সবুজ মেঘের ছায়া-চৌদ্দ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

জুঁই ঠিক বারোটার দিকে দোকানে এলেও নাবিদের দোকান থেকে বের হতে হতে একটা বেজে গেল। বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় দেড়টা। বাসায় ফিরে উৎকট পচা গন্ধে তার থাকাই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গাড়ি নিয়ে বাসায় ঢুকতে ঢুকতেই সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে, উৎকট গন্ধটা মিসেস এলিরা স্মিথের বাসা থেকেই আসছে।

বাসায় ঢুকে নাবিদ ঘরের বন্ধ দরজা-জানালা না খুলে বন্ধ রেখেই চুপচাপ বসে রইল। কিন্তু বাসার দরজা-জানালা বন্ধ হলে কী হবে, বাইরের গন্ধটা কিছুতেই রোধ করা যাচ্ছে না। এমনকি এই শীতের দিনে নাক বরাবর টেবিল ফ্যানটা চালু করে পচা গন্ধ আটকাতে পারছে না।

নাবিদের মৃত মানুষের পচা দুর্গন্ধ সম্বন্ধে ধারণা নেই। তবে তার মানুষ পোড়া গন্ধ সম্বন্ধে ভালোই ধারণা আছে। বাংলাদেশে তাদের গ্রামের বাড়ির পাশে তিতাস নদীর পাড়ে হিন্দুদের কয়েক ঘর বসতি ছিল। সাহা বাড়ি। তাদের বাড়ির সঙ্গে সাহাবাড়ির সীমানা ভাগ করা ছিল একটা খাল দিয়ে। খালটার নাম বুইদ্দার খাল। একটা শ্মশান ঘাট ছিল বুইদ্দার খালের মুখে তিতাসের পাড়ে। সেই শ্মশানঘাটে হিন্দু ঘরের কেউ মরলে তাদের পোড়া দেওয়া হতো।

তবে মানুষ পোড়া গন্ধ আর মৃত মানুষের পচা গন্ধ এক নয়। মানুষ পোড়া গন্ধ কাছে দাঁড়িয়েও শোঁকা যায়। কিন্তু মানুষ পচা গন্ধ...!

দুর্গন্ধটা যেন ক্রমাগত বাড়ছেই। শীতের উত্তরের বাতাসের সঙ্গে দুর্গন্ধটা মিশে গিয়ে চারপাশের পরিবেশটাকে আরও দুর্গন্ধময় করে তুলছে। দরজা-জানালা বন্ধ করেও ঘরের ভেতর থাকা যাচ্ছে না। একটা বিড়াল বা অন্য কোনো মৃত প্রাণির পচা গন্ধ তো এমন হওয়ার কথা নয়। তাহলে?

নাবিদ নিজে নিজে মাথা ঝাঁকাল। তাহলে কী সত্যি এলিরা স্মিথ ঘরের ভেতর মরে পচে আছেন? ভাবতেই তার শরীরটা কাঁটা দিয়ে উঠল। নাহ, এমনটা যেন না হয়! পচা গন্ধটা অন্য কিছুরও হতে পারে। এলিরা স্মিথের গলায় তো লকেটের মতো একটা মেডিকেল ইমার্জেন্সি সিকিউরিটি বাটন আছে। সাদার মধ্যে লাল একটা বাটন। চেনটা মোটা গোল্ড প্লেটেড। হঠাৎ কোথাও তিনি পড়ে গেলে বা কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি যদি বাটন টেপেন। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতাল ও সেন্ট জোন্স অ্যাম্বুলেন্সের কন্ট্রোল রুমের কম্পিউটারে নাম ও ঠিকানা দেখিয়ে অ্যালার্ম বাজতে শুরু করবে। বাসায় অ্যাম্বুলেন্স চলে আসবে পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই, টো টো টো টো শব্দ করে।

নাবিদ লাউঞ্জের সোফায় স্থাণু হয়ে বসে টিভির দিকে তাকাল। টিভিটা বন্ধ। রিমোট তার পাশেই। রিমোটটা সে হাতে নিল, কিন্তু সে টিভি চালু করল না।

নাবিদ বেশ কিছুক্ষণ স্থাণু হয়ে বসে থেকে উঠে দাঁড়াল। দরজা-জানালা বন্ধ হলেও ওগুলোর পর্দা সরানো। সে জানালার কাচ গলে বাইরে তাকাল। জানালা থেকে এলিরা স্মিথের বাসার সামনের অনেকটা অংশ দেখা যায়।

এলিরা স্মিথের বাসাটা যেন একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার কুকুরটার কোনো ঘেউ ঘেউ ডাক আর আসছে না। কাল রাতে অবশ্য এলিরা স্মিথের বাসার বাতি জ্বলতে দেখেছে। গত পরশুদিনও বাসার বাতি জ্বলেছে।

নাবিদ ভাবল, হয়তো এলিরা স্মিথের বাসার বাতিটা জ্বালানোই ছিল। দিনের বেলায় তো আর দরজা-জানালা বন্ধ থাকলে বাসার বাতি জ্বালানো বোঝা যায় না।

এলিরা স্মিথকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে নাবিদের হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা, এলিরা স্মিথকে একবার রিং করলে কেমন হয়। তার মোবাইলে অথবা ল্যান্ড নম্বরে?

নাবিদের মোবাইলটা পকেটেই। সে মোবাইলটা বের করে এলিরা স্মিথের মোবাইলে ফোন দিল। গতকালের মতো আজও তার মোবাইলে সরাসরি মেসেজে চলে যাচ্ছে।

নাবিদ কোনো মেসেজ না রেখে এলিরা স্মিথের ল্যান্ড নম্বরে ফোন দিল। গতকালও সে এলিরা স্মিথের ল্যান্ড নম্বরে একবার ফোন দিয়েছিল। গতকালের মতো আজও টো-ও-ত, টো-ও-ত, টো-ও-ত করে রিং বাজতে বাজতে মেসেজে চলে গেল। নাবিদ ল্যান্ড নম্বরেও কোনো মেসেজ রাখল না।

নাবিদ মোবাইলটা পাশে রেখে এদিকওদিক তাকাল। এমনিই। সে এবার সিদ্ধান্ত নিল, সরাসরি এলিরা স্মিথের দরজায় গিয়ে কড়া নাড়বে বা কলিং বেল চাপবে।

ভাবতে ভাবতেই নাবিদ উঠে দাঁড়াল। মুহূর্ত দেরি না করে সে দরজা খুলল। দরজা খুলতেই দুর্গন্ধের তীব্রতা তার নাকে এসে আছড়ে পড়ল। সে নাকমুখ চেপে এলিরা স্মিথের বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করল। একটা কাঠের বেড়ার এপাশ-ওপাশ বাড়ি হলেও এলিরা স্মিথের বাসার সদর দরজায় যেতে একটু ঘুরে যেতে হয়।

এলিরা স্মিথের বাসার সবচেয়ে কাছের বাসা হলো নাবিদের বাসা। পেছনে ঝরনা ও পার্ক। সামনে মিস্টার গ্রাহামের বাসা হলেও তা বেশ খানিকটা দূরে।

নাবিদ নাক-মুখ চেপে ধরে তার বাসার গেট পেরিয়ে এলিরা স্মিথের বাসার কলিং বেল টিপল। একবার, দুবার, তিনবার। সে এলিরা স্মিথের বাসার ভেতরের কলিং বেল বাজার শব্দ শুনতে পেল, টুইট টুইট, টুইট টুইট, টুইট টুইট। শব্দটা বেশ ত্বরিত ও ঝাঁজাল। কিন্তু এলিরা স্মিথের বাসার ভেতর থেকে কোনো সাড়া-শব্দ নেই। এমনকি কুকুরটাও ডাকছে না।

দুর্গন্ধের তীব্রতা যে এলিরা স্মিথের বাসা থেকেই আসছে এটা নাবিদ পুরোপুরি নিশ্চিত হলো। সে উপায়ান্ত না দেখে আবার বাসায় ফিরে এল। দরজা বন্ধ করে তার লাউঞ্জের সোফায় বসে তার প্রথমই মনে হলো, পুলিশকে ফোন করা দরকার। সে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে পুলিশকে ফোন করল।

পুলিশ এল প্রায় দুই ঘণ্টা পর। নিউজিল্যান্ডে কেউ কোনো পুলিশ স্টেশনে ফোন করলে ওরা ঘটনার গুরুত্ব যাচাই করে সময় নির্ধারণ করে। মারাত্মক কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ওরা পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। আবার কোনো ঘটনা তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হলে ওরা দু-চার-পাঁচ ঘণ্টা বা কখনো পুরো একদিন পর আসে। যেহেতু এলিরা স্মিথের ব্যাপারটা পরিষ্কার নয়, তাই ওরা দুই ঘণ্টা সময় নিয়েছে।

