মাঝি তুমি উজান গাঙে নাও ভিড়াও

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সাঁঝ সকালে পেয়ারা গাছে ঝুলে বুলবুলির সঙ্গে বন্ধুত্ব, কচি পাতার ঘ্রাণ আর বাবাকে লক্ষ্য করে বলা—বাবা–আ–আ–আআআ; আজ তোমাকে ডিস্টার্ব করবই করব! বিষণ্ন মুখে বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মা, দুপুরে কিন্তু ভাত খেয়ে নিস। আমি ভাত না খেয়ে থাকা মানেই বাবাকে ডিস্টার্ব করা। ভীষণ কষ্টে থাকেন বাবা। এমনকি অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কাজের ফাঁকে বারবার ভাবেন; মেয়েটি ভাত খেয়েছে তো। আর আমি সেই সুযোগটুকু ভালো করেই নিতাম। মনে করতাম এটাও একটা খেলা। দর্জিবাড়ি থেকে পুতুলের বেনারসি শাড়ি সংগ্রহের মতন। না পেলে কান্না, গাল ফোলা অভিমান। শাড়িটাও হওয়া চাই লাল রঙের। সঙ্গে কিন্তু পুঁতির গয়না।

কনে দেখাদেখি ও পানচিনি শেষে বিয়ের দিন ধার্য হলো। প্রথম, দ্বিতীয় আর তৃতীয় শাড়ির পর শুধু গয়না কেনা বাকি। সই মৌটুসী আর আমি লাল রঙের পুঁতি কিনে টিকলি, কানের দুল আর নেকলেস বানিয়ে ফেললাম। মামনির গয়নার বাক্সকে বানালাম বিয়ের সুটকেস। ড্রেসিং টেবিল থেকে সাজুগুজুর জিনিস নিয়ে বানালাম বিউটি বক্স। পাশেই মহিন কাকার দোকান থেকে নিলাম কুমকুম। জড়ির মালা আর মুখ দেখাদেখির জন্য পিতলের আয়না।

শিশিরের পথ মাড়িয়ে শীতলক্ষ্যার বুকে অবাক তারার সন্ধ্যা। বিয়ের গীত, মিষ্টি মিঠাই, রসগল্প আর বউ-বাসন্তীর সোঁদা ঘ্রাণ! মেহেদি-কাঁচা হলুদ, আতশবাজির রোশনাই। দাদিমার খুনসুটি, গল্পকথা; ‘আমাদেরও এমন দিন ছিল!’ পাড়া মহল্লায় সাজসাজ রব সত্যি সত্যি বিয়ে!

বিশাল বহরের বরযাত্রী নিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে কনের বাড়িতে আমরা গেলাম। চারপাশে বিরিয়ানি, রেজালা আর জর্দার ম ম ঘ্রাণ। ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজছে গান—

‘লীলাবালি লীলাবালি...কী দিয়া সাজাইমু তরে।’

গেটে রং করা আয়োজন! বেয়াই–বেয়াইন খুনসুটি, কড়া মিঠা আলাপন। অতঃপর উপযুক্ত নজরানা দিয়ে প্রবেশপত্র পেলাম!

ঘরভর্তি মেহমান, সোনার পালঙ্কে নাইওরি, সওয়ারির রাতভর আড্ডা, আড়াআড়ি ঘুম। সকাল মুখরিত হয় পাতিলভর্তি হান্দেশ, কাটাকুটি পাপড়া আর ঝিলমিল পিঠার বাহারি সাজসজ্জায়। শিউলি তলায় আড্ডায় মেতেছে কেউ কেউ। রঙের দিন। উছলিয়ে ওঠে পূর্ব জনমের খোয়াব। হাতে হাত রাখা কঠিন জেনেও বউ-বসন্ত উৎসবে কেউ খোঁপায় গুঁজে দিচ্ছে মৌ ফুল কেউ বা শিকেয় লুকানো মন পোড়া দু’কলম চিঠি।

অবশেষে পুতুলের বিয়ে। সোনার কঙ্কণ, মালতী হার আর রূপ চন্দন টায়রায় পালকি চলে হুন হুনা...হুন হুনা; রুমালে মুখ ঢেকে লাজুক চোখে জামাই হাঁটে...স্বপ্ন আঁকে নয়া দিনের। তালপাতার ঘর, বুনোফুলের গয়না, বিছরায় বিন্নিচাষ, হাটবারে মজার পোটলায় খুশির আমেজে লজ্জাবতী বউ।

আর আমি ততক্ষণে পৌঁছে গেছি বাউল বাড়ির বকুলঘাটে। লাল পিরানের ঘ্রাণে...তোকে ছুঁয়ে দেখব বলে।

ভরা পূর্ণিমায় ঘর ছাড়ব বলেই পুঁটলি বেঁধেছি
লগ্ন এলেই না পালাব
শঙ্খধ্বনি বাজলেই পরব
ঢাকাই শাড়ি আর কপালে সিঁদুর!
মেহেন্দি রাঙা হাতে অপেক্ষায় আমি
মাঝি তুমি উজান গাঙে নাও ভিড়াও।
...

মুক্তা মাহমুদা: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।