বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণানীতি ও গবেষকের প্রয়োজনীয়তা

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা বেশ আলোচিত এক বিষয়। বিশেষত যারা উচ্চশিক্ষায় দেশের বাইরে যেতে ইচ্ছুক, তাদের মধ্যে এই আগ্রহটা বেশি লক্ষণীয়। এ জন্য শিক্ষকদের থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই আগ্রহ বেশি দেখা যায়। বিদেশে যারা গবেষণায় নিয়োজিত আছেন অনেকেই এ বিষয়ে জোরালো আবেদন জানিয়ে লেখালেখি করছেন। বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য, ব্যাপারটা এই নয় যে, আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক গবেষণা করতে চান না। আগেও করেছেন, এখনো গবেষণা করছেন। পার্থক্য শুধু পরিমাণে। গবেষণার পর্যাপ্ত পরিবেশ, গুণগতমান ও সংখ্যায়।

প্রথমে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বর্তমান গবেষণার অবস্থার দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। ‘স্কোপাস’-এর তথ্যের ওপর দ্য রিসার্চ হাবের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি সর্বমোট ১৪৫ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয় মোটামুটিভাবে গবেষণায় জড়িত। সংখ্যাটা কম বেশি এদিক-ওদিক হতে পারে। যেহেতু আমাদের দেশে এসবের হিসাব রাখার তেমন কোনো নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান নেই। পাবলিকেশনের দিক থেকে যাচাই করলে জার্নালের সংখ্যাটা সীমিত বলা চলে। তবে গবেষণা হচ্ছে, এটাই প্রশংসার দাবি রাখে। আরেকটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, তা হলো পাবলিকেশনের সংখ্যা এবং একাডেমিক পদের তুলনামূলক পর্যবেক্ষণ। হিসাব করলে দেখা যাবে প্রতি বছরে গড়ে একজন শিক্ষকের কমপক্ষে একটি গবেষণা প্রবন্ধও জার্নালে প্রকাশ হয় না। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটা বিশাল অংশ গবেষণার কাজে সংযুক্ত নন বা আগ্রহী নন। এর পেছনের কারণ জানতে হলে প্রথমে জানতে হবে, এই বিষয়টি দেখার দায়িত্ব কার? শিক্ষকদের, পরিচালনা পরিষদ নাকি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের।

বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখার সার্বিক দায়িত্ব বর্তায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ওপর। সে হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির নীতিমালা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তৈরি করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদ সেই নীতিমালা অনুসরণ করতে আইনত বাধ্য। এখন দেখা যাক বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় নীতিমালায় শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির কী কী নীতিমালা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া নিয়মনীতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রভাষক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি কোথাও ন্যূনতম কোনো ধরনের প্রকাশনার বাধ্যবাধকতা নেই। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই আবশ্যিক শর্তাবলিগুলো সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্ন ভিন্ন। যেমন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ বা পদোন্নতির জন্য ন্যূনতম তিনটি প্রকাশনার বিপরীতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রকাশনা থাকতে হবে। ন্যূনতম শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার শর্তাবলিতে আছে ভিন্নতা। আছে এসএসসি, এইচএসসি ও সম্মান শ্রেণিতে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার পার্থক্য। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অধীনে একই বিষয়ে একই পদের জন্য এ রকম ভিন্ন নীতিমালা পৃথিবীর অন্য কোথাও বোধ হয় নেই।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নীতিমালায় স্বীকৃত জার্নালের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই বিষয়ে সুস্পষ্ট বিবরণ অনুপস্থিত। নেই মানদণ্ডের কোনো ব্যাখ্যা। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালায় স্বীকৃত জার্নাল ও কনফারেন্স সম্পর্কে কোনো ধরনের কোনো ব্যাখ্যা নেই। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় নীতিমালা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আমাদের দেশে গবেষণা খাত কতটা উপেক্ষিত। এমনকি প্রকাশনা নীতিমালায় আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাঁকফোকর। যার গভীরতা বর্তমান নীতিমালার উপরিউক্ত ব্যাখ্যা থেকেই ধারণা করা যায়। সুতরাং মানসম্মত গবেষণা না করেই একজন শিক্ষকের সময়ের ব্যবধানে সহজেই অধ্যাপক হয়ে যাওয়ার সুযোগ থেকেই যাচ্ছে। নিয়মনীতির মধ্য থেকে সহজে পদোন্নতি পাওয়ার সুযোগ থাকলে অধিকাংশ শিক্ষকই মানসম্মত গবেষণায় উৎসাহী হবেন না, এটাই স্বাভাবিক।

আরেকটি বিষয় না বললেই নয়, আর তা হলো শিক্ষক নিয়োগের সেকেলে পদ্ধতি। শিক্ষক নিয়োগে বাংলা, ইংরেজি ও সাধারণ জ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষার পরিবর্তে শুধুমাত্র বিষয়ভিত্তিক ও গবেষণাভিত্তিক বিষয়ে প্রাধান্য দিতে হবে। গবেষণা প্রকাশ করেছেন, গবেষণা করছেন এ রকম অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রার্থীদের নিয়োগে প্রাধান্য দিতে হবে। সম্প্রতি দেশের সরকারি এক প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহকর্মী পিএইচডি শেষ করে আবেদন করেছিলেন। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, তাঁকে স্নাতক পাস করা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সেকেলে নিয়মের কারণে লিখিত পরীক্ষা দিতে হয়েছে। তাও স্নাতকের সিলেবাস অনুযায়ী। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের নির্ণায়ক কেমন হওয়া উচিত। বাংলা, ইংরেজি ও সাধারণ জ্ঞান মিশ্রিত? স্নাতকের সিলেবাস? নাকি গবেষণা সম্পর্কিত ও গবেষণার পূর্ব অভিজ্ঞতা? এসব বিষয় নিয়ে ভাবার সময় হয়েছে, পুনর্বিবেচনা করা এখন সময়ের দাবি।

মানসম্মত নিয়মনীতির অভাবে গবেষণা খাত এখনো পর্যন্ত অবহেলিত আমাদের দেশে। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গবেষণা খাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে নজর দেওয়ার বিকল্প নেই। অতএব বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানের বিবেচনায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির মানদণ্ডে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বের অন্যান্য উন্নতমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো আমাদের দেশেও গবেষণাকেন্দ্রিক শিক্ষকতায় জোর দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার প্রাধান্য অনুযায়ী বিভাগীয় গবেষণাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান চালু করতে হবে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা, গবেষণায় অর্থ জোগান দেওয়া, বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করা, গুণগত মানের দিকে নজর দেওয়া এগুলোর দিকে প্রাধান্য দিতে হবে। তথাকথিত মুখস্থ নির্ভর শিক্ষা থেকে বেরিয়ে এসে সমস্যা সমাধান নির্ভর শিক্ষায় জোর দিতে হবে। সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ-পদোন্নতি, শিক্ষকতায় গবেষণার পরিমাণ ও গুণগত মান একই মানদণ্ডের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতিতে গবেষণার প্রাধান্য দিতে হবে। গবেষণায় আজকের ছোট ছোট পদক্ষেপ একদিন আমাদের দেশের গবেষণা খাতকে বৈশ্বিক দরবারে উঁচু স্থানে নিয়ে যাবে। কিন্তু সে জন্য প্রয়োজন সঠিক নিয়মনীতি, নীতি প্রয়োগে কঠোর পদক্ষেপ ও সর্বোপরি সদিচ্ছা।