এরই মধ্যে নাবিদকে নাকমুখ চেপে বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে মৌনতাকে গ্লেন ভিউ প্রাইমারি স্কুল থেকে তুলে আনতে গিয়েছিল। বাসায় ফিরতে না ফিরতে সে এলিরা স্মিথের ড্রাইভওয়েতে পুলিশের একটা গাড়ি আসতে দেখল।

নাবিদ গাড়িটা গ্যারেজে পার্ক করে বাসার ভেতর না ঢুকেই পুলিশের গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল। মৌনতাও তাকে অনুসরণ করল।

দুর্গন্ধের তীব্রতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছেই। দুর্গন্ধটা যে মিসেস স্মিথের বাসা থেকেই আসছে, এখন এতে আর কোনো সন্দেহ নেই। হয়তো কুকুরটা মরে পচে ফুলে উঠেছে। নয়তো মিসেস এলিরা স্মিথ নিজে। তবে কুকুরটা মরলে এত তাড়াতাড়ি পচে দুর্গন্ধ ছড়ানোর কথা নয়। গতকাল বিকেলেও নাবিদ ডেকে বসে কুকুরটার ডাক শুনেছে।

নাবিদ এগিয়ে আসতে দেখে পুলিশ অফিসার দুজনও নাকমুখ চেপে গাড়ি থেকে নামলেন। ওদের একজন পুরুষ পুলিশ অফিসার ও অন্যজন নারী পুলিশ অফিসার।

নাবিদ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, অফিসার, আমি ফোন দিয়েছিলাম।

পুরুষ পুলিশ অফিসার মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ও, আচ্ছা...।

যদিও নাবিদ পুলিশ স্টেশনে বিস্তারিত বলে রেখেছে, তারপরও নারী পুলিশ অফিসারকে বাসাটা পরখ করতে বলে পুরুষ পুলিশ অফিসারটা নাবিদকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। কিছু প্রাসঙ্গিক, কিছু অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। সবগুলোই পুরুষ পুলিশ অফিসার একটা ডায়েরিতে খসখস করে লিখে রাখলেন।

ওদিকে নারী পুলিশ অফিসার মিসেস স্মিথের বাসার সামনের দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। কয়েকবার কলিং বেল টিপলেন। দুই-তিনবার দরজায়ও নক করলেন। জোরে জোরে ডাকলেন, হ্যালো, হ্যালো, এনি বডি হোম, হ্যালো...!

কুকুরটা তখনই বাসার ভেতর থেকে একটা শব্দ করে উঠল, কেঁ-উঁ-উঁ!...

নারী পুলিশ অফিসারটা কী মনে করে মিসেস স্মিথের বাসার পেছনের দিকে গেলেন। কয়েক মুহূর্ত পর ফিরে এসে পুরুষ পুলিশ অফিসারটাকে বললেন, স্যার, দুর্গন্ধটা বাসার ভেতর থেকেই আসছে। কিন্তু দরজা-জানালা সব বন্ধ। সবগুলোতে পর্দা টানানো বলে বাইরে থেকে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। দরজা খোলার ব্যবস্থা করলে ভালো হয়।

পুরুষ পুলিশ অফিসারটা বললেন, আপনি কন্ট্রোল রুমে ফোন দিন। একজন লকস্মিথ পাঠাতে বলুন।

নারী অফিসারটা বললেন, জি স্যার।

লকস্মিথ আধা ঘণ্টার মধ্যেই চলে এল। একটা অল্পবয়সী ছেলে। মিসেস এলিরা স্মিথের বাসার দরজা খুলতে তার পাঁচ মিনিটও লাগল না।

নারী পুলিশ অফিসারটা মিসেস স্মিথের বাসার ভেতরে ঢোকার জন্য এগিয়ে গেলেন। পুরুষ পুলিশ অফিসার, নাবিদ ও মৌনতা পেছনে পেছনে গেল।

নারী পুলিশ অফিসারটা বাসার ভেতর পা দিতেই এলিরা স্মিথের কুকুরটা বেশ জোরে শব্দ করে উঠল, কেঁ-উঁ-উঁ-উঁ, ভক ভক, ভক ভক!

নারী পুলিশ অফিসারটা বলে উঠল, ও মাই গড! (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: