সংকটময় মুহূর্তেও অভিনেতাদের মতো হাসি মুখ ধরে রাখতে হয় এদের। এতে নাকি রোগীর মনোজগতে প্রভাব পরে। যার হাসি যত সুন্দর তার রোগী তত খুশি। তত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়। এরা ডাক্তারি বাদ দিয়ে হলিউডে গেলেই পারে। আমার এখন সারা মুখ অবশ। গলায় আওয়াজ গিটারের সবচেয়ে মোটা তারে। তাই মনজাগতিক কোনো চাঞ্চল্য আসল কিনা ঠিক ধরতে পারছি না। তবে ঘর ঘর স্বর তুলে কোনোমতে বলি, ‘ভালো আছি, ডক্টর।’

‘গুড। দেখি, হা করেন তো। একটু বড়, হ্যাঁ এ রকম। ভেরি গুড।’

তাঁকে দেখি গুডে পেয়েছে। আমি মুখ বন্ধ করলেও গুড, খোলা রাখলেও গুড।

‘এই দাঁতটায় সমস্যা হয়েছে। হ্যাঁ, এটাতে। দাঁতের গাম নষ্ট হয়ে গেছে। বোন বেশ দুর্বল, ফাউন্ডেশন নড়বড়ে। সমস্যা নেই এখনই তুলে ফেলব। গুড।’

আবার গুড! আমি মুখ হা করে তাকিয়ে আছি। উনি দাঁতটা ধরে নাড়াচাড়া করছেন। একটা আস্ত দাঁত তুলে ফেলবেন, তাতেও গুড। হারামজাদা! বলেই ফেলি নিচু স্বরে।

‘কিছু বললেন?’ ভদ্রলোক অবাক হন।

‘না, না, কিছু না।’

হঠাৎ বলেন তিনি, ‘আপনি ঠিক আছেনতো। কোনো সমস্যা?’

আমি প্রায় নির্জীব স্বরে বলি, ‘জ্বী। সমস্যা নাই। খুব ভালো আছি।’

‘গুড।’ বলে লাল রঙের কী একটা বস্তু দাঁতের গোড়ায় লাগাতে থাকলেন। ‘এইতো, আরেকটু। সামান্য ধৈর্য ধরুন। ভেরি গুড।’

বেটা তোমার গুডের গুষ্ঠি মারি। ঘণ্টা খানেক ধরে সমগ্র বাংলাদেশ পাঁচ টন ট্রাকসম মুখটা নিয়ে শুয়ে আছি। আর তুমি গুড নিয়ে আছ। কতক্ষণ আর পারা যায়!

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

পাশের নার্সের ট্রে থেকে সাঁড়াশির মতো একটা যন্ত্র তুলে নিলেন তিনি। বাম হাত দিয়ে মুখটা যথাসম্ভব হা করে সাঁড়াশি ঢুকিয়ে দিলেন মুখের ভেতর। আমি চরম ভিতু ধরনের মানুষ। অন্ধকারে একা ঘুমাতে পারি না কখনো। দোতলার ছাদে উঠেও নিচে তাকাতে পারি না ভয়ে। যদি পড়ে যাই। ভাগ্যিস আমাদের সময় মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। থাকলে যুদ্ধ না করে চৌকির তলায় লুকিয়ে থাকতাম নিশ্চিত। ভয়ে পালানোর একটা স্বভাব আমার চরিত্রে বরাবরই আছে। স্কুলের ক্লাস পরীক্ষায় বরাবরই ডাব্বা থাকত। আর প্রতিবারই ফল বের হওয়ার পরপরই বাসা থেকে ছুট। অনেক খোঁজাখুঁজি করে যখন পেত ততক্ষণে সকলের রাগ পানি হয়ে গেছে।

সাঁড়াশি যন্ত্রটা দেখেই আত্মারাম খাঁচা। এখন যন্ত্রটা মুখের ভেতর। তাই আত্মারাম না পুরো দেহরাম খাঁচা হয়ে গেছে। ভয়ংকর ব্যাপার না? মুখের মধ্যে সাঁড়াশি। সিনেমার নাম হতে পারে একটা। ‘বাবা কেন আসামি’, ‘স্বামী কেন চাকর’ তেমনি ‘মুখের মধ্যে সাঁড়াশি’। অভিসার হলের বাইরে বিরাট বিরাট পোস্টার থাকবে। সেখানে ভয় পেয়ে কুঁকড়ে যাওয়া একটা মুখ। আর তার ভেতর ডা. হাসিমুখে সাঁড়াশি ভরে দিয়েছেন। এ ছবি দেখেই সাইকোপ্যাথ টাইপের লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়বে হলে। হলময় সিটি খেতে খেতে মহাআনন্দে পরিচালকের চোখ ভিজে উঠবে।

সাইকোপ্যাথ ছাড়া আর কে এসব ছবি দেখবে? সাইকোপ্যাথি আসলে এক ধরনের মেন্টাল ডিসঅর্ডার। আরও ভালো করে বললে, অ্যান্টি সোশ্যাল চরিত্রের এরা। অপরের সুখ-দুঃখ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। কোনো অনুতাপ নেই, কোনো বিকার নেই। শুধু নিজেকে নিয়েই আছেন। এদের সংখ্যা সমাজে অনেক। এদের সবচেয়ে ওপরের দিকের আত্মকেন্দ্রিক চরিত্রকে বলে ম্যাকিয়াভেলিনিজম। এরা এতটাই আত্মকেন্দ্রিক যে অপরকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। যেকোনো উপায়ে নিজের আখের গোছানোই এদের চরিত্র। এই ঘরানার আরও একটা গ্রুপ আছে-নারসিসিজম। তাই সাইকোপ্যাথ, ম্যাকিয়াভেলিনিজম ও নার্সিসিজমকে একত্রে বলে-ডার্ক ট্রায়াড, অন্ধকার তিন।

তা হোক, সাইকোপ্যাথরা নিবিষ্ট মনে ‘মুখে কেন সাঁড়াশি’ দেখতে থাকুন। আমি শুয়ে শুয়ে ডাক্তারের চেহারা দেখছি। ভদ্রলোক কাঙ্ক্ষিত দাঁতটা ধরে হালকা একটু নাড়াতে লাগলেন। এরপর আস্তে আস্তে টানতে থাকলেন তুলে ফেলবার জন্য। দাঁত বাবাজি বের হতে চাচ্ছেন না। উনি টানছেন আর দাঁত রয়ে যাচ্ছে। দুইয়ের ধস্তাধস্তি, মাঝখানে আমি মরিচের জান যায়। মুখের মধ্যে সাঁড়াশি ভরে জোরসে টানাটানি চলছে-আরও জোরে, হেইয়ো। ডাক্তার বাঙালি হলে নির্ঘাত বলে ফেলত, জোরসে টানো, হেইয়ো। আরও জোরে, হেইয়ো। এই স্লোগানের ইংরেজি, হিন্দি বা উর্দুর ভার্সন আছে কিনা কে জানে। ভদ্রলোক পাঠান হলেতো আবার পশতু বলতে হবে। বড্ড ঝামেলায় পড়া গেল!

তবে উনি হেইয়ো-জোরসে না বলে বললেন, ‘রুটটা বেশ গভীর মনে হচ্ছে। তুলে ফেলতে কষ্ট হচ্ছে।’ বলেই আবার টানাটানি চলছে। আহারে! আমার গভীর দাঁতখানার কেমন অপমৃত্যু হচ্ছে।

হঠাৎ মড়াৎ করে শব্দ। কী হলো? দাঁত ভেঙে গেছে। আহা, দাঁত! ওর কী দোষ। ওতো থাকতেই চাচ্ছে। পণ করেছে, ভাঙবে তবু মচকাবে না যে। নিজের ভাঙা টুকরো রেখেও জানান দিচ্ছে, ‘ডক্টর, আমাকে তুলো না। প্লিজ।’

ডাক্তারের সে খেয়াল নেই। উনি যুদ্ধে নেমেছেনে। দন্ত উৎপাটনের লেলিহান ক্ষুধায় চকচক করছেন। সাঁড়াশি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে শেষ বিন্দু দাঁতের টুকরো তুলে ফেলে তৃপ্তি ঢেকুর তোলেন তিনি, ‘যাক, বাঁচা গেল। কী যে ঝামেলায় পড়েছিলাম। এত গভীরে রুট থাকায় বেরই হচ্ছিল না।’ আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘আপনি ঠিক আছেন তো?’ উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলেন, ‘গুড।’ আমি কথা বলব কী? মুখের মধ্যে যে সাঁড়াশি!

ডাক্তারকে দেখে মনে হচ্ছে, ঘেমে-নেয়ে গেছেন ভদ্রলোক। বেশ একটা ধস্তাধস্তি হয়ে গেল। ক্যালগেরির এই প্রচণ্ড শীতে ঘেমে যায় কেউ? ভদ্রলোক পাশের নার্সের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘গর্তটা বেশ বড় মনে হচ্ছে। সেলাই করে দিই। তাহলে, তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে।’

নার্স সুই-সুতা এগিয়ে দিলেন। আমি শুয়েই আছি। ভয়-টয়ের ঊর্ধ্বে উঠে গেছি অনেক আগেই। এখন প্রায় অবচেতন মনে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। ডাক্তার সাঁড়াশির বদলে সুই-সুতা নিয়ে মুখের মধ্যে ঢুকে গেলেন। একটা সেলাই দিলেন। দ্বিতীয় আরেকটিও। শার্টের ছিঁড়ে যাওয়া পকেটটা সযত্নে সুই-সুতোয় মুড়ে দিচ্ছেন যেন। ঘ্যাচ ঘ্যাচ শব্দ হচ্ছে। আমার শরীরে তখন অনুভূতি বলতে তেমন কিছু নেই। তবুও বুঝতে পারছি পুরো শরীর কাঁপছে। বিশেষ করে হাত দুটি। চাপ দিয়ে ফেইট জিনসের পকেটে ভরে ফেলেছি হাত দুটি। পাছে তারা আবার না দেখে ফেলেন কম্পমান হস্ত যুগল।

সেলাই শেষ করে উনি উঠে দাঁড়ালেন, ‘অল গুড। আপনি এখন যেতে পারেন।’

আমি সদ্যই দাঁত হারানো। মাড়িতে দুটি সেলাই নিয়ে কম্পমান শরীরে উঠে দাঁড়াই। কোনোমতে টলতে টলতে রিসেপশনের কাছে। ড্রাইভার হিসেবে ছেলেকে নিয়ে এসেছি। গাড়ির আয়নায় নিজের চেহারা দেখি। মুখের বাম পাশ ফুলে আছে একটু। এ ছাড়া, তেমন কোনো সমস্যা দেখছি না। সাহসী হয়ে গেছি নাকি! ভয় কী পাইনি ততটা? এক দাঁত-তোলা এতটা সাহসী করে তুলল? ‘ভয় কাতুরে মাহবুব আজ এমন সাহসী?’