হৃদয় আকাশের খোলা চিঠি

লেখিকার বাবা
লেখিকার বাবা

প্রিয় বাবা কেমন আছ? আমি জানি তুমি যেখানে আছ সেখান থেকে কেউ কথা বলতে পারে না। ফিরে আসতে পারে না। দেখা দিতে পারে না। তারপরও অবুঝ মন, খুব জানতে ইচ্ছে করে, সেখানে তুমি কেমন আছ, কী খাও, কীভাবে ঘুমাও। খুব জানতে ইচ্ছে করে সেখানে কী রাত আর দিন আছে কিনা। সূর্য ওঠে কিনা, রাতের আকাশে পূর্ণিমা আর অমাবস্যার খেলা হয় কিনা। তুমি এখন কী যুবকের মতো আছ নাকি বৃদ্ধের মতো? এখনো কী তোমাকে চশমা পড়তে হয়? তুমি ঘড়ি পড়তে খুব পছন্দ করতে। ঘুম থেকে উঠে ঘড়ি না পড়ে কোনো কাজ করতে না। এখনো কী তাই কর? জানো বাবা, তুমি চলে যাওয়ার পর মা আমাকে তোমার চশমা, একটি ঘড়ি আর পাঞ্জাবি দিয়েছে। রোজ রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তোমার চশমাটা আর ঘড়িটা ধরে দেখি, গন্ধ শুকি। শুনে হাসছ কিংবা ভাবছ চশমা আর ঘড়ির গন্ধ আছে কিনা। আছে, তোমার স্নেহ আর ভালোবাসার গন্ধ। যখন মন খারাপ থাকে তোমার পাঞ্জাবিটা ছুঁয়ে দেখি। জানো বাবা, তুমি চলে যাওয়ার পর আর কেউ আমাকে মা বলে ডাকে না, আর কেউ বলে না, তোর মুখটা এত শুকনো কেন? তোর কি মন খারাপ? আচ্ছা বাবা, আমাকে কী তোমার দেখতে ইচ্ছে করে ঠিক যেমন করে তোমাকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে?

বাবা তোমার কী মনে আছে, তোমার সঙ্গে আমার শেষ বিদায়ের কথা। আমি চলে আসব। বাইরে গাড়ি অপেক্ষা করছে। আমার স্বামী, বাচ্চারা, ভাই দুটো সবাই গাড়িতে চলে গেল। ঘরে শুধু তুমি, আমি, মা আর কাজের বুয়া। মার খুব ইচ্ছে আমাকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেবেন। তাই তোমাকে বললাম শুয়ে পড়তে। পাছে ভয়, যদি বিছানা থেকে পড়ে যাও। কিন্তু তুমি গো ধরলে শোবে না, আমাকে বললে ঘর থেকে বের হতে। তখন আমার চোখে জল। মাথায় হাত রেখে বললে, যাও মা, আমি এখানে বসে দুই চোখ ভরে তোমার যাওয়া দেখব। তোমার কথায় আমি থমকে বসে পড়লাম। বের হতে পারলাম না। কোথা থেকে ঝড়ের মতো উল্কা বেগে অন্তরের রোদন আমাকে কাঁপিয়ে দিল। কাঁপতে কাঁপতে তোমাকে আঁকড়ে ধরলাম। বুয়া বললেন, চলেন আপা খালুকে ধরে নিয়ে যাই। গেট থেকে আপনাকে বিদায় দিয়ে আসবে। আমি বললাম, আব্বা অত দূর হাঁটতে পারবে না। তুমি লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে বললে, আমি পারব। সত্যিই সেদিন তুমি পেরেছিলে। দারোয়ান তোমাকে দেখে তার টুলটি এগিয়ে দিল। তুমি বসলে না। দাঁড়িয়ে আমাকে হাত নাড়লে। যতক্ষণ দৃষ্টিসীমার মাঝে ছিলে তোমার শূন্য দৃষ্টি আর হাত নাড়া দেখেছিলাম। তোমাকে তখন একটি শিশুর মতো দেখাচ্ছিল। আর শিশুর মতোই তোমাকে বুকে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল।

