আনন্দে উজ্জ্বল এক আনন্দমেলা

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব নিউজার্সির কর্মকর্তাদের সঙ্গে লেখিকা
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব নিউজার্সির কর্মকর্তাদের সঙ্গে লেখিকা

প্রবাসে আমরা সবাই কমবেশি ব্যস্ত থাকি। এই ব্যস্ততার ভিড়ে সুযোগ পেলে সবাই আনন্দে মেতে ওঠার চেষ্টা করি। আর কোনো অনুষ্ঠান হলে তো সেটা আরও বেশি উপভোগ করি। গত শনিবার (১০ নভেম্বর) বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব নিউজার্সি আয়োজন করেছিল আনন্দমেলার।

চমৎকার আয়োজনে সবাই যেন প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিচ্ছিলেন। যান্ত্রিক জীবনে এ যেন শান্তির পরশ বুলিয়ে যাওয়া। সবাই সবার মতো করে উপভোগ করছেন। দেখা হয়েছিল পরিচিত অনেকের সঙ্গে। বিশেষ করে আজিজা হক রুমি আপার কথা না বললেই নয়। জড়িয়ে ধরে ভালোবাসার জানান দিয়েছিলেন। পাশ থেকে আমার এক বন্ধু বলে ফারজানা, আপাকে জড়িয়ে ধরেছ ঠিক আছে, ভাইয়াদের ধরো না। বদনাম হয়ে যাবে। সে কী হাসির রোল।

শিল্পী রিজিয়া পারভিন, লেখিকা ও বাদশা বুলবুল
শিল্পী রিজিয়া পারভিন, লেখিকা ও বাদশা বুলবুল

দীর্ঘদিন পর দেখা হলো ডুরিন ভাবির মায়ের সঙ্গে। ডুরিন ভাবি যার বাসায় আমি প্রথম গিয়েছিলাম আমেরিকা আসার পর। ভাবি আমাকে অনেক ভালোবাসতেন। ভাবি ক্যানসারে মারা গেছেন বহু বছর আগে। ভালোবাসার মানুষগুলো হয়তো হারিয়ে যায় কিন্তু ভালোবাসাটা ঠিকই থেকে যায়। খালাম্মাকে কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতেই বললেন, এই আর থাকা। তাই তো। একজন সন্তানহারা মা আর কেমন থাকেন। কেন যে বোকার মতো প্রশ্ন করতে গেলাম! নিজেই নিজেকে বললাম, দূর এই কথাটা বলা ঠিক হয়নি।

এমন সময় দেখলাম সংগীত শিল্পী রিজিয়া পারভিন এসেছেন। তাকে স্বাগত জানানো হচ্ছে। সেদিকে অনেকে যাচ্ছেন। রুমি আপা বললেন, ফারজানা যাও দেখা করে এসো। একটু পর অনুষ্ঠান শুরু হলে ব্যস্ত হয়ে যাবে। আমি গেলাম রিজিয়া পারভিনের কাছে। এই প্রথম তাঁকে সরাসরি দেখা আমার। বেশ সুন্দর ও পরিপাটি। চমৎকার ও সুন্দর করে কথা বলেন। কিছু ছবিও তুললাম।

সেখান থেকে গেলাম খাবারের টেবিলের কাছে। কফি, সমুচা, শিঙারা সব ছিল। শিঙারা এক পিস দুই ডলার করে। আমার স্বামী বলল, বেশি করে নিয়ে নাও। পরিচিত যারা আছে তাদেরও দিতে পারবে। এমন সময় দেখা হলো ফারুক আজম ভাইয়ের সঙ্গে। যিনি আনন্দমেলা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছেন। আরও অনেকে ছিলেন সেখানে। ছবি তোলা, ফান করা, একজন বললেন, আরে আপা এখানে কী করেন? আপনাদের ভিড় থাকবে গয়না–শাড়ির দোকানের সামনে। পাশ থেকে আরেকজন বললেন, ভাই, মনে করিয়ে দিয়েন না, আপাদের কী! পকেট তো খালি হয় হাজব্যান্ডদের।

চমৎকার শাড়ি, গয়না টেবিলে সাজিয়ে বসেছিল অনেকে। দাম খারাপ না। সবাই দেখছিল। কেউ কিনছিল।

আনন্দমেলার উপস্থাপক ফারুক আজম, লেখিকা ও তার স্বামী
আনন্দমেলার উপস্থাপক ফারুক আজম, লেখিকা ও তার স্বামী

এমন সময় শুনতে পাচ্ছিলাম বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। তার মানে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। আমার মেয়ে আফসানা এসে বলে মম, এখানে কী করছ? পাপা তোমাকে খুঁজছে। চল প্রোগ্রাম দেখবে। চলে এলাম প্রোগ্রাম দেখতে।

অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল জাতীয় সংগীত দিয়ে। অনুষ্ঠানে বাচ্চাদের পরিবেশনা ছিল দেখার মতো। মনোযোগ অন্য কোথাও সরানোর সুযোগ ছিল না। ভায়োলিন বাজিয়েছিল ছোট বাচ্চা মেয়ে রাইয়া মালিক। সে বাজিয়েছিল ‘পুরোনো সেই দিনের কথা’। তার বয়স পাঁচ কী ছয় হবে। জেরিন গেয়েছিল গ্রামের নওজোয়ান, হিন্দু মুসলমান। দুই বোন ফাইরোজ কবির ও জয়নব কবির করেছিল ক্ল্যাসিক্যাল ভরতনাট্যম। নোরা করেছিল ক্ল্যাসিক্যাল ড্যান্স। লামিয়া তার নিজের ইংরেজি কবিতা শুনিয়েছিল। আমিরা আলী ড্যান্স করেছিল। জয়া ও অম্রিন গান করেছে। সাদী পিয়ানো বাজিয়েছে ‘পুরোনো সেই দিনের কথা’। আরও অনেক বাচ্চারা ছিল। আসলে কার কথা রেখে কার কথা বলব। এত ছোট ছোট বাচ্চারা চমৎকার করে পারফরমেন্স করছিল যে মুগ্ধ হয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম অন্য এক জগতে।

এরপর ব্রেক ছিল কিছু সময়ের জন্য। ক্ষুধাও পেয়েছিল। তখন রাত প্রায় দশটার মতো। ডিনার করার কী আছে খোঁজ নিলাম। চিকেন বিরিয়ানি, বিফ বিরিয়ানি ছিল। প্রতি বক্স আট ডলার করে। খেতে গিয়ে দেখলাম সংগীত শিল্পী বাদশা বুলবুলও এসেছেন। তিনি শুধু কফি নিলেন। ভদ্র ও মার্জিত চমৎকার মানুষ। কথা বললাম কিছুক্ষণ। সেলফিও তুললাম।

আসলে অন্য রকম একটা সময় পার করছিলাম। ঘড়ির কাটার সঙ্গে চলা যান্ত্রিক জীবনে এ রকম অনুষ্ঠানগুলো অনেক ভালো লাগার ও ভালোবাসার। আমার স্বামী ও মেয়েও উপভোগ করছিল। ব্রেকের পর আবারও ফিরে গেলাম অনুষ্ঠানে।

জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী রিজিয়া পারভিন ও বাদশা বুলবুল এলেন এ পর্বে। তাদের গানের দোলায় যেন আমরা দুলছিলাম। দেশের গান ‘আমায় যদি প্রশ্ন করে’ দিয়েই পারভিন আপা শুরু করেছিলেন তার চমৎকার পরিবেশনা। তারপর একে একে গেয়েছিলেন তার পছন্দের গান, দর্শকের অনুরোধের গান। স্মরণ করলেন আইয়ুব বাচ্চু ভাইকে। আমরা আটকে ছিলাম তার কণ্ঠের জাদুতে। মাঝে মাঝে দর্শক সারিতে তিনি নেমে এসেছিলেন তাদের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য।

লেখিকা, ফোবানার চেয়ারম্যান মীর চৌধুরী ও শিল্পী রিজিয়া পারভিন
লেখিকা, ফোবানার চেয়ারম্যান মীর চৌধুরী ও শিল্পী রিজিয়া পারভিন

গানের মাঝখানে দুই মিনিট ব্রেক নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে আগত ফোবানার সম্মানিত কর্মকর্তারা সবাইকে আমন্ত্রণ জানালেন ২০১৯ সালে নিউইয়র্কে ফোবানা অনুষ্ঠানে সবাই যেন যোগ দেন। বক্তব্য দিলেন ফোবানার চেয়ারম্যান মীর চৌধুরী, জাকারিয়া চৌধুরী (এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি) আবীর আলমগীর, বাবু ভাই, মামুন ভাই ও গোলাম ফারুক ভাই।

এরপর মঞ্চে এলেন বাদশা বুলবুল। একজন শান্ত ও মার্জিত মানুষ বলা চলে। এই প্রথম তিনি এসেছেন নিউজার্সিতে। তিনিও দেশের গান ‘যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে’ দিয়ে পরিবেশনা শুরু করেন। তার সুরের জাদুতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন শ্রোতা–দর্শক। তখন প্রায় মধ্য রাত। কারও যেন কোনো তাড়া নেই যাওয়ার অথচ অনেকের পরদিন সকালেই অফিস বা কাজ। তাদের গানের পরিবেশনা সবাই এতটাই উপভোগ করছিলেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সময় দৌড়াচ্ছে মধ্য রাতে।

আসতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু উপায় নেই, পরদিন সকালে অফিস। এটাই বাস্তবতা। বিদায় নিলাম সবার কাছ থেকে। বাইরে বের হয়ে দেখি অসম্ভব ঠান্ডা। চারপাশ কেমন সুনসান নীরবতা। গাড়ি চলছে সাই সাই করে। আমার মেয়ে আফসানা ঘুমিয়ে গেছে। আমার স্বামী গাড়ি ড্রাইভ করছে আর তখনো আমার কানে বাজছে সেই গান—‘যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তিসেনা’। গুন গুন করে গাইছিলাম। বাসায় যখন পৌঁছালাম তখন রাত প্রায় একটা বিশ মিনিট। পরদিন থেকে আবার যান্ত্রিক জীবনের রুটিন করে চলা এই ভাবনা নিয়ে ঘুমাতে গেলাম।