নিজভূমে পরবাসী ও একাত্তরের দেশান্তরী

২৫ মার্চ কালরাতে অপারেশন সার্চলাইট নামক গণহত্যার যে অভিযান চালানো হয়, তার অন্যতম প্রধান টার্গেট ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি আবাসিক হল। ইকবাল হলের (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ক্যানটিনের সামনে বেশ কয়েকটি মৃতদেহ পড়ে ছিল ২৭ মার্চ পর্যন্ত। ছবি: সংগৃহীত
২৫ মার্চ কালরাতে অপারেশন সার্চলাইট নামক গণহত্যার যে অভিযান চালানো হয়, তার অন্যতম প্রধান টার্গেট ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি আবাসিক হল। ইকবাল হলের (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ক্যানটিনের সামনে বেশ কয়েকটি মৃতদেহ পড়ে ছিল ২৭ মার্চ পর্যন্ত। ছবি: সংগৃহীত

ডিসেম্বর মাসের কোনো একদিন। মেলবোর্নেরই এক বাড়িতে দাওয়াত। খাওয়াদাওয়া শেষে কয়েকজন নারীর আলাপ–গল্পে মুক্তিযুদ্ধের কথা উঠল। কেউ কেউ তাদের ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর টুকটাক স্মৃতি নাড়াচাড়া করছিলেন। কেউবা মুক্তিযুদ্ধের ওপর দেখা কোনো সিনেমা অথবা পড়া কোনো বইয়ের কথা বলে যাচ্ছিলেন। একজন একটাও কথা না বলে চুপচাপ বসেছিলেন। অন্য কেউ তাকে উদ্দেশ করে বললেন, আপনি কিছু বললেন নাতো?

: আমি তো তখন স্কুলে; তেমন কিছুই জানি না।

আরেকজন রসিকতা করে বললেন, হজরত মোহাম্মদ (স.), গ্যালিলিও, সক্রেটিস, শেক্‌সপিয়ার তারা আমাদের জন্মেরও আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন, তাদের কথাও কমবেশি আমরা জানি, তাই না?

এই আলাপচারিতা কানে যাওয়াতে মনে হলো, মুক্তিযুদ্ধের কথা জানার জন্য বয়স লাগে না। নিজে যুদ্ধ যেতে পারেনি, বয়স কম ছিল, তাই কোনো অভিজ্ঞতা অর্জন হয়নি। তাই বলে নিজের দেশের মুক্তিযুদ্ধকে জানবে না এটা কেমন কথা?

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা নানা বইয়ে নানা ভাষায় বলা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। আপামর দেশবাসীর সেই ভয়ংকরের মুখোমুখি কাটানো নয় মাস ছিল যাতনা আর বিষাদের। তার কতটুকুই সবার জানা হয়েছে অথবা কতটুকুইবা সবাইকে জানানো হয়েছে। একেকজনের একেক রকম দুঃস্বপ্ন আর কষ্টের মাঝে কাটানো কাল। অনেকরই জানতে মন চায়, কার কেমন কেটেছে নয় মাস। কেউ চাইলে জানতেও পারে।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের ভারতের শরণার্থীশিবির ভ্রমণ শেষে লেখা কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’, মৌসুমী ভৌমিকের গাওয়া গান আছে ওই কবিতা নিয়েই, তারপর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ রুমির মা জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’, শব্দসৈনিক এম আর আখতার মুকুলের ‘আমি বিজয় দেখেছি’ আরও কত কত কথা ও গাথা আমাদের পরিচয় করায় নিষ্ঠুর ও নির্মম বাস্তবতার সঙ্গে।

পশ্চিম পাকিস্তানিদের দুরভিসন্ধিমূলক মনগড়া ধারণা আমরা বাঙালিরা যথেষ্ট মুসলমান নই। তাই ধর্ম রক্ষার বাহানায় আমাদের শায়েস্তা করতে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ে ১৯৭১ সালের কালরাতে। তারিখটা ছিল ২৫ মার্চ। ওই দিন সপ্তাহের কী বার ছিল সাধারণ মানুষের ততটা মনে রাখার কথা নয়। তবে সন, মাস, তারিখ জানা ইতিহাসের দাবি, তাই ইতিহাসবিদ জানেন অবশ্যই।

তারপরের দিন থেকেই দেশের মানুষ যে যার কর্তব্য ঠিক করে ফেলে। মায়ের ছেলেরা যুদ্ধে যায় মুক্তি ছিনিয়ে আনতে। এদিকে অধিকৃত দেশে ঘরে ঘরে মায়েরা ছোটদের নিয়ে আল্লাহর কাছে দিবারাত্রি দেশের জয়, স্বস্তি ও শান্তি চেয়ে প্রার্থনা শুরু করেন।

মানুষের মুখে শুনে, বইপত্র পড়ে ওই দিনগুলোর কথা বিস্তারিত জানার আগ্রহ অনেকের মতো আমারও। ইচ্ছা দুরন্ত ছিল দেখে একজন পরবাসেও ভালোবেসে একটা বই পড়তে দিয়েছিলেন আমাকে। বইটি একজন ইতিহাসবিদের রচনা। বইটিতে ২৫ মার্চ বৃহস্পতিবার ছিল বলে জানতে পারি। পরদিন ২৬ মার্চ ছিল শুক্রবার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক, গবেষক ও স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস প্রণয়নের জন্য গঠিত প্রামাণ্যকরণ কমিটির সভাপতি ড. মফিজুল্লাহ কবীর তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ওই শুক্রবারে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ ঢাকার মসজিদ থেকে জুম্মার আজান ধ্বনি শুনতে পায়নি মানুষ।

কী পরিহাস! ধর্ম রক্ষার নামে ওরা আজানকেই স্তব্ধ করে দিয়েছিল ওই শুক্রবারে। কারফিউ জারি ছিল শহরে। তাতে মুসল্লিদের জুম্মার নামাজে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

পুরো বইয়ে চাক্ষুষ দৃশ্যগুলো বিবৃত হয়েছে নিখুঁতভাবে। সততার সঙ্গে নিজস্ব ভীতিকর অনুভূতিও তুলে ধরেছেন ইতিহাসবিদ শিক্ষক। দুঃসহ দুর্গতির দিনগুলোতে কিছু লিখবেন বলে একটি চটি খাতা কিনে এনেছিলেন। তার মলাটে বাংলাদেশের জনক শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি ও তার দলের প্রতীক নৌকার ছবি ছিল। লেখকের ভীত স্ত্রী তাঁকে মলাটটি ছিঁড়ে ফেলতে অনুরোধ করেন। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অনবরত পাকিস্তানি আর্মি টহল দিয়ে যাচ্ছিল। ওই দিনগুলোতে আল্লাহর কাছে অধ্যাপক নিজস্ব বাক্যশৈলী দিয়ে প্রতি রাতে একটি প্রার্থনা করতেন। প্রতি রাতেই তিনি নিজস্ব বন্দনাটি বাংলায় লিখতেন আবার ছিঁড়েও ফেলতেন। কারণ তখন যে স্বদেশেও মানুষ পরবাসী। তখন দেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। স্বাধীনতা নাই বাক্যেরও।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থীশিবিরেও দেশ থেকে পলাতক অনেক স্বদেশি ভাইবোনেরা অসহনীয় কাল কাটাচ্ছেন। যোদ্ধারাতো আছেনই। দেশের ভেতরেও মানুষ অস্বাভাবিক রকম স্বাভাবিকতার ভেক ধরে জীবন চালাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় খোলা, কিন্তু ছাত্র নেই, স্কুল-কলেজও খোলা তাতেও নামমাত্র ছাত্র। পাকিস্তানি বাহিনীর সদম্ভ চেষ্টা সব ঠিকঠাক, সব স্বাভাবিক দেখানো আর মুক্তির জন্য মরিয়া মানুষের আপ্রাণ প্রয়াস ওদের সবকিছু ভন্ডুল করে দেওয়া।

ওই নয় মাসের পরবাসে সাবালক, নাবালক, জ্যেষ্ঠ, কনিষ্ঠ সবাই এত দীর্ঘ সময় জায়নামাজে বসে থেকেছেন, তসবি জপেছেন হিসাব করে বের করা যাবে না। প্রার্থনা একটাই মুক্তিযোদ্ধাদের জয়, দেশের মুক্তি, মানুষের স্বাধীনতা। মফিজুল্লাহ কবীর তাঁর বইয়ে (Experience of an Exile at Home: Life in Occupied Bangladesh) লিখছেন, ২৬ মার্চের পরের শুক্রবারে (২ এপ্রিল) পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকার কাছে জিঞ্জিরায় অভিযান চালায়। এখানে পুরো বইয়ের কাহিনি বর্ণনা নয় লেখকের কিছু কিছু পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করাই উদ্দেশ্য। তাই লেখকের ভাষ্য মুসলমানদের কাছে পবিত্র দিনগুলোকেই তারা হত্যা, ধ্বংস ও নির্যাতন চালানোর জন্য বেছে নিতে দ্বিধা করেনি। তথ্যে ঋদ্ধ বইয়ে নিজভূমে দমবন্ধ করা পরিবেশে ইতিহাসবিদের অনুভূতিও পাঠককে নাড়া দিয়ে যায়।

কিছু ছবি রয়েছে বইটিতে যা থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জনগণের নিষ্ঠা-নিবেদন যেমন বোঝা যায় তেমনি আন্দাজ করা যায় আমাদের প্রতি পশ্চিমা পাকিস্তানিদের নিষ্ঠুরতার মাত্রা।

আলবদর, রাজাকারেরা যে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল তাঁদের বেশি অংশ ছিলেন শিক্ষকম তাঁদের বিষয়ে তথ্যগুলো নিখুঁতভাবে আছে এই ইতিহাসবিদের লেখাতে।

এবার অন্য ঘটনা বর্ণিত হচ্ছে তাও মুক্তিযুদ্ধেরই অংশ। বিদেশে বসেই শোনা।

একজন স্কুল পড়ুয়া তার পরিবারের সঙ্গে ভারতে শরণার্থী হিসেবে নয় মাস কাটিয়েছিলেন। তার বড়ভাই মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছেন। পরিবার হুমকির মুখে এ কারণে সীমান্তসংলগ্ন এলাকা থেকে তাদের গোটা পরিবার পালিয়ে ভারতে চলে যায়। এপারে তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানপন্থীরা। আর ওপারেও ঘটল করুণ ঘটনা। তার মায়ের মৃত্যু ঘটে শরণার্থীশিবিরেই। যুদ্ধ শেষে তারা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ও ধ্বংসপ্রাপ্ত নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। মা ফিরলেন না সঙ্গে, তাই জীবন হলো অনেক কষ্টের। তারপরও নানা সমস্যার মাঝ দিয়ে মাতৃহীন ছেলেটি পড়াশোনা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পেশায় যোগ দেয়। তবে তার মনে বরাবর জেগে ছিল ও আছে শরণার্থীশিবিরের দিনযাপনের কষ্ট ও শিবিরেই মাকে হারানোর দুঃখ। সবকিছু ঘটেছিল দেশের দুর্দিনের কারণে।

মুক্তিযুদ্ধের ক্ষত বুকে নিয়ে জীবনযাপনকারী ওই মানুষটি বহুদিন পর একদিন ক্ষোভে ফেটে পড়লেন তারই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বয়োজ্যেষ্ঠ ভাইয়ের ওপর। জ্যেষ্ঠ ভাই এমনিতে মানুষ নাকি মানুষ খারাপ না। তবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর কোনো আগ্রহ বা আবেগ দেখা যেত না। একদিন সেই ভাইয়ের এক মন্তব্য শুনে দুঃখ আর ক্রোধে ফেটে পড়লেন শরণার্থীশিবিরে মা হারানো ছেলেটি। দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ভাই আপনাকে আপনার কথা উইথড্র করতেই হবে; সবাই মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতে গিয়েছিল ফায়দা আর সুবিধা লুটতে আপনার এই কথা একদম ঠিক নয়। বলতে হবে সবাই যায়নি, বলতে হবে মতিয়ুরের পরিবার যায়নি।

শেখ মতিয়ুর নামের সেই শিক্ষক মেলবোর্নে বসে যখন তার বিষাদময় এই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন তখন তার চোখে ছিল অসহনীয় দুঃখের ছায়া আর কণ্ঠে ছিল গভীর কান্না মাখানো ক্রোধ।

এই সেই নয় মাসের ইতিহাস যার প্রতি পরতে পরতে গেঁথে আছে আবেগ অহংকার, দুঃখ ও ভীতিকর অসংখ্য স্মৃতি। স্বদেশ থেকে বহু দূরে বাস করেও টের পাওয়া যায় তার রেশ।