হঠাৎ স্বর্ণকেশী!-নয়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

গ্রহের চারপাশে হন্যে হয়ে ঘোরা উপগ্রহের মতো সেই তখন থেকে রাজবাড়ির মতো দেখতে এই হাসপাতালের চারদিকে অর্থহীন ঘুরপাক খাচ্ছি। কিন্তু চাইলেও চলে যেতে পারছি না। পা বাড়াতেই গেলেই কীসের এক অদৃশ্য সুতার টানে বারবার ফিরে আসছি। ফিরে এসে আবার বসেছি বিশাল করিডরে রাখা বেঞ্চটায়। না, ঠিক বসে নেই; বেঞ্চে শুয়ে আছি। হাতের ওপর মাথা রাখা। রাত বাজে সাড়ে এগারোটা। দেয়ালে টানানো বিশাল ঘড়িটার সেকেন্ডের কাঁটার টিক টিক বড্ড কানে বাজছে। ধু ধু ফাঁকা করিডর আর খোলা জানালার বাইরে নক্ষত্রের রাত। শার্টে এখনো লতার রক্ত। আজকে রাতে ঘুম নেই। রাশিয়ান ফ্ল্যাটমেট ভ্লাদিমিরকে ফোনে জানিয়ে দিয়েছি আজকে ফিরছি না। অবাক হয়েছে ছেলেটা, কিন্তু কিছু আর জানতে চায়নি গায়ে পড়ে।

লতার বিপদ একরকম কেটে গেছে। খুব সংক্ষেপে খবরটা বিকেলেই বলা হয়েছে। তবু আইসিইউতে পড়ে থাকা মেয়েটার এই হালের জন্য কিছুতেই নিজেকে ক্ষমা করা যাচ্ছে না। পুরো ঘটনাটার জন্য নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে। লতা নামের এই মেয়ের সঙ্গে আজকে আমার দেখা না হলে কী আসত যেত? যে যার কাজ সেরে নির্ঝঞ্ঝাট বাড়ি চলে গেলে তো এমনটা হতো না। কফি খেতে গিয়ে এত দেরিই বা করলাম কেন? লতাকে আগে ছেড়ে দিলে তো কুকুরটার দৌড়ে এসে ধাক্কা দেওয়া থেকে বেঁচে যেত। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এসবই ভাবছি খালি।

ডক্টর ক্লাউডিয়াকে এগিয়ে আসতে দেখে এক ঝটকায় সোজা হয়ে বসলাম। বসা থেকে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালাম। ‘অনীক, ঘুমাচ্ছ নাকি? ভালো খবর আছে। মাথার চোটটা অল্পের ওপর দিয়ে গেছে বলতে হবে। আমরা তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। গোটা দশেক সেলাই দিতে হয়েছে অবশ্য। তবে পা সারতে বেশি সময় লাগবে, ভাঙা পায়ে আবার আঘাত, বোঝই তো।’ বলেই ডক্টর ক্লাউডিয়া খুব উৎসুক চোখে তাকালেন প্রতিক্রিয়া বোঝার আশায়। ‘ওহ, আচ্ছা’। মুখচোরা আমি এ ছাড়া আর কিছুই বলতে পারলাম না সেই মুহূর্তে। শুধু মনে হলো যেন বুক থেকে পাথর সরে গেছে। আবার যেন ঠিকঠাক মতো শ্বাস নিতে পারছি। খানিকটা ইতস্তত করে ক্লাউডিয়া ডাক্তার আপা হতাশ হয়ে ফিরে গেলেন।

এই একবেলায় ফ্রাউয়েন ক্লিনিক মাইষ্ট্রাসে নামের এই হাসপাতালের অর্ধেক ডাক্তার-নার্সদের নাম মুখস্থ হয়ে গেছে। সবাই নিজে যেচে এসে খুব কৌতূহল নিয়ে কথা বলেছেন আমার সঙ্গে। আমি কে, কী, কোথা থেকে, কেমন করে ইত্যাদি। কারণ, লতা কাকতালীয়ভাবে এই হাসপাতালের রেসিডেন্ট ডাক্তার। এর আগে তারা লতার কোনো বন্ধু-বান্ধবের হদিস পায়নি। তাই আজকের এই দুর্ঘটনার পর সবেধন নীলমণি আমাকে দেখে কৌতূহল আর ধরছে না এদের। ‘রেসিডেন্ট’ নামকরণের সার্থকতা প্রকাশের জন্য লতা নাকি দিন কী রাত এই হাসপাতালেই পড়ে থাকত। বাড়িটাড়ি যাওয়ার বিশেষ তাড়া তার কখনই ছিল না। তাই বন্ধু-বান্ধব হবে কোথা দিয়ে? অন্তত কার্ডিয়াক ওয়ার্ডের নার্স ফ্রাউ আনার অভিযোগ শুনে তো তাই মনে হলো।

কিন্তু এখন যে নার্স হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসছে, তাকে ঠিক চিনলাম না। খুব উত্তেজিত ভঙ্গিতে তিনি আমার দুই হাত পেতে কী যেন একটা গছিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘গ্রাতুল্যিয়েরে হের আখ্মেদ। অভিনন্দন, আহমেদ সাহেব। একদম বাপকা বেটা হয়েছে, যেমন রাজা, তেমন রাজপুত্তুর। খালি গালের টোলটা ছাড়া।’ কিছু বুঝে ওঠার আগেই নার্স উধাও। গছিয়ে দেওয়া বস্তুটি আরেকটু হলে হাত গলে পড়েই যেত। ভালো করে তাকিয়ে দেখি, ইয়া মাবুদ! এই গ্যাদা বাচ্চা আমার হাতে ধরিয়ে দেওয়ার মানে কী? নিশ্চয়ই কোথাও একটা ভুল হয়েছে। মরিয়া হয়ে চারপাশে কাউকে খুঁজলাম। কারও টিঁকিও দেখলাম না। তার বদলে চোখ পড়ল কোনার দেয়ালে টানানো ছোট্ট ব্ল্যাকবোর্ডটায়। লেখা ‘মোহাম্মদ এলফিকি/আহমেদ পরিবার, জন্ম: রাত এগারোটা চল্লিশ’। তার মানে ভুল আখ্মেদকে ভুল মোহাম্মদ ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া কাছে পিঠের কোনো সময় কোনো কর্ম বা অপকর্ম মনে পড়ছে না যার জন্য মাঝ রাতে এভাবে কর্মফল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কী ভালো যন্ত্রণায় পড়া গেল। আমি এখন কই যাই, কাকে ডাকি? জিন্দেগিতে কোনো দিন বাচ্চা কাচ্চা কোলে নেইনি। তার ওপরে প্রচুর হাত ঘামছে। বাচ্চারা বোধ হয় নার্ভাসনেস বুঝতে পারে। হাতের ভেতর মোহাম্মদ সাহেব গলা কাঁপিয়ে চিৎকার দেওয়া শুরু করল। আমি তার কম্পমান আলা-জিহ্বা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। ভয় হচ্ছে এখনই হাত গলে পড়ে যবে আর মাথা টাথা ফেটে বিতিকিচ্ছিরি একটা কাণ্ড ঘটবে। তাহলে নবজাতক গুম আর নির্যাতনের আগামী দশ বছর জার্মান জেলে বসে আলু সেদ্ধ আর ঘ্যাট জাতীয় স্যুপ খেয়ে কাটাতে হবে। আর লতা তত দিনে একটা মাঝবয়সী খিটখিটে, ক্ষ্যাপা পাগল ডাক্তার হয়ে এই হাসপাতালের অলিগলিতে দিনরাত ঘুরতে থাকবে।

খোদার কী দয়া। করিডরের নীরবতা ভেঙে চারিদিক আলো করে যে ব্যক্তিটা উদয় হলো, তাকে দেখে অন্য সময় আরেক দিকে হাঁটা দিতাম। কিন্তু এখন এই দুহাত জোড়া জাপানি হরফ, গোলাপ ফুল থেকে শুরু করে মেরিলিন মনরোর উলকি আঁকা, দুই কানে আধ ডজন দুল ঝোলানো লোকটাকে দেখে আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। কারণ, এই ভীম পালোয়ান গোছের লোকের চেহারাই ছোটে মোহাম্মদের মুখে কেটে বসানো। কোনোমতে কোল থেকে আলা-জিহ্বা সমেত চিজটা নামিয়ে ভীম বাবার হাতে ধরিয়ে চাবি দেওয়া কলের পুতুলের মতো আওড়ে গেলাম, ‘গ্রাতুল্যিয়েরে হের আখ্মেদ। আমি গাইনির ব্রাদার অনীক।’ তারপর চোঁ করে ছুটলাম সিঁড়ির দিকে। মানির মান আল্লাহ রাখে। বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। উফফ্!

সিঁড়ি ভেঙে হুড়মুড় করে নামতেই আবার ডক্টর ক্লাউডিয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমাকে দেখে মুখ উজ্জ্বল করে বলল, ‘অনীক, লতাকে কেবিনে পাঠিয়ে দিয়েছি আমরা। কড়া ডোজে ঘুমাচ্ছে বেচারা। তুমি কী একবার দেখতে চাও? কিন্তু দূর থেকে দেখতে হবে, ভেতরে যাওয়া বারণ। ভিজিটিং আওয়ার তো সন্ধ্যায়ই শেষ, তাই।’ লতাকে আজকেই দেখতে পাব, ভাবিনি। ভুল শুনছি কিনা ভাবলাম। একটা হৃৎস্পন্দন বোধ হয় ঠিকমতো পড়তে পারল না। তারপর কোনো উত্তর না দিয়ে অন্ধের মতো ডক্টর ক্লাউডিয়ার পিছু পিছু পৌঁছে গেলাম লতার কেবিনে।

দেখতে না আসলেই হয়তো ভালো হতো। কেবিনের সাদা বিছানায় লতার শুয়ে থাকার দৃশ্যটা নিতে পারলাম না। মাথায় অনেকগুলো সেলাই পড়েছে। ওরা সেলাই দেওয়ার জন্য বাম পাশের চুল কামিয়ে দিয়েছে। আর আরেক পাশে ঠিকই সোনালি চুলের ঘন মেঘ। ব্যান্ডেজ মোড়ানো ভাঙা পা উঁচু করে ঝোলানো। ছেলে হিসেবে আমি শক্ত স্নায়ুর নই। ঘাবড়ে গেলে হাত ঘামে, রক্ত দেখলে মাথা ঝিমঝিম করে ইত্যাদি ইত্যাদি। ঘুমন্ত লতাকে দেখে বুকের ভেতরটা মুচড়ে মুচড়ে আসতে লাগল। আজকে বৃষ্টির ভেতর রাস্তার ওপর লতাকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য অপেক্ষা করার সময়েও এত কষ্ট লাগেনি। একটা দীর্ঘশ্বাস অজান্তেই বেরিয়ে গেল পাঁজরের কোন ভেতর থেকে। ডক্টর ক্লাউডিয়াকে কোনো কিছু না বলে ফাঁকা করিডর ধরে আনমনা হাঁটতে শুরু করলাম।

বাসায় ফিরে যাব ভাবছি। কাল সকাল সকাল চলে আসব। এক তোড়া ফুল পেলে কী লতার ভালো লাগবে? মেয়েটার মন ভালো করা দরকার। অচেনা একটা রিংটোনের শব্দে ভাবনার সুতো কেটে গেল। পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখি লতার ফোন। রয়ে গিয়েছে আমার কাছে। স্ক্রিনে রাত বাজে প্রায় সাড়ে বারোটা। কেন যেন ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলল, খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে ওপাশে। অস্বস্তি লাগছে। ফোনটা কী ধরব? (চলবে)

ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: মিউনিখ, জার্মানি।

ধারাবাহিক এই উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: https://www.prothomalo.com/durporobash/article/1564308