তরুণ প্রজন্ম ও শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তবতা

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশে এক দশক ধরে শিক্ষাব্যবস্থা ও তরুণ প্রজন্ম সবচেয়ে আলোচিত এক বিষয়। নানা কারণে আলোচিত হলেও অনিয়ম, দুর্নীতি, প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ভর্তি জালিয়াতিসহ নানাবিদ কারণে আলোচিত হওয়ার থেকে সমালোচিত বেশি। চাকরির অনিশ্চয়তা, নিয়োগে ঘুষ–বাণিজ্য, বয়স সময়সীমার ফাঁদ ও কোটা সংস্কার আন্দোলনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ দেখা গেছে।

স্বাধীনতা-উত্তর যেকোনো সময়ের তুলনায় আজকের তরুণ প্রজন্ম অনেক বেশি সক্রিয়, উদ্যমী ও প্রতিবাদমুখর। তারা নিজেদের স্বাবলম্বী করতে চায়, দেশের উন্নয়ন, বিশ্বমঞ্চে দেশকে উচ্চপর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় অবদান রাখতে চায়। অমসৃণ এই চলার পথে তারা সাহস হারায় না, পরাজয় মেনে নেয় না, কারও কাছে মাথা নোয়ায় না। কিন্তু এই পথকে মসৃণ করে দেওয়ার দায়িত্ব যাদের কাছে, যাদের একটু সচেতনতা পারে গোটা প্রজন্মকে আলোর পথ দেখাতে, তারা আজ প্রশ্নবিদ্ধ, তাদের উদাসীনতা, অসচেতনতা, দায়িত্বহীনতা আলোর পথে আজ বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গোটা প্রজন্মের সফলতার যাত্রায়।

পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্ন যখন ফাঁস হয় তখন বোঝার বাকি থাকে না এর জন্য কারা দায়ী। এর দায়ভার শিক্ষার্থীর অভিভাবক কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারবেন না। এসএসসি ও এইচএসসি প্রশ্নপত্র ফাঁসে যখন লাখ-লাখ টাকার লেনদেন হয় এর দায়ভারও শিক্ষার্থীর অভিভাবক এড়িয়ে যেতে পারবেন না। কারণ এই বিশাল অর্থের জোগানদাতা এই অভিভাবকই। শিক্ষামন্ত্রী ও প্রশাসন, তাদের ওপরও এর দায় বর্তায়। প্রশাসন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় যখন একটা নির্দিষ্ট সময়ের আগে পরীক্ষার হলে উপস্থিত হওয়ার কথা বলল, তখনো প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় এবং তা কিছু লোভী শিক্ষকের মাধ্যমে। এখন প্রশ্ন হলো, এ রকম পরিবেশে বছরের পর বছর শিক্ষা নেওয়ার পর একজন শিক্ষার্থীর মনে শিক্ষা-ব্যবস্থার প্রতি কতটুকু শ্রদ্ধা ও দায়িত্ববোধ থাকবে? কর্মজীবনে তাদের চিন্তা-চেতনায় কতটুকু সৎ থাকার ইচ্ছে বেঁচে থাকবে? নৈতিকতা ও মূল্যবোধ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, এর দায়ভার কার? এই কোমলমতি শিক্ষার্থীর? নাকি অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের?

বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে যেতে না যেতেই পড়তে হয় রাজনীতি আর শিক্ষকদের দলাদলির নির্মম অত্যাচার। শিক্ষকেরা ব্যস্ত থাকেন লাল, নীল ও সাদা দল নিয়ে আর শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হয় তাদের প্রাপ্য শিক্ষা থেকে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন সান্ধ্যকালীন কোর্স বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যয়বহুল হয়ে গেছে। সরকারি বাজেটে চালিত একটি বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে সরকারি–বেসরকারি দুই সমন্বয়ে চলে তা বোধগম্য না। শিক্ষকেরা টাকার লোভে সান্ধ্যকালীন কোর্সগুলোতে ব্যস্ত থাকেন। এই অভিযোগ এতই পুরোনো যে, এখন আর কেউ আমলে নেয় না। গা সয়ে গেছে সবার।

এ ছাড়া, এই শিক্ষকদের একটা বিশাল অংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে জড়িত। বাংলাদেশের এমন কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নেই যেখানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেই। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো পড়াশোনা হয় না। শিক্ষার মান নেই ও টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট বিক্রি হয়। অথচ তারা ভুলে যান টাকার কাছে তারাও বিক্রি হয়েছেন, স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায়।

বাংলাদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। ক্লাসে কেউ অন্যমনস্ক হলে তিনি প্রায়ই বলতেন, এত টাকা দিচ্ছ, কিছু না শিখলেও ডিগ্রিটা নিয়ে যাও। তাই বলে সবাই তো এমন না। এখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেভাবে প্রাপ্য শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত টাকার বিনিময়ে ডিগ্রি নেওয়ার কালিমাতে জর্জরিত হচ্ছে এই দায়ভার কার? শিক্ষার্থীদের? নাকি শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের না বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের?

আমার বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক আলাপচারিতায় প্রায়ই বলেন, শিক্ষার্থীরা কম শিখছে। এর দায়ভার সম্পূর্ণ শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের। শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই দায়ী না। অথচ আমাদের দেশে দিন শেষে সবাই শিক্ষার্থীদের ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত। কেউ নিজের দায়িত্বে এতটুকু গাফিলতি স্বীকার করেন না। নিজের অনৈতিকতা ও দায়িত্ববোধের জবাবদিহির আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের কাছেও করেন না।

অল্প কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের কাছে পুরো জাতি মাথা করবে না, করতে পারে না। দুর্ভাগ্যের এই কালিমা একদিন সব মুছে যাবে। আমাদের তরুণ প্রজন্মের গায়ে কোনো কালিমা লাগবে না। বিশ্ব-দরবারে বাংলাদেশি মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, এই প্রত্যাশা আমাদের সবার।
...

উজ্জ্বল দত্ত: গবেষক, ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>