তুষারের দেশে

বিচের আকাশে সব সময় অসংখ্য পাখিরা উড়ে বেড়ায় নির্ভয়ে
বিচের আকাশে সব সময় অসংখ্য পাখিরা উড়ে বেড়ায় নির্ভয়ে

ইউক্রেনে এসেছি প্রায় নয় মাস হতে চলেছে। আমরা শীতের একেবারে শেষের সময় এসেছিলাম। ওদেসার (Odessa০ নিশ্চুপ বিমানবন্দরে যখন আমাদের বিমানটা অবতরণ করেছিল, তখন মনের মধ্যে অনেক ভয় কাজ করছিল। সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। তার ওপর আকাশ সমান দায়িত্ব। যখন প্লেনের বাইরে একটা পা রাখলাম, মুখের মধ্যে তীব্র হিমশীতল বাতাসের ঝাপটা আরেকবার মনে করিয়ে দিল সামনের কঠিন পথটাকে। যত দূর চোখ যায় কেবল বরফ আর বরফ। প্লেন থেকে অনেকটা পথ সাদা শুভ্র বরফের গালিচার ওপর দিয়ে হেঁটে আসতে হলো ইমিগ্রেশন রুমে। ইমিগ্রেশনের ঝামেলা শেষ করে বাইরে বের হতেই তুষারঝড়! জীবনে প্রথম এই শুভ্র সৌন্দর্যটাকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হলো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে এসে লাগেজ রেখে কিছু দরকারি কেনাকাটা করার জন্য বাইরে বের হলাম। কেনাকাটা শেষে আপাতত রাতে খাওয়ার জন্য শর্মা নিলাম। হোস্টেলে ফিরে ডিনার করে পরদিন সবাই ব্ল্যাক সি (কৃষ্ণসাগর) দেখতে যাওয়ার প্ল্যান করে ঘুমাতে গেলাম। উত্তেজনা আর তীব্র ক্লান্তির মিশেলে রাতের ঘুমটা ভালোই হলো।

অনেক পরিপাটি করে সাজানো ডলফিন বিচ
অনেক পরিপাটি করে সাজানো ডলফিন বিচ

সকালে উঠে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি সবই সাদা। শুভ্র সাদা। সাদা রং এমনিতেই আমার অনেক প্রিয়। সকালে চারপাশে এত সাদা দেখে মনটা ভরে গেল। আমাদের সবার মনগুলোও যদি এমন শুভ্র সাদা হতো!

এসব ভাবতে ভাবতে বাইরে যাওয়ার সময় হয়ে গেল। বাইরের শীতের অবস্থা দেখে একেকজন পাল্লা দিয়ে শীতের পোশাক পরতে লাগল। পোশাক পরার পর একেকজনের ওজন কম করে হলেও ৭-৮ কেজি বেড়েছে। এখানে শীতের মধ্যে এই কাপড় পরার বিড়ম্বনা সবচেয়ে বেশি ভোগায়। আরেকটা ব্যাপার খুব বিপজ্জনক, বরফে পা পিছলে পড়ে যাওয়ার ভয়! একবার পড়লে হাত–পা কাটা নিশ্চিত।

রাস্তায় গুটি গুটি পা ফেলে বাস স্টপে গিয়ে আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে রওনা হলাম। খুব বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। মাত্র ২০ মিনিটের পথ। বাস থেকে নেমেই সমুদ্রের গর্জন শুনতে পেলাম। এই বিচটা ডলফিন বিচ নামে পরিচিত। অনেক নিচে, অনেকগুলো সিঁড়ি মাড়িয়ে বিচে নামতে হয়।

অনেক পরিপাটি করে সাজানো ডলফিন বিচটা। তুষারের আবরণে ঢাকা বিচের সবটুকু অংশই। কিছু বাচ্চা তুষার নিয়ে খেলা করছে। এ যেন আমাদের দুরন্ত শৈশবের চঞ্চলতার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।

দীর্ঘ একটা নিশ্বাস নিয়ে সামনে তাকালাম। সামনে যত দূর চোখ যায় সুবিশাল নীল জলরাশি আর ওপরে অসীম নীল বিস্তৃত দিগন্ত। চারদিকে নীলের ছড়াছড়ি। শুনেছি বেদনার রং নাকি নীল হয়। তবে এই বাক্য এখানের জন্য নয়। এখানকার নীল বেদনার পরিবর্তে আপনার মনকে ভালো লাগার প্রশান্তি এনে দেবে।

এই বিচটাতে অনেক পর্যটক আসেন তাদের অবসর সময়গুলোতে। কেউ আসেন পরিবার নিয়ে, কেউ বন্ধু আবার কেউবা তার ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে।

অনেক পরিপাটি করে সাজানো ডলফিন বিচ
অনেক পরিপাটি করে সাজানো ডলফিন বিচ

সাগর সেদিন ছিল বেশ উত্তাল। সাবধানতার জন্য পুরো বিচটাই রেলিং দিয়ে ঘেরা। উত্তাল ঢেউগুলো প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতায় আছড়ে পড়ছে রেলিংয়ের প্রাচীরে। দেখে মনে হচ্ছে ঢেউগুলো একে অপরের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। বিচের চারপাশটা অসংখ্য ছোট ছোট ক্যাফেতে ভরপুর। সেখানে ফাস্ট ফুড জাতীয় খাবার বিক্রি হয়। এ ছাড়া, সমুদ্রের কোল ঘেঁষে দুই তিনটি বড় রেস্টুরেন্ট রয়েছে। খাবারের দাম অস্বাভাবিক বেশি। বিচের শুরুতেই একটা মিউজিয়াম রয়েছে। মিউজিয়ামের ভেতরে ডলফিন দেখার ব্যবস্থা আছে। আমরা ডলফিন দেখার জন্যই ভেতরে গেলাম এবং জীবনে প্রথমবারের মতো এত কাছ থেকে ডলফিন দেখতে পেলাম। ডলফিন ছাড়াও মিউজিয়ামে নানা রকম সামুদ্রিক মাছ রয়েছে। ছোটখাটো কিছু স্টল রয়েছে টুকটাক কেনাকাটা করার জন্য।

বিচের আকাশে সব সময় অসংখ্য পাখিরা উড়ে বেড়ায় নির্ভয়ে। এখানকার পাখিরা বেশ বন্ধুভাবাপন্ন। ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে সবাই এই পাখিগুলোর জন্য খাবার কিনে আনে। রুটির টুকরোগুলো যখন ছিঁড়ে শূন্যে সাগরের বুকে ছুড়ে মারা হয়, ঠিক সেই মুহূর্তেই পাখিগুলো পানিতে পড়ার আগ মুহূর্তে তা ঠোঁটে নিয়ে নেয়। বেশ মজার দৃশ্য এটা।

এদের সাগরের সঙ্গে অনেক সখ্য। শহুরে যান্ত্রিকতার মাঝে থাকতে থাকতে অশান্ত মনটাকে প্রশান্তির শীতলতা এনে দেয় তাদের এই ব্ল্যাক সি। এদিকে প্রচণ্ড শীতে আমাদের সবার অবস্থা তখন খারাপ। তাই সবাই ওই দিনের মতো ব্ল্যাক সিকে বিদায় জানিয়ে হোস্টেলের পথ ধরলাম।

লেখকের ইমেইল: <[email protected]>