আচ্ছা বাবা, তুমি কী জানতে ওটাই ছিল আমাদের শেষ পরশ? জানো বাবা সেদিন তোমাকে জড়িয়ে ধরে যে গন্ধ পেয়েছিলাম, এখন মাঝে মাঝে রাতে ঘুমের মাঝে সে গন্ধ পাই। আর যখন জেগে যাই তখন বুঝি ওটা ছিল স্বপ্ন। বিছানা ছেড়ে উঠি, পায়চারি করি। জানালা দিয়ে রাতের আকাশের তারা দেখি। আবার শুয়ে পড়ি। জানো বাবা, একদিন স্বপ্নে দেখেছিলাম তুমি আমার কাছে এসে আমার মাথায় হাত রেখে বলেছিলে, তুই যাবি আমার সঙ্গে? আমি বলেছিলাম যাব। তারপর হাত ধরে আমাকে জানালার কাছে নিয়ে গেলে। জানালার কাছে গিয়ে আমার ঘুম ভেঙে গেল।

আমার এ স্বপ্নের কথা শুনে অনেকে ভয় পেয়ে গেল। অনেকে বলল, তুমি এসে ডাকলে না যাওয়ার জন্য। আচ্ছা বাবা, ওরা কী জানে না মৃত মানুষের কোনো ক্ষমতা থাকে না। যে চলে যায় সে এ পৃথিবী থেকে তার চ্যাপটার ক্লোজ করেই চলে যায়। আমাদের আসা আর যাওয়া কেবল পরওয়ার দিগারের ইচ্ছেতেই হয়। মানুষ কি বোঝে না যে প্রতিটি জীবন হচ্ছে এক পর্বের ক্লাইম্যাক্স ভরা উপন্যাস। যার শুরু আছে। মধ্যম অংশ আমরা বুঝতে পারি শেষ হলে। এ উপন্যাসের কোনো সংস্করণ হয় না। এর কিছু অংশ থেকে যায় সব সময়ই অজানা। তোমার উপন্যাসের যেটুকু অংশ আমি জানি, তা আছে আমার হৃদয়ে। আমার সন্তান হয়তো এর সামান্য মনে রাখবে। তারপর তাদের সন্তানদের কাছে তুমি হারিয়ে যাবে। যেমন হারিয়েছেন তোমার দাদার উপন্যাস কিংবা তার বাবার উপন্যাস আমাদের কাছে। পৃথিবীটা কী তুচ্ছ, তারপরও এই তুচ্ছ পৃথিবীতে আমরা মায়ার বাঁধন গড়ি। লোভনীয় এক মায়া। সেখানে স্বপ্নে প্রিয়জন ডাকলেও ভয় পাই। মায়াজাল ছেড়ে চলে যাওয়ার ভয়। এত ক্ষমতা, এত অন্যায়, হানাহানি, মারামারি, ঠকবাজি, মিথ্যাচার আর অহংকার সবই মায়ার লোভে। আমরা ভুলে যাই কিছুই আমাদের অমর করে না। সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে সব উপন্যাসই একদিন হারিয়ে যায়।

আজ থেকে তিন দিন আগে ছিল ২৬ নভেম্বর। গত বছর এই দিনে তুমি চলে গিয়েছিলে আমি ছাড়া সব সন্তানকে দেখা দিয়ে। জানি না আমার সঙ্গে এ তোমার অভিমান নাকি লুকোচুরি খেলা। খুব কষ্ট হয় বাবা। মাঝে মাঝে মনে হয় সারা পৃথিবীকে দুমড়ে মুচড়ে হাতের তালুতে নিয়ে অঝোরে চিৎকার করে কষ্টকে প্রকাশ করতে। কিন্তু পারি না। নিজেকে তখন খুব অসহায় মনে হয়। মনের গহিনে প্রতিনিয়ত গগন ফাটানো চিৎকার করে যে বাবা বাবা বলে ডাকি, তুমি কী শুনতে পাও? মহান প্রতিপালকের কাছে কামনা তোমার কবর জান্নাতের নূরে আলোকিত থাকার, প্রশস্ত থাকার-তোমার স্থান যেন হয় জান্নাতুল ফেরদৌসে। ভালো থেকো বাবা, যেমন আছে আল্লাহর প্রিয় আউলিয়ারা।
...

ড. নূরুন নাহার বেগম: Associate Professor of Education, East Stroudsburg University of PA, পেনসিলভানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।