প্রবাসী মায়েদের যুদ্ধ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

উন্নত জীবনের আশায় প্রায় তিন বছর আগে একদিন আমাদের পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে তাহিয়াকে নিয়ে আমরা সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দেওয়ার জন্য বিমানে চেপে বসি। আমাদের ছেলে রায়ান তখন তার মায়ের গর্ভে। সবে একটা ভ্রূণের আকার নিয়েছে। আনন্দের এই খবরটা তখন শুধু আমিই জানতাম। আত্মীয়স্বজন কাউকে জানানো হয়নি। কারণ তারা দুশ্চিন্তা করতে পারেন। এ সময়টাতে সন্তানসম্ভবা মায়েদের এমনিতেই খাওয়ার রুচি থাকে না। যাত্রাপথে আমার সহধর্মিণী সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের কোনো খাবারই একটুও মুখে দিতে পারলেন না। এতে করে আমার আর আমাদের মেয়ে তাহিয়ার পোয়াবারো হয়ে গেল। আমরা দুজন উদরপূর্তি করে খেয়ে ঘুমে ঢলে পড়লাম। আমার সহধর্মিণী সারাক্ষণই শুধু এপাশ-ওপাশ করে সময় কাটালেন। এভাবে দীর্ঘ ভ্রমণ শেষ করে আমরা একসময় অস্ট্রেলিয়ার সিডনি এসে পৌঁছাই। তখন থেকেই আমার সহধর্মিণীর আসল যুদ্ধটা শুরু হলো।

অস্ট্রেলিয়ায় একটা শিশুর জন্মের আগে থেকে শুরু করে ভূমিষ্ঠ হওয়া, এমনকি তার বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নিরাপত্তা বিধান করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় রায়ান গর্ভে থাকা অবস্থায় তার মাকে নিয়মিত মেডিকেল সেন্টারে যাতায়াত শুরু করতে হলো। উড়নচণ্ডী আমি কখনোই টাকা-পয়সা নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। বাংলাদেশ থেকে আসার সময় সামান্য টাকা হাতে নিয়ে চলে এসেছি। অস্ট্রেলিয়ায় আসার পরই আমাদের পক্ষে গাড়ি কেনা সম্ভব হয়নি। ফলে আমার সহধর্মিণীকে বাসা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে সেখান থেকে বাসে উঠতে হতো। বাস থেকে নামার পর আবার তাঁকে প্রায় আধা কিলোমিটার হেঁটে মেডিকেল সেন্টারে যেতে হতো। এর বাইরে সংসারের সব কাজকর্মও তাঁকে একাই করতে হতো। ঘর পরিষ্কার, রান্না, কাপড়চোপড় ধোয়া থেকে শুরু করে সবই তাঁকেই সামলাতে হতো। কারণ আমি খুব ভোরে কাজে চলে যেতাম। আবার কাজ থেকে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যেত।

এর বাইরেও আমার সহধর্মিণীকে নিয়মিত দুটো কাজ করে যেতে হলো। মেয়ে তাহিয়াকে প্রায় দুই কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে দিয়ে আসা। আবার বিকেলবেলা তাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসা। দুই. অস্ট্রেলিয়াতে নিজেকে ডাক্তারি পেশার যোগ্য করে তোলার জন্য পড়াশোনা করা। আমার সহধর্মিণী দেশের সবচেয়ে ভালো মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা ও ইন্টার্নি শেষে বিসিএস পরীক্ষা পাস করে কয়েক বছর সরকারি হাসপাতালে কাজ করে এসেছেন। কিন্তু এগুলোর কোনোই মূল্য নেই অস্ট্রেলিয়ায়। তাই দিনের সব কাজ শেষ করে তাঁকে পড়তে বসতে হতো। এদিকে রায়ান পেটের মধ্যে নড়াচড়া করে তার অস্তিত্বের জানান দিত। সেটা ছিল আমার সহধর্মিণীর জন্য আনন্দের। যে সন্তান ঠিকভাবে বেড়ে উঠছে, একই সঙ্গে সেটা ছিল বেশ কষ্টের।

এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর আমাদের পাশের বাসার একজন প্রতিবেশী আমাদের মেয়ে তাহিয়াকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া ও নিয়ে আসার দায়িত্ব নিলে আমার সহধর্মিণী একটু বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পেলেন। সেটাও অবশ্য একটা ঘটনার মধ্যে দিয়ে। মেয়ে তাহিয়াকে স্কুলে দিয়ে ফেরার পথে আমার সহধর্মিণী রাস্তার মধ্যে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। তখন তাঁর মাথায় পানি ও সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন ওই প্রতিবেশী। এই ঘটনার পর তিনি তাহিয়াকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া ও নিয়ে আসার দায়িত্ব নেন। এভাবে চলতে চলতে একসময় আমার সহধর্মিণীর মেডিকেলের প্রথম পাঠ পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে এল। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় আমার সহধর্মিণী আবারও ঘণ্টাখানেক ট্রেন ভ্রমণ করে সিডনি সিটিতে পরীক্ষা দিতে গেলেন। এর মধ্যেই তাঁকে মেডিকেল সেন্টার থেকে হাসপাতালে সংযুক্তি দেওয়া হয়েছে। যেহেতু সন্তানের ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসছিল তাই আমার সহধর্মিণীকে আগের তুলনায় বেশি বেশি হাসপাতালে হাজিরা দিতে হচ্ছিল। সেটা আরেক ঝক্কির ব্যাপার। বাসে করে হাসপাতালে যেতে আধঘণ্টার ওপরে সময় লাগে। আবার ফিরে আসতেও একই রকম সময় লাগে। ফলে নিয়মিত চেকআপের সবগুলো তারিখ আর মেলানো সম্ভব হচ্ছিল না।

এদিকে রায়ানের ভূমিষ্ঠ হওয়ার আর সপ্তাহখানেক বাকি। নিয়মিত চেকআপের অংশ হিসেবে হাসপাতালে গেলে ডাক্তারেরা আমার সহধর্মিণীকে বললেন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যেতে। কারণ তাঁর বেশ কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে। যেমন রক্তে হিমোগ্লোবিনের অপ্রতুলতা ছিল মারাত্মক রকমের। অবশেষে তাঁকে ভর্তি হয়ে যেতে হলো। এরপর একদিন আমি অফিস ছুটি নিয়ে মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম। যেহেতু আগের সন্তান জন্মের সময় সিজার করা হয়েছিল তাই এবারও সিজারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো রক্তস্বল্পতার জন্য। অস্ট্রেলিয়ায় বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় বাচ্চার বাবাকেও মায়ের কাছাকাছি থাকতে হয়। কিন্তু মেয়ে একা হয়ে যাবে বলে আমার পক্ষে আর ভেতরে যাওয়া সম্ভব হলো না।

অস্ট্রেলিয়ায় যেকোনো সেবার মানই বাংলাদেশের তুলনায় অনেক ভালো। তারপরও আমার সহধর্মিণীর সিজার করতে গিয়ে স্নায়ুতে ইনজেকশন দিতে গিয়ে চিকিৎসকেরা তিনবারের পর সফল হন। প্রথম তিনবারেও তারা স্নায়ুতেই ছিদ্র করেছিলেন। কিন্তু তারা নিশ্চিত ছিলেন না বলে চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছিলেন। এতে করে যেটা হলো সেটা হচ্ছে আমার সহধর্মিণীকে পরবর্তী তিন দিন সটান বিছানার সঙ্গে শুয়ে থাকতে হলো। কারণ নড়াচড়া করলেই স্নায়ুর তরল পদার্থ বের হয়ে শরীরের নিম্নাঙ্গগুলো পুরোপুরি অচল হয়ে যেতে পারে। এমনকি মৃত্যুর সম্ভাবনাও আছে। আমার সহধর্মিণী নিজেই গাইনির চিকিৎসক এবং দেশে থাকতে অনেক সিজার করেছেন। তিনি বললেন, এটা আসলে ডাক্তারদের দোষ না। এমন ঘটে এক শতে একজন রোগীর ক্ষেত্রে। দুর্ভাগ্যবশত সেই একজন হলেন আমার সহধর্মিণী। তারপর তিন দিন তিনি ব্যথায় কুঁকড়ে বিছানায় শুয়ে থাকলেন।

এভাবে সাত দিন হাসপাতালে থাকার পর যখন তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হলো তখন শুরু হলো তার আসল সংগ্রাম। ঘরের কাজের পাশাপাশি মেয়ের পড়াশোনার খবর রাখা। শিশু রায়ানকে দেখাশোনা করা আর দ্বিতীয় পাঠ পরীক্ষার জন্য আরও বেশি পড়াশোনা করা। বলাই বাহুল্য অফিসে যাওয়া আসা করেই আমার দায়িত্ব শেষ হয়ে গেল। তাই দুই বাচ্চার মায়ের সংগ্রামটা আরও বেশি কঠিন হয়ে গেল। আসলে আমি একটা ঘোরের মধ্যে বসবাস করি। আমার স্বপ্ন পৃথিবীর সব মানুষ সবাইকে সমানভাবে মূল্যায়ন করবে। অন্যের বিপদে জীবন দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। সেটা নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমি সংসারের প্রতি অনেকটাই উদাসীন। ফলে সহধর্মিণীর যুদ্ধটা আরও বেশি কঠিন হয়ে পড়ে। একই সময় আমার সহধর্মিণীকে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে হয়। ছোট্ট রায়ানকে বেবি সিটে বসিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে। প্রতিদিন দুই ঘণ্টার প্রশিক্ষণ নিতে হতো। কিন্তু গাড়ি চলতে শুরু করার সামান্য পরেই রায়ান শুরু করত তারস্বরে চিৎকার। তখন বাধ্য হয়ে রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে আসতে হতো।

প্রবাসে বাচ্চাকাচ্চা দেখাশোনার জন্য অনেকে দেশ থেকে তাদের বাবা-মাকে নিয়ে আসেন। কিন্তু আমরা সেটা করতে পারিনি। কারণ আমাদের সামর্থ্যে কুলাচ্ছিল না। এভাবেই একসময় আমার সহধর্মিণীর দ্বিতীয় পাঠের পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে এল। দ্বিতীয় পাঠের পরীক্ষা দিতে যেতে হয় অস্ট্রেলিয়ার অন্য একটি রাজ্যে। ছেলে রায়ানকে নিয়ে বিমানে যাত্রার সময় রায়ান ভয়ংকর রকমের চিৎকার করে সারা বিমানের যাত্রীদের আনন্দময় ভ্রমণকে মুহূর্তেই বিষিয়ে তোলে। সামনের আসনে বসা একজন বয়স্ক নারী যাত্রী অভিযোগই করে বসেন। অবশ্য পাশের অন্য যাত্রী রায়ানের মায়ের পক্ষ নেন।

রায়ানের বয়স এখন দুই বছরের বেশি। সকালে রায়ানকে কেয়ারে ও মেয়ে তাহিয়াকে স্কুলে দিয়ে এসে ওদের মা অনলাইনে কাজের খোঁজ শুরু করেন। তারপর হঠাৎ একদিন আমার সহধর্মিণীর একটা হাসপাতালে কাজ জুটে যায়। আমাদের বাসা থেকে হাসপাতালে গাড়িতে যেতেই দুই ঘণ্টা লাগে। আমার সহধর্মিণী প্রথমে সিডনি সিটিতে তার এক সহকর্মীর বাসায় যান। তারপর দুজন একসঙ্গে যান হাসপাতালে। ফেরার পথেও সেই সহকর্মী একটা জায়গা পর্যন্ত এগিয়ে দেন। তাই যাওয়া আসা একটু সহজ হয়েছে। এর আগে মাঝেমধ্যেই তাকে ট্রেনে করে ফিরতে হতো। তখন তিনবার ট্রেন বদলে প্রায় ঘণ্টা তিনেক সময় ব্যয় হতো। তারপর শনি-রোববার আবার সারা সপ্তাহের রান্না, ঘরদোর পরিষ্কার করা।

বর্তমানে আমার সহধর্মিণী ভোরে উঠে তৈরি হয়ে হাসপাতালের উদ্দেশে বের হয়ে পড়েন। রাতে ফেরেন। মাঝেমধ্যেই আবার বেশ রাত হয়ে যায়। বাসায় ফিরে মেয়েকে নিয়ে বসতে হয়। কারণ মেয়ে তাহিয়া লেখাপড়ায় খারাপ করা শুরু করেছে। সেটা তিনি জানতে পেরেছেন তাহিয়ার এক সহপাঠীর মায়ের কাছ থেকে। সেটা নিয়েই এখন তাহিয়ার মায়ের যত যন্ত্রণা। এতটা কষ্ট করার পরও যদি ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার ফল ভালো না হয় তাহলে এত কষ্ট করে কী লাভ? বাংলাদেশি মানসিকতার বাবা-মায়েরা দেশ ছেড়ে এসেও দেশের সেই মানসিকতাকে ঝেড়ে ফেলতে পারেননি। তাই বাচ্চাকে ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্র বানাতে সবাই উঠেপড়ে লেগেছেন। ক্লাসের ফলাফল কার্ডে যদিও মেধাস্থান উল্লেখ থাকে না তবুও তারা কীভাবে যেন বের করে ফেলেন কে প্রথম আর কে দ্বিতীয়।

এখানে আমি একজন প্রবাসী মায়ের গল্প বললাম। যিনি প্রথম প্রজন্মের প্রবাসী মা। যার বাবা মা দেশে থাকেন এবং বিদেশে রক্ত সম্পর্কের কেউ থাকেন না। অবশ্যই প্রতিবেশীরাও সবাই যার যার সাধ্যমতো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। কিন্তু তারাও আসলে মোটামুটি একই অবস্থায় দিন যাপন করেন। তাই দিন শেষে নিজেই নিজেকে সাহায্য করতে হয়। দেশে অন্ততপক্ষে পরিবার পরিজন থাকেন। সাহায্যকারী থাকুক বা না থাকুক। তাই একজন প্রবাসী মায়ের গল্প আসলেই সীমাহীন সংকট মোকাবিলার গল্প। যেখানে তাকে প্রতিনিয়ত ঘড়ির কাটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোতে হয়। জানি না সেই যুদ্ধের শেষ কোথায়। হয়তোবা বাচ্চারা একটু বড় হলে কিছুটা স্বস্তি পাবেন তারা। কিন্তু সেটারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ ছেলেমেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করে তুলতে গেলে, তাদের পেছনে হয়তোবা লেগেই থাকতে হবে সাবালক হওয়া পর্যন্ত। প্রবাসী সকল মায়ের জন্য শ্রদ্ধা আর শুভকামনা, তাদের এই অন্তহীন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মানসিকতার জন্য।
...

লেখকের ইমেইল: <[email protected]>