টরন্টোয় উদীচী কানাডার সুবর্ণজয়ন্তী

উদীচী কানাডার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করছেন রথীন্দ্রনাথ রায়
উদীচী কানাডার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করছেন রথীন্দ্রনাথ রায়

ঝরাকালের আকাশে আচমকা মেঘের আনাগোনা। বাউল বাতাস তাপমাত্রাকে নামিয়ে আনে হিমাঙ্কের নিচে। বৃষ্টি জমাটবাঁধা নরম তুষার, ঝরা পাতার রঙিন জমিনে চুমু খেয়ে পলকে বিদায় নিয়েছে। লেগেছে হিমের পরশ।

গত শনিবার (১০ নভেম্বর) টরন্টোর শীতল সন্ধ্যায় গ্র্যান্ড প্যালেস কনভেনশন সেন্টারে রঙিন আলোয় রাঙানো ছিল বাংলাদেশ উদীচী শিল্পগোষ্ঠী কানাডা শাখার ষষ্ঠ দ্বিবার্ষিক সম্মেলন ও সাংস্কৃতিক উৎসব। ‘আঁধারবৃন্তে আগুন জ্বালো, আমরা যুদ্ধ, আমরা আলো’ এই স্লোগান নিয়ে উদীচী শিল্পগোষ্ঠী বাংলাদেশে সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছে ২৭, ২৮ ও ২৯ অক্টোবর।

আলোর এই স্লোগান গ্রামগঞ্জ, হাট, জনপদ, লোকালয় এমনকি দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী উদীচীর কর্মীরা গেয়ে চলেছেন, ছড়িয়ে দিচ্ছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। শোষণের বিরুদ্ধে সমস্ত মুক্তিকামী মানুষের দিন বদলের স্লোগানের একত্রিত স্পর্ধিত উচ্চারণ উদীচী।

দ্বিজাতিতত্ত্বের বুকে লাথি মেরে, প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার ধারক-বাহক, কৃষকের নেতা, রাজনৈতিক সংগঠক, শিল্পী, লেখক, গীতিকার ও সাংস্কৃতিক যোদ্ধা কমরেড সত্যেন সেন ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর যে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, মার্ক্সবাদী সাহিত্যিক-সাংবাদিক রণেশ দাসগুপ্ত আরও অনেক সহযোদ্ধাদের নিয়ে যে সাংস্কৃতিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন; পঞ্চাশ বৎসর পেরিয়ে আজও এই সংগঠন দিকহারা সংস্কৃতি তথা গণমানুষের সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে উত্তরের ধ্রুবতারা হয়ে দিশা দেখিয়ে চলেছে।

১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পর যে সাম্প্রদায়িকতার চাষ হয় বাংলাদেশে, এর বিরুদ্ধে মাটির বুক ফুঁড়ে উদিত অঙ্কুরের বিপ্লবী কলরব উদীচী। যখনই উগ্র ধর্মান্ধতা, সাম্রাজ্যবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, প্রতিনিয়ত প্রগতিশীলতার মশাল জ্বালিয়ে রেখেছে উদীচী; বিস্তার করেছে তাদের শাখা-প্রশাখা দেশে-দেশে।

উদীচী কানাডার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
উদীচী কানাডার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

নাসিরনগর থেকে গঙ্গাচড়া, তনু হত্যা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রায় আক্রমণ, নারীর সম্ভ্রমহানি, পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ প্রতিটি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে, এই কানাডাতেও সর্বস্তরের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে চেতনাকে শাণিত করেছে গণমানুষের এই সংগঠন; হয়েছে সোচ্চার।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ একটি অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, মৌলবাদ মুক্ত সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন মননে ধারণ করে, শিল্পী-কর্মীরা, গান, কবিতা, নৃত্য, চারুকলা ও চলচ্চিত্রসহ সংস্কৃতির বিভিন্ন মাধ্যমে আবহমান বাংলার ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে উদীচী এই দূর পরবাসে।

৫১ বছরে পা দেওয়া দীপ্ত পথ চলার সংগ্রামের ইতিহাস, গৌরবের অংশীদার, সমাজের প্রতি অঙ্গীকার থেকে, আমরা গড়বই সুন্দর আগামী; সকল অন্ধকার ঠেলে। এই প্রত্যয় নিয়ে সাজানো মঞ্চে, উদীচী শিল্পগোষ্ঠী কানাডা শাখার সম্মেলন ও সাংস্কৃতিক পর্বে তাদের দলীয় পরিবেশনায় অভিজ্ঞতার পারিপাট্য বজায় রেখেছে। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের কণ্ঠযোদ্ধা, কিংবদন্তি শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়ের গানে উত্তাপ ছড়িয়েছে সংগ্রামী শ্রোতাদের মাঝে। এই উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে।

আঁধারবৃন্তে আগুন জ্বলুক, আগুন জ্বলুক গানের সুরে ও কবিতায়, আগুন জ্বলুক প্রতিবাদের ভাষায়। অন্যায় যেখানে নিয়ম প্রতিরোধ সেখানে কর্তব্য। মানব মুক্তির যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৬৮ সালে, সেই দর্শন থেকে সামান্য বিচ্যুত না হয়ে, দুঃসাহসের ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেওয়া উদীচী, ভবিষ্যতে গণমানুষের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সম্মুখ সমরে সংশপ্তকের মতো অবিচল থেকে দেখাবে মুক্তির পথ।

উদীচী কানাডার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে লেখক
উদীচী কানাডার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে লেখক

শোষণ থেকে মুক্তি, অশিক্ষা থেকে মুক্তি, দারিদ্র্য থেকে মুক্তি, সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্তি, এই প্রত্যাশার আলো জ্বলে থাকুক শিখা চিরন্তনী হয়ে উদীচীর হাতে।
...

হিমাদ্রী রয় সঞ্জীব: লেখক, সংগঠক ও সাংস্কৃতিক কর্মী। টরন্টো, কানাডা।