দেখে মনে হলো অনেক দিনের চেনা

লেখক
লেখক

অর্থ আছে শর্ত নেই। দেহ আছে কিন্তু তার দেখা নেই। ইচ্ছে আছে উপায় নেই। সে কোন জাতি? সে এক বোরকার মধ্যে লুকিয়ে থাকা আরবের নারী জাতি।

ঘুরে এলাম সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেখে এলাম পরিবর্তনের রংধনু। আরব উপদ্বীপে পারস্য উপসাগরের দক্ষিণ-পূর্বে ও ওমান উপসাগরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত একটি দেশ। সংযুক্ত আরব আমিরাত সাতটি আমিরাত নিয়ে গঠিত। এটি একটি যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়। সাতটি আমিরাতের মধ্যে ছয়টি (আবুধাবি, দুবাই, শারজাহ, আজমান, উন্মুল কুয়াইন ও ফুজিরা) ওই দিন সংযুক্ত হয়। সপ্তমটি রাস-আল-খাইমা ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রে যোগদান করে।

উনিশ শতকে ব্রিটিশদের স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি অনুসারে সাতটি রাষ্ট্র পূর্বে চুক্তিবদ্ধ রাষ্ট্র নামে পরিচিত ছিল। সাতটি মরুভূমির সমন্বয়ের এই দেশটি গড়ে উঠতে শুরু করেছে সম্পূর্ণ আউট সোর্সের মধ্য দিয়ে। মরুভূমিতে শহরের পর শহর, রাস্তার পর রাস্তা তৈরি করে তারা দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। সভ্য মানবজাতির বসতবাড়িতে যা কল্পনা করতেও সাহস হারিয়ে ফেলার কথা। আর হচ্ছে এ জাতির অর্থনৈতিক ও মানসিক পরিবর্তন। তবে আরব আমিরাতের মানুষের মনুষ্যত্বের পরিবর্তন কতটা উন্নতির দিকে তা বলতে পারব না। তবে যা দেখে এলাম তার বর্ণনা দিতে চেষ্টা করব।

দেশটির নারী জাতি বাস করছে দিন-দুপুর, জাগরণ, আচরণ ও সাগরের ভ্রমণে কালো বোরকার ভেতরের এক অন্ধকার রাজ্যে। ম্যান ডমিনেটেড বা পুরুষের রাজ্যে নারীর বাস নারী জাতির সর্বনাশ। তারপরও নারী জাতি ঘর থেকে বের হতে শুরু করেছে। তাদের পথচলা এখন শহর, সাগর, হোটেল ও রেস্টুরেন্টে দেদারসে লক্ষণীয়। তবে মানবের চেহারাতে নয়, বোরকার ভেতরে এক চলমান দৃশ্য যা অন্ধকারাচ্ছন্ন পোশাকে ঢাকা।

আমার ভ্রমণের সময়টুকু ছিল তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজের ছুটির সময়। তাই তারাও ছুটিতে এসেছিল একই হোটেলে যেখানে আমাদের সময় কেটেছে। তাই দেখেছি তাদের জীবনযাপন কাছ থেকে দুরে, বহু দুরে। সারা বিশ্বের নরনারী যখন খোলামেলা সূর্যের কিরণে সাগরে সাঁতার কাটছে বিকিনি পরে ঠিক তখন তারা সাগরের পাড়ে পায়চারি করছে কালো পর্দার আড়ালে বোরকার তলে। আরবের নারীরা দেখছে সারা পৃথিবী, দেখছে অন্য পুরুষ–নারীর দেহ। কিন্তু নিজেদের দেখাচ্ছে কালো কাপড়ে ঘেরা এক চলমান জীব হিসেবে।

আমাদের ভ্রমণের শেষের দিন। রেডিসন ব্লু হোটেলে রাতের ডিনার একটু তাড়াতাড়ি শেষ করেছি। আমি আর আমার সহধর্মিণী মারিয়া হাঁটতে বেরিয়েছি সাগরের পাড়ে। চাঁদের কিরণ এত সুন্দর রূপ ধারণ করেছে যে, তার জ্যোৎস্নাতে অন্ধকার আলোই পরিণত হয়েছে। মরুভূমির দেশে হোটেলের চারপাশে গড়ে তুলেছে সবুজে ভরা এই প্যারাডাইজ হোটেল। সুন্দর ঘাসের ওপর পার্সিয়ান কার্পেটের বিছানাতে বোরকা পরা এক নারী বসে আছেন। সুন্দর করে সাজিয়েগুছিয়ে এক পিকনিকের সমন্বয়ে। যা বেশ দূর থেকেই আমাদের নজরে পড়েছে।

পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ শব্দ শুনতে পেলাম, ‘প্লিজ কাম অ্যান্ড জয়েন উইথ মি’। প্রথমে বিশ্বাস করতেও অবিশ্বাস লাগছিল। পরে মারিয়া বলে, না, মহিলা আমাদের বলছে। দাঁড়িয়ে গেলাম শান্ত হয়ে। ভদ্রমহিলা সন্ধ্যার চা–কফির আয়োজন করছেন তার আর চারজন বান্ধবীর জন্য। আমাকে মারিয়ার সঙ্গে কয়েকবার দেখেছেন সাগরের পাড়ে। দেখেছেন হোটেলের লবিতে। দেখেছেন ব্রেকফাস্ট ও সন্ধ্যার ডিনারে। আজ জ্যোৎস্না রাতে হঠাৎ পথে দেখা হতে তার কৌতূহল ও সাহসের পরিচয়, এই আকস্মিক নিমন্ত্রণ।

বসে গেলাম দুজনে। শুরু হলো কথা। হাজারো প্রশ্ন। ভেবেছিলাম আমিই হয়তো তাদের নিয়ে ভেবেছি। ওমা! তিনি তো দেখি আমার থেকে আরও বেশি ভেবেছেন। কয়েক মিনিট শুধু তিনি একা। কিছুক্ষণ পরে তার বান্ধবীরা এসে তিনি হয়ে গেলেন তারা। তার অন্য চার বান্ধবীও এসে হাজির ও আমাদের পরিচয় পর্ব শেষ হলো। মারিয়ার মুখে স্লামালাইকুম শুনে তারা হয়েছিলেন আপ্লুত। প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম তাদের পরিচয়। তারা সবাই বিবাহিত ও স্বামীদের সঙ্গে ছুটিতে এসেছেন। বয়সে আমাদের ছোট হবেন। আজ সন্ধ্যায় তারা প্ল্যান করেছেন বান্ধবীরা মিলে জ্যোৎস্না রাতে চা কফির আড্ডা দেবেন। ওদিকে তাদের স্বামীরা বেলি ড্যান্স দেখতে শহরে গিয়েছেন। হায়রে আরব জাতি! রেখেছে অন্ধকারে ঢেকে নিজেদের নারীদের। অথচ দেখছে উজাড় করে পর নারীকে!

অনেক কথা জানার ছিল, জানা হলো না। যতটুকু দেখলাম ও শুনলাম তাতে মনে হলো, তাদের দেহেও বইছে ভালোবাসার ঢেউ। তারাও বাঁচতে চান আমাদের মতো করে। তবে ম্যান ডমিনেটেড লাইফে সবকিছু সম্ভব নয় একদিনে। মনে পড়ে গেল, ‘রোম ওয়াজ নট বিল্ড ইন এ ডে’। চাঁদের জ্যোৎস্না রাতে আরবের এক মরুভূমিতে গালফ অব ওমানের পাড়ে হাতে চা তুলে দিতে চোখের পলক পড়েছিল সেদিন সেই রূপসী সুন্দরী নারীর মুখে। দেখে তারে মনে হলো, তিনি মনে মনে আমাদের ভালোবেসে ফেলেছেন তার বোরকা ঢাকা হৃদয়ের মাঝে।

কথা বলতে আর কথা শুনতে কখন ঘণ্টা কেটে গেছে জানি না। হঠাৎ মেয়ে জেসিকা এসে হাজির। তাই লম্বা গল্প কমিয়ে চলে এলাম হোটেলে। সকালে আরলি ব্রেকফাস্ট শেষ করে সবকিছু গুছিয়ে লবিতে ব্যাগগুলো রেখে সাগরের পাড়ে দিনটা কাটিয়ে দিতে হবে। বিকেলে বাস এসে নিয়ে যাবে আমাদের দুবাই বিমানবন্দরে। সেদিনও আবার দেখা হয়েছিল সেই চার নারীর সঙ্গে। পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে চুপি চুপি বলে গেলেন, হ্যাভ এ সেফ জার্নি, হোপ টু সি ইউ অ্যাগেইন’।

২৫ ডিসেম্বর সুইডেনে ফিরে এসেছি। সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক কিছু পার্থক্য সত্ত্বেও আরব জাতির ভালোবাসা দেখে এলাম আরব আমিরাতে। ফুজিরার ছোট্ট একটি শহর নাম দিবা যেখানে গড়ে উঠেছে রেডিসন ব্লু হোটেল। গালফ অব ওমান সাগরের পাড়ে। সেদিন আধো রাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই মনে পড়ে গেল সুরাইয়ার কথা। যিনি চা-কফির আড্ডাতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন চাঁদের জ্যোৎস্না রাতে, আমাকে আর আমার সহধর্মিণী মারিয়াকে।

রহমান মৃধা: সুইডেন। ইমেইল: <[email protected]>


[image/jpeg: image 1. jpeg]
Attachments area