টিয়ে রাজকন্যার আখ্যান-এক

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রাকিবের ঘুম ভাঙল ফোনের রিংয়ের শব্দে। ফোন ধরে দেখল ছোট ফুফু ফোন করেছেন। প্রায় ছয় সপ্তাহ পর তিনি ফোন দিয়েছেন। মাঝখানে ছোট ফুফুর সঙ্গে তিন-চারবার ফোনে কথা-কাটাকাটি হয়েছিল বলে তিনি এত দিন ফোন দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

রাকিব জানে ছোট ফুফু এমনই। তিনি যখন ফোন দেন, দিন নেই রাত নেই অযথাই ফোন দিয়ে অপ্রাসঙ্গিক আলাপ করবেন। আবার দেখা যায়, কোনো কারণ ছাড়াই তিনি সপ্তাহের পর সপ্তাহ ফোন দিচ্ছেন না। এবার না হয় এত দিন ফোন না দেওয়ার একটা যুক্তি আছে। ফোনে তিন-চারবার কথা-কাটাকাটি হয়েছে। কিন্তু গত এগারো বছর ধরে রাকিব দেখেছে, ছোট ফুফু প্রয়োজনের সময় ফোন দেওয়া বন্ধ করে দেন। রাকিব নিজ থেকে ফোন দিলেও ধরেন না।

রাকিব ফোন ধরে ঘুম জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করল, ছোট ফুফু, তুমি ভালো আছ তো। এত দিন পর?

ছোট ফুফু অভিযোগের গলায় বললেন, এত দিন পর হলেও তো আমিই ফোন দিয়েছি। তুই তো আর ফোন দিবি না। আমি বুঝতে পারছি না, তোকে ভেড়া না বলে বলদ নাকি অন্য কিছু ডাকব।

: সেই একই অভিযোগ ছোট ফুফু?

: হ্যাঁ, কারণ আমি মরে গেলেও তুই ফোন দিবি না।

: তোমার কী হয়েছে? শরীর খারাপ?

: শরীর খারাপ দিয়ে আর কী হবে! শরীর খারাপ হলে ভালো করার ওষুধ আছে। কিন্তু এদিকে আমার মনের ওপর দিয়ে যে তুফান যাচ্ছে?

: তুফান, কীসের তুফান!

: সে কথা তোকে বলে লাভ কী?

: তাহলে বলো না।

ছোট ফুফু ফোনের ওপাশে এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেলেন। তারপর নিজ থেকেই বললেন, আমার কপাল পুড়েছে রাকিব, আমার কপাল পুড়েছে...!

সাধারণত রাকিবের ছোট ফুফুর কোনো মন খারাপ করা কথা কখনই উদ্বেলিত করে না। রাকিবের বরাবরই মনে হয়, ছোট ফুফুর কোনো মন খারাপ হওয়া বা তার দুঃখকষ্টগুলো সম্পূর্ণ তার মনগড়া। তার নিজের তৈরি। এমনও দেখা যায়, তিনি এক সপ্তাহ আগেই ছোট ফুপা বা ছেলেকে নিয়ে এক শ একটা মন্দ কথা বলছেন। এমনকি ফোনে কান্নাকাটি করে অস্থির হয়ে গেছেন। ছোট ফুপা বা ছেলের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করেছেন। কিন্তু পরের সপ্তাহেই আবার তিনি তাদের ব্যাপারে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ফোনে একগাদা প্রশংসার বাক্য ব্যয় করছেন।

রাকিব তারপরও আজ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার কপাল পুড়েছে কেন? রাতুলের কিছু হয়েছে?

ছোট ফুফু বললেন, রাতুলের কী হবে? সেতো সেই কালি মেয়েটাকে নিয়েই ধেই ধেই করে নাচছে। ওটা আমি মেনেই নিয়েছি। কিন্তু আমার বয়সটা আমার কপাল পুড়েছে।

: বয়স আবার কপাল পোড়ে কীভাবে?

: সেটা তুই বুঝবি না।

: আমি না বুঝলে আমাকে এ কথা বলছ কেন?

: দেখ, তুই আমার মেজাজটা আবার খারাপ করবি না।

: আচ্ছা, ঠিক আছে। এখন বলো, তোমার কী হয়েছে?

: বললাম না, আমার বয়সটা আমার কপাল পুড়েছে।

: তুমি তো বলো, তোমার বয়স হয়নি। আচ্ছা, বাদ দাও ওই কথা। সবারই তো বয়স হয়। তোমারটা আবার আলাদা কেন হবে?

: আমারটা মনে হয় অসময় এসে গেছে। না হলে তোর ছোট ফুপার এই রূপ দেখব কেন?

: ছোট ফুপার আবার কী হলো?

: কী হয়নি? তার ভীমরতি ধরেছে?

: ভীমরতি! ছোট ফুপার, কী ভীমরতি ধরেছে?

: তোর ছোট ফুপা এই বুড়া বয়সে হাঁটুর বয়সী এক মেয়ের সঙ্গে চক্কর চালাচ্ছে।

: কী যা-তা বলছ তুমি?

: আমি ঠিকই বলছি।

: কী চক্কর চালাচ্ছেন?

: আমার বয়স হয়েছে। আমাকে এখন বাদ দেওয়ার খাতায় নাম দিয়েছে। তাই এক যুবতী মেয়ে নিয়ে দুই দিন পরপর অফিসের কাজের নাম করে মেলবোর্ন যাচ্ছে।

: তোমাকে ওটা কে বলেছে?

: আমাকে কেউ বলেনি। আমি খুঁজে বের করেছি।

: তুমি কীভাবে খুঁজে বের করেছ?

: তার অফিসে গিয়ে।

: তুমি তো ভুল তথ্যও পেতে পার। আমি ছোট ফুপাকে যত দূর জানি, তিনি খুব ভালো একজন মানুষ।

: তুই কি আমার চেয়ে বেশি জানিস? আমি তার সঙ্গে প্রায় দুই যুগের বেশি সময় সংসার করছি।

: তা জানি না। তবে আমি মানুষ চিনি।

ছোট ফুফু একটু ক্ষেপে গিয়ে বললেন, তুই তোর মানুষ চেনা নিয়ে থাক। তোর সঙ্গে কথা বলাটাই আমার বৃথা।

রাকিব কিছু বলল না। নিজে নিজে হাসল। ছোট ফুফু যাই বলুক, ছোট ফুপা রাকিবের বরাবরই পছন্দের মানুষ। তিনি সচেতনভাবে এমন কোনো কাজ করবেন না। মানুষের অসচেতনতা বলতে একটা কথা আছে। অসচেতনভাবে অনেক ভালো মানুষও বড় ধরনের ভুল করে বসেন। ছোট ফুপা আবার সে ধরনের কিছু করেননি তো?

ছোট ফুফু ফোনের ওপাশে হতাশা ব্যক্ত করে ভেজা গলায় বললেন, আমি কাকে যে আমার দুঃখের কথা বলব? আমার তো আপন কেউ নেই...!

রাকিব জানে, ছোট ফুফু খুব উচ্চাভিলাষী ধরনের নারী। বেশ স্বার্থপর। প্রয়োজনে আত্মীয়স্বজনকে ভুলে যেতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। কিন্তু তারপরও এ মুহূর্তে ছোট ফুফুর ভেজা গলা শুনে রাকিবের কেন জানি মনটা ভারী হয়ে গেল। ভাবল, সংসার জীবনে অনেক নারীই তো প্রয়োজনে উচ্চাভিলাষী ও স্বার্থপর হয়। তার মা কি উচ্চাভিলাষী ও স্বার্থপর হননি? তার বাবা বোকাসোকা বলে তার চার বছর বয়সে মা তাকে ফেলে অন্যের হাত ধরে চলে যাননি? ছোট ফুফু না হয় সেই স্বার্থপরতা করেননি। কিন্তু তিনি উচ্চাভিলাষী হয়ে সেই পর্যায়েরই একজন না হয় হয়েছিলেন?

রাকিব জিজ্ঞেস করল, মেয়েটা কে?

ছোট ফুফু জিজ্ঞেস করলেন, কোন মেয়েটা?

: ওই যে বললে, ছোট ফুপার সঙ্গে মেলবোর্ন না কোথায় যায়?

: তোর ছোট ফুপার সঙ্গে একই অফিসে কাজ করে। জুনিয়র।

: মেয়েটা কি বাঙালি?

: হ্যাঁ। সিডনি ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করে বছর খানেক আগে তোর ছোট ফুপার অফিসে জয়েন করেছে।

: একই অফিসে যেহেতু কাজ করে, তারা নিশ্চয়ই অফিসের কাজে যায়?

: আরে নারে, রাকিব। আমি তার স্ত্রী। স্ত্রীরাই তাদের স্বামীকে সহজে বুঝতে পারে। আর তোর ছোট ফুপা রাত এগারোটা-বারোটার সময় বাথরুমে বসে ওই মেয়ের সঙ্গে কী এমন অফিসের আলাপ করে? আমার কপাল পুড়েছে রে, আমার কপাল পুড়েছে...!

রাকিব তার ছোট ফুফুর সঙ্গে আর কথা বাড়াতে পারল না। কিছু কিছু দুঃখের কথা সবার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। রাকিবও ছোট ফুফুর সঙ্গে এগিয়ে নিতে পারল না।

রাকিব ফোন রাখার পর বেশ অনেকক্ষণ ঝিম মেরে বেডের ওপর লেপ মুড়ি দিয়ে বসে রইল। এখন সবে সাতটা বাজে। রাকিব সিডনির সময়টা হিসাব করল। এখন ওখানে চারটা বাজে। ছোট ফুফু তাহলে তাকে এত ভোররাতে ফোন দিয়েছেন? ছোট ফুপা গত দুই দিন ধরে অফিসের কাজে বা সেই মেয়েটার সঙ্গে মেলবোর্নে। ছোট ফুফুর নিশ্চয়ই সেটা ভেবে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে?

ছোট ফুফু ছোট ফুপার চেয়ে বয়সে মাত্র দুই বছরের ছোট। ছোট ফুফু ছোট ফুপাকে যতই পেট মোটা বা চাঁদনি টাকওয়ালা বলুক, ছোট ফুপাকে কিন্তু এত বয়স্ক মনে হয় না। বরং ছোট ফুফুকেই যেকোনো কারণেই হোক বয়স্কা মনে হয়।

রাকিব জানে, ছোট ফুফু ও ছোট ফুপা দুজনেরই বয়স এখন পঞ্চাশ বা পঞ্চাশের ওপরে। হেস্টিংসের রিনেই ভাবি এক রাতে দুঃখ করে বলেছিলেন, নারীদের বয়স হয়, পুরুষদের হয় না। নারীরা পঁয়তাল্লিশ বা পঞ্চাশ হলেই বয়স বেড়ে যাওয়ার হতাশায় ডুবে যায়। তখন মনেপ্রাণে নতুন করে যৌবন ফিরে পেতে চায়। তাদের মধ্যে স্বামীর প্রতি সন্দেহ ঢুকে যায়। নিজের প্রতিও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। কিন্তু পুরুষদের পঞ্চাশ কী ষাট বছর বয়সেও সেই হতাশা এসে ভিড় করে না। বরং ওরা দিব্যি নিজেদের যুবক ভেবে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।

বাইরে আজ চমৎকার রোদ উঠেছে। বসন্ত এখনো আসি আসি করে আসছে না। বসন্ত এ জন্যই আসি আসি করে আসছে না, কারণ এখনো ডে-লাইট সেভিংস শুরু হয়নি। রাকিব বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। শরীরের আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে সে আবার ঘড়ি দেখল। এখন সাতটা পাঁচ বাজে। আজ তার অফিস আছে। আজ বুধবার। ছোট ফুফুর ফোনে খুব সকাল সকালই তার ঘুমটা ভেঙে গেল।

রাকিব মোবাইলটা হাতে নিয়ে আবার রেখে দিল। ছোট ফুফু প্রথমে মোবাইলে ফোন দিয়েছিলেন। মোবাইলে তিনবার রিং বাজার পর রাকিব মোবাইলটা ধরতে যাবে, ঠিক তখনই তিনি কেটে দিয়ে ল্যান্ড লাইনে ফোন দেন।

রাকিব অবশ্য আজকাল মোবাইলের রিং টোন অফ করে রাখে না। মোবাইলও বন্ধ রাখে না। সব সময়ই অন রাখে। এটা সে করছে নদীর অনুরোধে। আজকাল সে নদীর কথা বেশ শোনে। তার নদীর কথা শুনতে ভালো লাগে। কারণ নদী তার সত্তার ভেতর এমনভাবে ঢুকে গেছে, এখন সবকিছুতেই যেন নদী দৃশ্যে-অদৃশ্যে তাকে স্পর্শ করে!

রাকিব আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে পারত। সাড়ে সাতটা কী পৌনে আটটা পর্যন্ত শুয়ে থাকলে কোনো সমস্যা ছিল না। আটটার দিকে উঠে তৈরি হয়ে কোনোমতে এক কাপ ব্ল্যাক কফি খেয়ে সাড়ে আটটার দিকে অফিসের উদ্দেশে বের হলে হতো। সে সচরাচর তাই করে। একে তো ছোট ফুফুর ফোনের কারণে সে আজ একটু আগে উঠেছে। দ্বিতীয়ত সে গত রাতে একটা কবিতা লিখেছে। এখন বাথরুম সেরে কিচেনে গিয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে এনে সেই কবিতাটা নিয়ে বসবে। আরও ঘষামাজা করবে।

রাকিব বেডরুম থেকে বের হয়ে বাথরুমে যেই ঢুকতে যাবে ঠিক তখনই তার মোবাইলটা বেজে উঠল। সে মনে করল, হয়তো তার ছোট ফুফু আবার ফোন দিয়েছেন। ছোট ফুফু যেভাবে মন খারাপ করে ফোন রেখেছেন, এতে তিনি আবার ফোন দিতেই পারেন।

রাকিব আবার বেডরুমে ফিরে এল। মোবাইল হাতে নিয়ে মোবাইলের এলইডি স্ক্রিনে দেখল, নদীর ফোন। সে বেশ অবাক হলো। এ সময় নদী ফোন দিয়েছে?

রাকিব আস্তে করে বলল, হ্যালো।

নদী জিজ্ঞেস করল, সরি, ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম নাতো?

: না, আমি ঘুম থেকে উঠে গেছি।

: আমি জানতাম। আপনি তো এ সময় ঘুম থেকে উঠে লেপ মুড়ি দিয়ে কোনো কবিতা ঘষামাজা করেন, তাই না?

রাকিব হেসে বলল, সব সময় করি না।

নদী বলল, মাঝেমধ্যে তো করেন?

: তা করি। কিন্তু আজ আমার ঘুম একটু আগেই ভেঙে গেছে। ছোট ফুফু সিডনি থেকে ফোন দিয়েছিলেন।

: ও আচ্ছা। তা আজ কোনো কবিতা ঘষামাজা করবেন না?

: তা করব। তবে এখন আগে এক কাপ ব্ল্যাক কফি বানাব। তারপর কফি হাতে গত রাতের লেখা কবিতাটা ঘষামাজা করব।

: কী কবিতা লিখেছেন?

: সেটা ঘষামাজা না করা পর্যন্ত বলা যাবে না।

: আমি যে ঘষামাজাহীন আনকোরা কবিতাটা শুনতে চাই।

: তুমি শুনতে চাইলেও আমি শোনাতে পারব না।

: কেন? আমি আপনার একজন ভক্ত শ্রোতা। আপনি শোনাবেন না কেন?

: আমি ফোনে কবিতা শোনাতে পছন্দ করি না।

: তাহলে এখন বাসায় আসি?

: এখন তুমি বাসায় আসবে?

: আসলে কোনো অসুবিধা হবে?

: না, তা অসুবিধা হবে কেন? তবে আমার অফিস কিন্তু নয়টায়। আমাকে সাড়ে আটটা বা আটটা পঁয়ত্রিশের মধ্যে বের হয়ে যেতে হবে।

: আমি না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত থাকব।

রাকিব একটু অবিশ্বাসের গলায় বলল, দেখ নদী, আমি কিন্তু বিশ্বাস করছি না যে তুমি এখন আসবে।

নদী ফোনের ওপাশে খিল খিল করে হেসে ফেলল। বলল, আমি জানি আপনি বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু আমি আসব। আপনার আনকোরা কবিতাটা শুনতে আসব।

রাকিব ফোনের এ পাশে চুপ হয়ে গেল।

নদী জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, চুপ হয়ে গেলেন কেন? তাহলে কিন্তু আসব না।

রাকিব জিজ্ঞেস করল, তুমি সত্যি আসবে?

নদী বলল, হ্যাঁ। তবে আমি নাশতা করে আসব। আপনার সঙ্গে বসে শুধু কফি খাব। ব্ল্যাক কফি। আপনার মতো চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফি না। আমার কফিতে তিন চামচ চিনি দিতে হবে।

রাকিব তবুও অবিশ্বাসের গলায় বলল, আচ্ছা, আস।

রাকিব যদিও অবিশ্বাস করছে যে এ সময় নদী আসবে না। তারপরও সে বাথরুম থেকে বের হয়ে তাড়াতাড়ি অফিসের কাপড়চোপড় পরে তৈরি হয়ে কিচেনে এল। হট ওয়াটার জগে পানি নিয়ে সুইচ অন করে দিল। শেলফ থেকে দুটো কাপ নিয়ে বেঞ্চটপের ওপর রেখে পরিমাণ মতো ইনস্ট্যান্ট কফি নিল। নদীর কাপে আলাদা করে তিন চামচ চিনিও নিল। যদিও সে চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফি পছন্দ করে, কিন্তু আজ সে তার নিজের কাপেও এক চামচ চিনি নিল। হট ওয়াটার জগে বুদ্‌বুদ শব্দ হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পানিতে বলক উঠবে। তারপর শিস দিয়ে ধোঁয়া বের হবে।

রাকিব হট ওয়াটার জগের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কিচেনের একপাশে বেঞ্চটপ ঘেঁষে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। তার এখনো মনে হচ্ছে না নদী আসবে। এটা সত্যি যে নদী আবেগী মেয়ে। ছোট ছোট ব্যাপারে খুব উচ্ছল হয়ে ওঠে। কখনো কথা বলতে চাইলে থামতে চায় না। ভেতরটা একদম পানির মতো সরল। কিন্তু তারপরও এ সময় শুধুমাত্র একটা কবিতা শোনার জন্য নদী তার বাসায় আসবে, এটা সে মনে মনে বিশ্বাস করতে পারল না। হট ওয়াটার জগে পানির বলক ওঠার পরও সে কফির কাপে ঢালল না। ভাবল, আগে নদী আসুক।

রাকিব নদীর অপেক্ষায় দরজার দিকে তাকিয়ে রইল।

নদী ঠিকই এল। ঠিক পৌনে আটটার সময় সে দরজায় এসে নক করল।

রাকিব দরজা খুলে একটা দিঘল হাসি দিয়েই দেখল, নদীর হাতে একটা ডিএইচএলের পার্সেল। রাকিব বলল, আস, ভেতরে আস।

নদীও একটা দিঘল হাসি দিয়ে ভেতরে ঢুকল। পার্সেলটা বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল, এটা খোলেন।

: এটা কী?

: আহা, খুলেই দেখেন না।

রাকিব পার্সেলের গায়ের লেখাটা দেখল। ওখানে নদীর নাম লেখা। জিজ্ঞেস করল, এটা আমি খুলব কেন?

নদী পাল্টা জিজ্ঞেস করল, আপনি খুলবেন না কেন?

: এটা যে তোমার নামে এসেছে। মনে হচ্ছে, তোমার মা পাঠিয়েছেন।

: জি, মা পাঠিয়েছেন। মা বাংলাদেশ থেকে পার্সেলটা পাঠিয়েছেন।

: তাহলে আমি খুলব কেন?

নদী জোর দিয়ে অধিকারের গলায় বলল, আমি আপনাকে খুলতে বলছি, খোলেন।

রাকিব এবার দ্বিরুক্তি না করে পার্সেলটা খুলল। খুলেই দেখল, ভেতরে একটা টিয়ে রঙের শাড়ি! শাড়িটা দেখেই রাকিব স্বভাবের বিরুদ্ধে খুব উৎফুল্ল হয়ে উঠল। কেমন কল কল করে হেসেও উঠল। বলল, টিয়ে রঙের শাড়ি? বাংলাদেশ থেকে এনেছ?

নদী উজ্জ্বল চেহারায় বলল, জি, মা পাঠিয়েছেন। গতকাল বিকেলের দিকে নাবিদ ভাইয়ার দোকান হয়ে জুঁই ভাবির সঙ্গে তাদের বাসায় গিয়েছিলাম। রাতে ডিনার করে বাসায় ফিরি। বাসায় ফিরেই পার্সেলটা হাতে পাই। শিমুল ভাবি রিসিভ করেছিলেন। আমি জানতাম পার্সেলের ভেতর শাড়ি। তাই আমি আর রাতে খুলিনি। আসলে আপনার হাত দিয়ে খোলাব বলে খুলিনি।

: এ জন্য তুমি এখন এসেছ?

: জি, কবি সাহেব!

: কবিতা শুনবে বলেছিলে, ওটা একটা বাহানা ছিল?

নদী খিলখিল করে হেসে বলল, জি।

রাকিব বলল, এখানেই তুমি...!

নদী জিজ্ঞেস করল, এখানেই আমি কী?

: থাক, কিছু না।

: আচ্ছা, ঠিক আছে। সেটা না হয় পরে শুনব। এখন বলেন, শাড়ির রংটা ঠিক আছে তো?

: একদম ঠিক আছে।

: কবে পরে আসব?

: তোমার যেদিন ইচ্ছে হবে।

নদী জোর দিয়ে বলল, আহা, বলেন না, কোনদিন?

রাকিব আবেগের গলায় বলল, বললাম তো, তোমার যেদিন ইচ্ছে। উইকএন্ড না হয়ে যদি উইক ডে হয়, সেদিন প্রয়োজনে অফিস থেকে ছুটি নেব। সেদিন আমরা সারা দিন ঘুরব। দূরে কোথাও যাব। অনেক দূরে! (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন