প্রবাসীর বিজয় উদ্যাপন

বিজয় দিবসে দিনের শুরুতে বাংলাদেশের জার্সিতে ছেলেমেয়েসহ লেখক
বিজয় দিবসে দিনের শুরুতে বাংলাদেশের জার্সিতে ছেলেমেয়েসহ লেখক

‘স্বাধীনতা তুমি

রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-’

ডিসেম্বরের শুরু থেকেই আমার মেয়ে তাহিয়া শামসুর রাহমানের স্বাধীনতা তুমি কবিতা আবৃত্তি করে চলেছে সারা বাড়িময়। উঠতে বসতে খেতে ঘুমাতে তাই সেটা শুনতে শুনতে আমার নিজেরই প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে। যদিও ছাত্রজীবন থেকেই কবিতা আমার দুই চোখের বিষ। কারণ কবিতার প্রথম আট লাইন মুখস্থ করতে হতো বাধ্যতামূলকভাবে। আর আমার মুখস্থ বিদ্যা ভয়ংকর রকমের খারাপ। মেয়েকে কারণ জিজ্ঞেস করতে জানতে পারলাম, তাদের বাংলা স্কুলে বিজয় দিবস উদ্‌যাপন উপলক্ষে তাকে এই কবিতার সংক্ষেপিত একটা সংস্করণ দেওয়া হয়েছে। তাহিয়া ও তার এক সহপাঠী মিলে সেটা ১৬ ডিসেম্বর আবৃত্তি করবে। তাহিয়া মুখ চোখ শক্ত করে সেটা সারাক্ষণ আওড়ে যাচ্ছে আর একটু পরপরই আমাকে ও তার মাকে সেটা ধরতে বলছে। তখন তাহিয়া না দেখে বলে নিশ্চিত হয়ে নিচ্ছে যে তার ঠিকমতো মুখস্থ হয়েছে কিনা।

বাংলা স্কুলের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে লাল সবুজে শিশুরা
বাংলা স্কুলের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে লাল সবুজে শিশুরা

কবিতা মুখস্থ করার পাশাপাশি তাহিয়া গত কদিন বাংলাদেশের স্মৃতিসৌধের ওপর একটা প্রজেক্ট তৈরি করছে। একটা বড় ড্রয়িং পেপারে সুন্দর করে স্মৃতিসৌধ এঁকেছে। তার সঙ্গে ফাঁকা জায়গাগুলোতে আরও কিছু তথ্য যোগ করেছে। যেমন ওপরের বাম দিকের কোনায় বাংলাদেশের একটা মানচিত্র প্রিন্ট করে তার ওপর একটা বড় ডট দিয়ে স্মৃতিসৌধের জায়গাটা নির্দেশ করছে। আর ডান দিকের কোনায় স্থপতি সৈয়দ মইনুল হোসেনের ছবি জুড়ে দিয়েছে। এ ছাড়া, ইন্টারনেট ঘেঁটে স্মৃতিসৌধের প্রায় সব তথ্যই জোগাড় করে ফেলেছে। স্মৃতিসৌধে মোট কয়টা স্তম্ভ আছে ও সেগুলো কী কী বোঝায় এমন সব তথ্যই এখন তার নখদর্পণে। আর কিছু কিছু শব্দ না বুঝলে আমাকে আর তার মাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিচ্ছে।

প্রবাসের ব্যস্ত জীবনে রুটিন জীবনের বাইরে গিয়ে আলাদাভাবে নিজের শেকড়ের ভাষা শিক্ষা করাটা রীতিমতো বিলাসিতা। তবুও সপ্তাহের মাত্র দুটি ছুটির দিনের একটি নষ্ট করে আমরা ওকে বাংলা স্কুলে পাঠাই। যার ফলে তাহিয়া তার বাংলাদেশ থেকে শেখা বাংলা ভাষাটা পরিবারের বাইরে চর্চা করার একটা সুযোগ পাচ্ছে। এখন সে বাংলাদেশের সবগুলো জাতীয় দিবসের তারিখ জানে। আর এই তারিখগুলো জানার সঙ্গে সঙ্গেই এগুলোর ইতিহাস জিজ্ঞেস করে। তখন তাকে অনেক সময় নিয়ে সেগুলো ব্যাখ্যা করতে হয়। এভাবেই তাহিয়া এখন বাংলাদেশ নিয়ে অনেক বেশি গর্ব করে। শপিং মলে গেলে কোনো কিছুর গায়ে মেড ইন বাংলাদেশ দেখলে উচ্ছ্বসিত হয়ে চিৎকার করে ওঠে আর আমাদের ডেকে দেখায়। বিশেষ করে পোশাকের দোকানগুলোতে গেলে এটা ঘটে অহরহই।

বিজয় দিবসে লাকেম্বায় অস্থায়ী স্মৃতিসৌধ
বিজয় দিবসে লাকেম্বায় অস্থায়ী স্মৃতিসৌধ

এবারের ১৬ ডিসেম্বর রোববার হওয়ায় আমরাও একই দিনে বিজয় দিবস পালন করার সুযোগ পেলাম। আর ওই একই দিনই বাংলা স্কুলের কার্যক্রম চলে। তাই আমরা মোটামুটি সারা দিনের একটা কর্মপরিকল্পনার চার্ট তৈরি করে ফেললাম। সকালে উঠেই তাহিয়া তার বাংলাদেশের জার্সি খুঁজে দিতে বলল, সেই সঙ্গে আমাকে ও রায়ানকেও বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের জার্সি পরতে বলল। ওর মা বলল, স্কুলে সালোয়ার কামিজ পরতে হবে। তাই তুমি জার্সি পরতে পারছ না। আর রায়ানেরও একটা লাল সবুজ পাঞ্জাবি আছে। আমি বললাম, তাহলে স্কুলে যাওয়ার আগে আমরা একটা ছবি তুলে রাখি জার্সি পরে। ছবি তোলার শেষে সাজগোজ করার পালা। তাহিয়াকে তার মা লাল সবুজ পোশাকের পাশাপাশি মাথায় লাল সবুজ রঙের ক্লিপ পরিয়ে দিল। ক্লিপ চারটা দেখতে এত সুন্দর লাগছিল যে, আমি তার একটা ছবি তুলে রাখলাম। তাহিয়াকে সেটা দেখানোর পর সে অনেক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলল, বাবা বাংলাদেশের পতাকা আমার মাথায়। আমি বললাম, তার মানে তুমিই বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি সম্মান দেখালে।

বিজয়ের সাজে সাত্তারের পরিবার
বিজয়ের সাজে সাত্তারের পরিবার

বাংলা স্কুলে গিয়ে আমার মনে হচ্ছিল আমরা যেন বাংলাদেশের স্মৃতিসৌধে চলে এসেছি। সবাই লাল সবুজে সেজে সেখানে উপস্থিত। তারপর ক্লাসরুমে তারা একে একে তাদের পরিবেশনা উপহার দিয়ে গেল। এভাবে দুই ঘণ্টা সময় দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল। আমি মনে মনে একটু তাড়াহুড়ো করছিলাম। কারণ ওখান থেকে আমরা সিডনির বাংলাদেশ পল্লি খ্যাত লাকেম্বাতে যাব। লাকেম্বাতে একটা বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ অস্থায়ী স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছে। আমার পরিকল্পনা হচ্ছে, আমার ছেলেমেয়ে দুজনকে সেটা দেখানো। বিশেষ করে আমার মেয়েকে। কারণ স্কুলে সে এটার ওপরই প্রজেক্ট জমা দিয়েছে। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ড্রাইভ করে লাকেম্বা পৌঁছাতে হয়। ফেসবুকে দেওয়া ছিল সকাল নটা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত থাকবে। কিন্তু আমাদের দেরি হয়ে যাওয়াতে একজনকে ফোন করে জানলাম, অস্থায়ী স্মৃতিসৌধটা সেখানে সারা দিনই থাকবে।

লাকেম্বার রেলওয়ে প্যারেডে পৌঁছাতেই মনটা ভালো হয়ে গেল। রাস্তার পাশের খুঁটিগুলোতে সুতলি টানিয়ে বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাহিয়া বলল, বাবা দেখ দেখ বাংলাদেশের পতাকা। সারি বেঁধে বাংলাদেশের পতাকা পতপত করে উড়ে সিডনিতে বাংলাদেশের অস্তিত্বের জয়গান করে চলেছে। স্মৃতিসৌধের জায়গাটা অনেক সুন্দর করে সাজানো। পেছনেই একটা বড় গাছ জায়গাটার সৌন্দর্য অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। স্মৃতিসৌধের একপাশে রাখা হয়েছে বাংলাদেশের একটা বড় জাতীয় পতাকা। অন্যপাশে রাখা হয়েছে একটা বালতির মধ্যে একগুচ্ছ ফুল। যাতে করে যে কেউ এসে এই ফুল দিয়ে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে পারেন। পুরো আয়োজনটা অনেক ক্ষুদ্র, কিন্তু অনেক গোছানো মনে হলো। আমরা স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মৃতিসৌধের দুই পাশে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার গিন্নি সেই মুহূর্তের ছবি তুলে দিল।

লেখকের মেয়ের আঁকা স্মৃতিসৌধের প্রজেক্ট
লেখকের মেয়ের আঁকা স্মৃতিসৌধের প্রজেক্ট

শ্রদ্ধা জানিয়ে ফেরার পথ ধরতেই অপরিচিত গলায় ডাক শুনে পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি বুয়েটের একজন জুনিয়র সাত্তার সেও সপরিবারের এসেছে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে। আমাদের তাড়া ছিল, তাই ওদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেই ফেরার পথ ধরলাম। সাত্তারের মেয়েটা ততক্ষণে গাড়ি থেকে নেমে এসেছে। মেয়ে মুখ ভার করে রেখেছে দেখে ওর মা-বাবা কারণ জানতে চেয়ে জানতে পারল আমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারেনি বলে ওর মন খারাপ করেছে। সাত্তার তাড়াতাড়ি করে ওকে আবার আমাদের কাছে নিয়ে এল। তখনো সে অভিমান করে গাল ফুলিয়ে রেখেছে। আমি কম সময়ে অনেক কথা বলে ওর অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা করলাম। তখন আমার আবার স্বাধীনতা তুমি কবিতার দুটো লাইন বারবার মনে পড়ছিল—

‘স্বাধীনতা তুমি
খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা,
খুকির অমন তুলতুলে গালে
রৌদ্রের খেলা।’