নাবিদের দোকানে পাঁচটা পর্যন্ত থাকার কথা থাকলেও হাসপাতাল থেকে ফোন আসাতে নদী তিনটার সময়ই বের হয়ে গেল। প্রফেসর ড. নিকোলাস রজারসন এখনো হাসপাতালে। প্রফেসর রজারসন এবার মাইনর হার্ট অ্যাটাক নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও তাঁর ফুসফুসে পানি জমেছে বলে তাঁকে হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে। আর কত দিন তাঁকে হাসপাতালে থাকতে হবে, তিনি জানেন না।
নাবিদের দোকানের একেবারে সামনেই বাসস্টপ। নদী হাসপাতালের বাস ধরবে চিন্তা করলেও দোকান থেকে বের হয়ে বাস স্টপে এসে সে হ্যামিল্টন ইস্টের বাসটা ধরল। নদী আগে রাকিবের বাসায় যেতে চায়। আজ নাবিদের কথাগুলো তাকে খুব মন খারাপ করে দিয়েছে। যদিও শেষের দিকে নাবিদ দুই-তিনবার দুঃখ প্রকাশ করেছে।
বাস ছেড়ে দিতেই নদীর মনে হলো, আচ্ছা, সে যে হ্যামিল্টন ইস্টে যাচ্ছে, রাকিব ভাই বাসায় আছেন তো? কথাটা মনে হওয়া মাত্র নদী ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে রাকিবের মোবাইলে ফোন দিল। ওপাশে রাকিবের মোবাইল বাজছে তো বাজছেই। কিন্তু ধরছে না।
নদী ভাবল, এ তো ভালো লক্ষণ নয়? বাইরে কোথাও গেলেও ফোন তো অন্তত ধরবে? বাস ধরার আগেই তার একবার ফোন দেওয়া দরকার ছিল। অযথা এখন হ্যামিল্টন ইস্ট হয়ে ঘুরে যাওয়া? নদী আবার রাকিবের মোবাইলে ফোন দিল। এবারও একই অবস্থা। রিং বাজতে বাজতে মেসেজে চলে যাচ্ছে।
নদী বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ঝিম মেরে বসে রইল। রাস্তার দুই পাশের সারি সারি চিরহরিৎ গাছগুলো চলে যাচ্ছে, সাঁই সাঁই করে। আজ সকাল থেকে সারাক্ষণ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হলেও এখন আর বৃষ্টি হচ্ছে না। তবে আকাশ এখনো মেঘলা। সর্বত্র সাদা মেঘ বিছিয়ে রয়েছে।
নদীর হঠাৎ কেন জানি মনে হলো, রাকিব ভাই বাসাতেই আছেন। হয়তো মোবাইল সাইলেন্ট করে রেখেছেন। রাকিব ভাই মাঝেমধ্যেই এমনটা করেন। রাতে ঘুমানোর আগে মোবাইল সাইলেন্ট মুডে রেখে পরদিন মুড চেঞ্জ করতে ভুলে যান।
নদী এ সব ভাবতে ভাবতে রাকিবের বাসার ল্যান্ড নম্বরে ফোন দিল। এবার ফোন বাজতেই ওপাশে কেউ একজন ফোন ধরল। নদী বলল, থ্যাংকস গড। আপনি বাসায়?
ওপাশ ফোন ধরেছে আতিক, রাকিব নয়। তাই আতিক তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল, আপনি নিশ্চয়ই নদী?
নদী বলল, জি, আসলে আমি গলা ঠিকমতো না শুনেই মনে করেছি রাকিব ভাই ফোন ধরেছেন।
: না, আমি আতিক।
: আমি বুঝতে পেরেছি। আপনি ভালো আছেন?
: জি, ভালো আছি। রাকিব তো তার রুমে, এখন ঘুমাচ্ছে।
: আমি তার মোবাইলে ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু ধরছিলেন না। তাই ল্যান্ড নম্বরে ফোন দিয়েছি।
: আমি কি তাকে ডেকে দেব?
: না, থাক। আমি হ্যামিল্টন ইস্টেই আসছি। তিনি কখন ঘুমিয়েছেন?
: দুই-তিন ঘণ্টা তো হয়ে গেছে। আমরা একসঙ্গেই দুপুরের লাঞ্চ করলাম। লাঞ্চ করার পর রাকিব বলল, তার নাকি শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। তারপর সে রুমে চলে গেছে।
: শরীর ম্যাজম্যাজ করছে! শরীর খারাপ করেনি তো?
: শরীর খারাপ করারই কথা। আজ সকালে নয়টা-দশটার দিকে ব্যালকনিতে যেভাবে বৃষ্টিতে ভিজেছে?
: এই ঠান্ডার মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজেছেন, কেন?
: আমি জানব কীভাবে? সে কবি মানুষ। আর সেটা তো আপনার ভালো বোঝার কথা।
নদী ফোনের এপাশে কোনো কারণ ছাড়াই মাথা ঝাঁকিয়ে এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল। আতিকের কথার মানেটা সে বুঝতে পারছে না, তা নয়। ভালো করেই বুঝতে পারছে। সে বলল, আচ্ছা, আতিক ভাই, আমি ফোন রাখি। আমি আপনাদের বাসাতেই আসছি।
আতিক বলল, আচ্ছা, আসুন। আমি দেখি রাকিবকে ঘুম থেকে জাগাতে পারি কিনা।
নদী বলল, জি, আচ্ছা। বলেই সে ফোনটা কেটে দিল। ফোন কেটে দিয়ে নদী মোবাইলটা ব্যাগে রেখে আবার বাইরে তাকাল। বাসটা এখন তিরাপা রোড ছেড়ে বেরিসকোর্ট রোড ধরে যাচ্ছে। সামনের ফেয়ার ফিল্ড ব্রিজে মোড় নিয়ে রিভার রোড ধরে যাবে। আকাশটা আগের মতোই মেঘলা। তবে প্রকৃতির ধূসর সাদা ভাবটা আরও পরিষ্কার।
নদী রাকিবকে নিয়ে ভাবতে বসল। দুপুরের দিকে নাবিদের কথার জবাবে নদী রাকিবের সঙ্গে তার সম্পর্কের একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিল। নদী বলেছিল, রাকিব ও তার অন্য কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের সম্পর্কটা শ্রদ্ধার। নদী তা ভুল বলেনি। তবে সে এটুকু জানে, এই শ্রদ্ধা থেকে যে ভালোবাসার উৎপত্তি হয়, সেই ভালোবাসাটাও শ্রদ্ধার হয়। নদী সেই ভালোবাসাটুকু নিয়েই এগিয়ে যেতে চায়। কিন্তু নদী কত দূর এগোবে?
নদীর মনে আজকাল এ প্রশ্নটা প্রায়ই জাগে। আর ভাবে, সে কি এ প্রশ্নটা নিয়ে নিজের ভেতর নিজে যুদ্ধ করছে না?
নদী মাথা ঝাঁকাল। ভাবল, হ্যাঁ, করছে। কিন্তু সে কেন করছে?
বাসটা ফেয়ার ফিল্ড ব্রিজ ছেড়ে রিভার রোডে মোড় নিতেই নদীর পুরোনো একটা কথা মনে পড়ে গেল। এই রিভার রোড ধরেই রাকিবের সঙ্গে সে প্রথম নারোওয়াহিয়ার টুইন রিভার রেস্টুরেন্ট থেকে হ্যামিল্টন ফিরেছিল। সেই প্রথমটা আজ এত গুরুত্ববহ হবে তা সে ভুলেও কল্পনা করেনি।
সেই রাতের দৃশ্যটা আজও নদীর চোখে ভাসে। সামান্য পরিচয় ও হঠাৎ সিদ্ধান্তে টুইন রিভার রেস্টুরেন্ট ছেড়ে তারা দুজন চলে আসে। তখন রাত প্রায় এগারোটা। চারদিকে সুনসান নিস্তব্ধতা। আকাশে অর্ধেক জ্যোৎস্না। নদী এই রিভার রোড ধরে ফিরছে। রাকিবের গাড়িতে ওঠার পরই তার ভেতর একধরনের ভয় ঢুকে গিয়েছিল। বারবার ভেবেছিল, হঠাৎ সিদ্ধান্তে এমন একজন অচেনা মানুষের সঙ্গে আসাটা ঠিক হলো কিনা? যদিও নিউজিল্যান্ডে কোথাও নারী হয়রানি নেই বললেই চলে। যা কিছু হয় নারী-পুরুষের সমঝোতার মাধ্যমে হয়। অযথা কেউ কাউকে উত্ত্যক্ত করে না। রাত একটা-দুটোর সময় অনেক মেয়ে নাইট ক্লাব থেকে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরে যায়। ওরা এমনটা কেউ ভাবে না, তাদের পথ কেউ আটকাবে।
রিভার রোডে পুরো রাস্তাটায় ওদের মধ্যে তেমন কোনো কথা হয়নি। যা কিছু কথা হয় হ্যামিল্টনে ফিরে আসার পর। তারপর থেকে রাকিবের প্রতি নদীর যে একটা বিশ্বাস জন্মে, দিনদিন সেই বিশ্বাস আরও বেড়েই চলছে। সেই বিশ্বাস থেকে শ্রদ্ধার একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শ্রদ্ধা থেকে ভালোবাসা...!
নদী ভাবল, তাদের মধ্যে সেই ভালোবাসা কতটুকু? আর তাদের ভালোবাসাই বা কী ধরনের ভালোবাসা?
বাসটা ঝাঁকি দিয়ে কেএফসির উল্টোপাশে ওয়েলিংটন স্ট্রিটে থামতেই নদী তার চিন্তার খেই হারাল। বাস থেকে নামে সে ওয়েলিংটন স্ট্রিট ধরে সামান্য গিয়ে ম্যাকফার্লেন স্ট্রিটে মোড় নিল। এখন বৃষ্টি না হলেও বেশ শীত লাগছে। সে প্যান্ট ও ফতুয়ার ওপর একটা ভারী জ্যাকেট পরেছে। হুড তোলা জ্যাকেট। কিন্তু তার হুডটা তোলা নয়।
নদী রাকিবের বাসার দিকে দৃষ্টি দিয়ে দিঘল ড্রাইভওয়ে পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এল। দরজায় নক করতেই আতিক দরজা খুলল।
আতিক দরজা খুলেই বলল, আসুন, ভেতরে আসুন।
নদী জিজ্ঞেস করল, রাকিব ভাই কি ঘুম থেকে ওঠেনি?
আতিক মাথা নেড়ে বলল, না। আমি রাকিবকে ঘুম থেকে জাগাতে গিয়েছিলাম। কিন্তু সে এত গভীর ঘুমে যে তাকে জাগাতে ইচ্ছে হলো না। আপনি দেখুন একবার চেষ্টা করে।
নদী মাথা ঝাঁকিয়ে ভেতরে ঢুকে সরাসরি রাকিবের রুমে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। দেখল, রাকিব ঠিকই লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। মোবাইলটা বেড সাইড টেবিলের ওপর চার্জে।
নদী বেডের কাছে সিথান বরাবর গিয়ে ঝুঁকে রাকিবের কপালে হাত রাখল। রাকিব সকালের দিকে বৃষ্টিতে ভিজলেও নদী দেখল রাকিবের গা গরম নয়। নদী কেন জানি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
ঠিক তখনই রাকিবের ঘুমটা ভেঙে গেল। চোখের সামনে নদীর মুখটা দেখে প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। পরক্ষণ লাফিয়ে বিছানা শোয়া থেকে উঠে বলল, নদী, তুমি!
নদী মৃদু হেসে বলল, জি, আমি। আপনি এবার ওঠেন। (ক্রমশ)
মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>
ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: