বৈরুতে অভিবাসন ও বিজয় দিবস উদ্যাপন

আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবসের আলোচনায় বক্তব্য দিচ্ছেন আব্দুল মোতালেব সরকার
আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবসের আলোচনায় বক্তব্য দিচ্ছেন আব্দুল মোতালেব সরকার

আনন্দমুখর পরিবেশে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে বাংলাদেশ দূতাবাসের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক অভিবাসন ও মহান বিজয় দিবস উদ্‌যাপিত হয়েছে। নানা আয়োজনের মাধ্যমে দিবস দুটি আলাদাভাবে উদ্‌যাপন করা হয়।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবস

১৮ ডিসেম্বর বৈরুতে কর্মদিবস হওয়ায় প্রবাসীদের অধিক সংখ্যায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গতকাল শনিবারে (২২ ডিসেম্বর) এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দিবসের কর্মসূচির মধ্যে ছিল অভিবাসন সংক্রান্ত ভিডিও প্রদর্শন, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর বাণী পাঠ, আলোচনা ও প্রবাসীদের সঙ্গে তাদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে মতবিনিময়। অনুষ্ঠানে দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও প্রবাসী বাংলাদেশিরা ছাড়াও অভিবাসন নিয়ে কাজ করে এমন এনজিওর কয়েকজন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।

আলোচনা অনুষ্ঠানে দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোতালেব সরকার তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় অভিবাসীর অধিকার মর্যাদা ও ন্যায় বিচার অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। দেশের উন্নয়নে অভিবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের গুরুত্ব উল্লেখ করে তিনি বলেন, অভিবাসীদের মর্যাদা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। তিনি আরও উল্লেখ করেন, অভিবাসীদের ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার জন্য অভিবাসী, প্রেরণকারী দেশ ও অভিবাসীদের গন্তব্য দেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে। অভিবাসীদের তাদের অধিকার সম্পর্কে আরও সচেতন হতে হবে। সবকিছু জেনে-বুঝে ও আইন মেনে বিদেশ যেতে হবে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) ও সুইস গবেষণা সংস্থা এসডিসির গবেষণালব্ধ তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বেশির ভাগ শ্রমিক দালালদের মাধ্যমে বিদেশ গমন করে। ফলে তাদের অভিবাসন ব্যয় বিশ্বে সর্বোচ্চ। কারণ এ অর্থের ৬০ শতাংশ ভোগ করে দালালেরা।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবসের আলোচনায় উপস্থিতি
আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবসের আলোচনায় উপস্থিতি

তিনি শ্রমিকদের নিরাপদ, সুশৃঙ্খল ও দায়িত্বশীল অভিবাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরেন। এ ছাড়া, তিনি অভিবাসীদের দ্রুত ও সহজে বিভিন্ন সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে দূতাবাসের বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করেন। তিনি বলেন, অবৈধভাবে লেবাননে বসবাসকারী শ্রমিকদের দ্রুত দেশে প্রেরণ, অসুস্থদের জন্য চিকিৎসাসেবা, মৃতদেহ স্বল্প সময়ে দেশে প্রেরণ ও কর্মস্থলে মৃত্যুবরণকারীদের ক্ষতিপূরণ আদায়সহ শ্রমিকদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে দূতাবাসের কার্যক্রম তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, বিগত দুই বছরে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পের মাধ্যমে প্রায় তিন হাজার প্রবাসীকে বিনা মূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ দেওয়া হয়েছে। তিনি স্বল্প ব্যয়ে ও বৈধ উপায়ে দেশে টাকা পাঠানোর লক্ষ্যে দূতাবাসের উদ্যোগ প্রবাসীদের অভিহিত করেন। তিনি সকলকে এ দেশের আইনকানুন মেনে চলার পরামর্শ এবং যেসব কাজে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হয় তা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান।

প্রবাসীরা তাদের বক্তব্যে দূতাবাসের বিভিন্ন কার্যক্রমে সন্তোষ প্রকাশ ও ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পসহ অসুস্থদের চিকিৎসার ব্যবস্থার প্রশংসা করেন। তারা ভবিষ্যতেও এ ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত রাখার জন্য রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ জানান।

বিজয় দিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোতালেব সরকার
বিজয় দিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোতালেব সরকার


মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তে বিজয় দিবস পালন

শীতের সকাল। তার ওপর ছুটির দিন। মূল শহর বৈরুতে ঠান্ডা পড়া শুরু হয়েছে। শহরের বাইরের অন্য জেলায় তুষারপাত চলছে। লেবাননে বাংলাদেশ দূতাবাসের অবস্থান রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে। আগেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল বিজয় দিবসের প্রভাতের অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তোলন করা হবে সকাল ৯টায়। ১০টা থেকে শুরু হবে বাংলাদেশি ডাক্তার দিয়ে প্রবাসীদের জন্য ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প। একই সঙ্গে দুই পাওয়া ছিল এবারের ১৬ ডিসেম্বর লেবাননে বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশিদের। এ জন্য সকাল থেকেই প্রবাসী ভাইবোনদের মধ্যে আলাদা একটি উৎসবের আবহ তৈরি হয়। শত শত প্রবাসীদের মিলনমেলাতে পরিণত হয় দূতাবাস প্রাঙ্গণ। এমনিতে নিজেদের মধ্যে খুব একটা যোগাযোগ হয় না প্রবাসীদের। ছুটির দিনগুলো ও বিভিন্ন জাতীয় উৎসবে তাই উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায় বাংলাদেশ দূতাবাসে।

ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প
ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প

দেশটিতে বাংলাদেশ দূতাবাস উদ্‌যাপন করেছে মহান বিজয় দিবস। সকালে প্রবাসী বাংলাদেশি ও দূতাবাসের কর্মকর্তাদের নিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোতালেব সরকার। পতাকা উত্তোলনের পর রাষ্ট্রদূত সকল প্রবাসীদের বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা ও বিকেলে বিজয় দিবসের আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প থেকে সেবা গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ জানান।

দূতাবাসের হলরুমে সকাল ১০টা থেকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে থাকা বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি চিকিৎসক দল লেবাননের প্রায় ৪৫০ জন প্রবাসীকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করে। চিকিৎসাসেবা বিকেল ৩টা পর্যন্ত চলার কথা থাকলেও প্রবাসীদের উপচে পড়া ভিড়ের কারণে তা চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। দূর-দূরান্তে থেকে আগত প্রবাসীদের জন্য দুপুরে হালকা আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়।

বিকেলে আলোচনা অনুষ্ঠান শুরুর আগেই দূতাবাসের হলরুমের টিভির পর্দায় দেখানো হয় বিজয় দিবসের ওপর প্রামাণ্যচিত্র ‘মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস’।

বিজয় দিবসের আলোচনা সভায় উপস্থিতি
বিজয় দিবসের আলোচনা সভায় উপস্থিতি

আলোচনার পর্বের শুরুতে সকল শহীদদের জন্য এক মিনিট নীরবতা পালন এবং বিজয় দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাণী পাঠ করা হয়। এরপর উপস্থিত বেশ কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশি বিজয় দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্যের ওপর বক্তব্য দেন। সবশেষে রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোতালেব সরকার বক্তব্য দেন।

রাষ্ট্রদূত তার বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের কথা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী ত্রিশ লাখ শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান ও তাদের সকলের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বিজয় বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্জন। মাত্র নয় মাসের যুদ্ধেই এত বড় অর্জন সম্ভব হয়েছিল।

ছবি: জহির রায়হান, বাবু সাহা, জসিম সরকার ও সাগর হাওলাদার।