রোববারে তো সম্ভব হয় না। সেদিন নদী তার নাবিদ ভাইয়ের দোকানে সারা দিন কাজ করে। তাই শনিবারে রাকিব কোনোমতেই নদীর কাছ থেকে দূরে থাকতে চায় না। আজকাল সে নিজ থেকে অন্য কাউকে ফোন করুক বা না করুক, নদীকে সময়-সময় ফোন করে। শনিবার সকাল হলে তো কোনো কথাই নেই। ঘুম থেকে উঠেই একটা ফোন দেবে। সারা দিনের পরিকল্পনার কথা কখনো নিজ থেকে বলবে, কখনো নদীর কাছ থেকে শুনবে।
শনিবারে সকালে নয়টা-দশটার দিকে বের হয়ে ওরা দীর্ঘক্ষণ ধরে নদীর পাড়ে হাঁটে কিংবা কাছাকাছি কোথাও যায়। তামাহিরি ভিলেজ, ছোট্ট শহর মরিন্সভেল, অটোরোহাঙ্গা কিউই পাখির ফার্ম, হান্টলি রিভার ড্যাম ও র্যাগলেন বিচ। এর মধ্যে দূরের কোথাও বলতে ওয়াইটুমু গুহায় গিয়েছিল।
ওরা ওয়াইটুমু গুহায় গিয়েছিল গত শনিবারে। হ্যামিল্টন থেকে মাত্র চুরাশি কিলোমিটার দূরে ওয়াইটুমু গুহা। প্রায় পাঁচ বছর আগে ছোট ফুপা ও ছোট ফুফু যখন অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে হ্যামিল্টনে বেড়াতে এসেছিলেন, তখন রাকিব তাদেরকে ওয়াইটুমু গুহায় নিয়ে গিয়েছিল। সেই ভ্রমণটা অবশ্য তেমন আনন্দ ভ্রমণ হয়নি। ছোট ফুফু তো কোথাও গেলে কোনো কিছু দেখার আগে শুধু কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকেন। সেবারও তিনি তাই করেছিলেন।
এবার রাকিব নদীকে নিয়ে ওয়াইটুমু গুহায় ঘুরতে গিয়ে বেশ চমৎকার একটা দিন কাটিয়েছে। ওয়াইটুমুর গ্লো-ওয়ার্ম গুহাটা মনে হয় পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গুহার একটা। বিশাল একটা পর্বত। পর্বতের ভেতরটা প্রায় ফাঁকা। গুহার বিস্তৃতি এত যে, একটা চারতলা দালান যেন গুহার ভেতর প্রাকৃতিকভাবে বানানো হয়েছে। গুহার ভেতরটা অবশ্য চারটা স্তরেই বিভক্ত। গুহার ভেতরে উঠানামার জন্য মাটি কেটে সিঁড়ি বানানো হয়েছে। এমন কী গুহার ভেতর একটা হলরুমও আছে। যেখানে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে গান গাওয়া যায়। অনেক সময় ট্যুর গাইড সেখানে দাঁড়িয়ে অনুরোধ করে কাউকে গান গাইতে। পর্যটকদের মধ্যে কেউ গান গাইতে জানলে তখন সাড়া দেন। জোরে গলায় গান গেয়ে ওঠেন। কোন ভাষায় গানটা গাইলেন, সেটা কোনো ব্যাপার নয়। গুহার ভেতর হলরুমটায় গানের বিপরীতে যে প্রতিধ্বনি হয়, তা সত্যি অকল্পনীয়। মনে হয় যেন বিশাল থিয়েটারের ভেতর গান গাওয়া হচ্ছে। সেদিন রাকিবকে অবাক করে দিয়ে ট্যুর গাইড অনুরোধ জানাতেই নদী একটা রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে উঠেছিল, আমারও পরান যাহা চায়, তুমি তাই গো...!
নদীর গানের গলা তেমন ভালো নয়। ফ্যাসফেসে গলা। কিন্তু তারপরও সেদিন রাকিবের কাছে নদীর গাওয়া গানটা তার এ জীবনে শোনা একটা শ্রেষ্ঠ গান মনে হয়েছিল। বাসায় ফেরার পরও তার কানে গানের কথাগুলো বারবার প্রতিধ্বনিত হয়েছিল।
তবে ওয়াইটুমু গ্লো-ওয়ার্ম গুহার যেটা সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ছিল, গুহার ভেতর দিয়ে একটা নদী বয়ে গেছে। যে নদীর নাম ওয়াইটুমু নদী। গুহার ভেতরেই নৌকা চলাচলের ব্যবস্থা আছে। ওরা সারি করে নৌকায় ওঠে। চারদিকে কোনো আলো নেই। মনে হচ্ছিল যেন নিস্তব্ধ ও নিঃসীম রাত। অসংখ্য গ্লো-ওয়ার্ম পোকার ঝিকিমিকি আলো আকাশের তারার মতো মনে হয়েছিল। মূলত গ্লো-ওয়ার্ম পোকাগুলোর জন্যই গুহার এ পাশটার সব আলো নিভিয়ে রাখা থাকে। গ্লো-ওয়ার্ম পোকা আলো সহ্য করতে পারে না।
গুহার ভেতর ওয়াইটুমু নদীতে নৌকায় ওঠার পর যে দৃশ্যটা আজও রাকিবের অনুভূতিতে নাড়া দেয়, অন্ধকারে নৌকায় তার পাশে বসে নদী শক্ত করে তার হাত চেপে বসেছিল। অন্ধকারে নৌকায় বসে নদী একটু একটু ভয়ও পাচ্ছিল। কিন্তু নদী যেন ভয় পাওয়ার চেয়ে তার সমস্ত অবলম্বন রাকিবের ওপর ছেড়ে দিয়েছিল।
রাকিব এখন কফির কাপ হাতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ভাবল, আহা, নদী সেদিনের মতো কবে তার সমস্ত জীবনের অবলম্বন তার ওপর ছেড়ে দেবে? ছোট্ট ছোট্ট সুখ, ছোট্ট ছোট্ট অনুভূতি, আর ছোট্ট একটু ভালোবাসা...! রাকিব আজকাল নদীকে নিয়ে ভাবতে পারে। চলতে চলতে, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় এটুকু বিশ্বাস তার মধ্যে জন্মেছে, নদীকে নিয়ে সত্যি সে কিছু একটা ভাবতে পারে।
গত চার সপ্তাহ ধরে নদী নয়টা-দশটার মধ্যে রাকিবের বাসায় চলে এলেও আজ সে একটু দেরি করে আসবে। নদী বলেছে, এগারোটা-সাড়ে এগারোটার মধ্যে এখানে এসে পৌঁছাবে। আজও সে নয়টা কী দশটার মধ্যে চলে আসত। মাঝখানে মৌনতা ঝামেলাটা বাঁধিয়েছে। সেও নাকি তাদের সঙ্গে নদীর পাড়ে হাঁটতে চায়। এ জন্য মৌনতা নদীকে সকাল থেকে কয়েকবার ফোন দিয়েছে।
মৌনতার ব্যাপারটা নদী ঝামেলা হিসেবে বললেও সে তা কথার কথা বলেছে। মৌনতা নদী বলতে যেমন অজ্ঞান, নদীও মৌনতা বলতে অজ্ঞান। তাদের মধ্যে অসমবয়সী কী যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক! রাকিবও মৌনতাকে বেশ পছন্দ করে। বেশ মিষ্টি মেয়ে মৌনতা। তার কথাগুলো যেন আরও মিষ্টি। রাকিব মৌনতাকে যতবারই দেখে ততবারই তার মেয়ে সাদিয়ার কথা মনে পড়ে যায়। সাদিয়া বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই সে এভাবে বায়না ধরত!
রাকিব কফির কাপে চুমুক দিয়ে দিঘল দৃষ্টি মেলে তাকাল। শীতকালটা প্রায় শেষের দিকে। কিন্তু শীত যেন আরও জেঁকে পড়েছে। সকালে ঘাসের ওপর হালকা স্তরে বরফ জমে। উত্তর দ্বীপের ফাকাপাপা শহরে তো শীতকালে সব সময়ই তুষারপাত হয়। এবার তাওপো শহর ও নিউ প্লে মাউথ শহরেও বেশ তুষারপাত হয়েছে। গত রাতের খবরে দেখিয়েছে, এখনো শহর দুটোতে তুষারপাত হচ্ছে। শীতকালে দক্ষিণ দ্বীপের প্রায় সব শহরে তুষারপাত হওয়া অনেকটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
সকালের দিকে ঘাসের ওপর হালকা স্তরের তুষার জমলেও এখন এর লেশ মাত্র নেই। বরং আজ সকাল থেকেই চমৎকার রোদ উঠেছে। বসন্ত আসি আসি করছে বলে এখনই দক্ষিণের হিন হিন বাতাস বইতে শুরু করেছে। যদিও দক্ষিণের বাতাসটা খুব শীতল। জামাকাপড়ের ওপর সোয়েটার, সোয়েটারে ওপর ভারী জ্যাকেট বা ওভারকোট না পরলে শীতের বাতাস হাড় কাঁপিয়ে দিয়ে যায়।
রাকিব একটা জিনসের প্যান্টের ওপর পোলো গেঞ্জি। গেঞ্জির ওপর একটা উলের সোয়েটার। সোয়েটারের ওপর একটা লেদারের জ্যাকেট পরে তৈরি হয়েই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। নদী ও মৌনতা এলেই সে সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে যাবে।
রাকিব কফির কাপে শেষ চুমুক দেওয়ার আগেই দেখল নদীর গাড়িটা ম্যাকফার্লেন স্ট্রিট থেকে তার বাসার ড্রাইভওয়ের দিকে মোড় নিচ্ছে। গাড়ির ভেতর থেকেই মৌনতা হাত তুলল।
গাড়িটা ড্রাইভওয়েতে পার্ক করতেই মৌনতা দ্রুত গাড়ির দরজা খুলে বের হয়ে জিজ্ঞেস করল, আংকেল, তুমি রেডি তো?
রাকিব বলল, হ্যাঁ।
: তাহলে এখনো কফির কাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
: তোমরা আসতে দেরি করছ বলে।
: না না, মোটেও না। আমরা এগারোটায় আসব বলেছি, ঠিক এগারোটায় এসেছি। তুমি ঘড়ি দেখতে পার।
নদী গাড়ি থেকে নেমে মৌনতাকে বলল, হয়েছে, তোমাকে আর পাকামো করতে হবে না।
মৌনতা বলল, ফুফি, তুমি ভুল কথা বলছ কেন?
নদী মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল, কী ভুল কথা?
: তুমি বলছ, আমি পাকামো করছি। কিন্তু আমি তো পাকামো করছি না।
: তাহলে কী করছ?
: আমি সত্যি কথা বলছি। বাবা বলেছে, সত্যি কথা বললে পাকামো হয় না।
নদী রাকিবের দিকে তাকিয়ে বলল, দেখছেন, দেখছেন?
রাকিব মৃদু শব্দ করে হেসে উঠল।
নদী জিজ্ঞেস করল, আপনি রেডি তো?
রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ।
: তাহলে আমরা আর ওপরে উঠব না। আপনি নেমে আসুন। আমরা ডাউন টাউন প্লাজা বা হ্যামিল্টন সেন্ট্রালে যাব।
: হঠাৎ সেখানে? আজ নদীর পাড়ে হাঁটবে না?
: সে না হয় বিকেলের দিকে হাঁটব। এখন মৌনতা বায়না ধরেছে সে ড্যান্সিং অ্যান্ড সিংগিং ডল কিনবে।
রাকিব বলল, ও, আচ্ছা।
মৌনতা বলে উঠল, আমি ভাবছি, ফুফি স্টুডেন্ট। তুমি জব কর।
রাকিব জিজ্ঞেস করল, তো?
: তুমি আমাকে ড্যান্সিং অ্যান্ড সিংগিং ডল কিনে দেবে।
: তা না হয় কিনে দিলাম। তোমার দারুণ লজিক।
: আমার বাবাও তাই বলে।
নদী মাঝখান থেকে বলে উঠল, আহা মৌনতা, আমি তোমাকে ডলটা কিনে দেব বলে প্রমিজ করেছি। তুমি তোমার রাকিব আংকেলকে বলছ কেন?
মৌনতা বলল, ড্যান্সিং অ্যান্ড সিংগিং ডলটা কোয়াইট এক্সপেন্সিভ, তাই। তুমি অ্যাফোর্ট করতে পারবে না।
নদী বলল, ওগো আমার পাকনা বুড়ি...!
মৌনতা চেহারায় বিরক্তি ফুটিয়ে বলল, ফুফি, তুমি আমাকে পাকনা বুড়ি বলবে না তো। দিজ ইজ আন-অ্যাপ্রোপ্রিয়েট ল্যাঙ্গুয়েজ। আই ডোন্ট লাইক ইট।
নদী বলল, ওকে, ওকে।
রাকিব ব্যালকনি থেকে আবার শব্দ করে হাসল। (ক্রমশ)
মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>
ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: