বৃষ্টির জল

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সারাক্ষণ টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। একটুর জন্যও বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই। আকাশ যেন ইচ্ছেমতো চোখের জল ঝরাচ্ছে। শাকিলের সব শুভ কাজগুলোর সঙ্গে বৃষ্টি জড়িয়ে থাকে। তার এখনো মনে আছে, যেদিন মাস্টার্স পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছিল, সেদিনও সারা দিন বৃষ্টি পড়েছিল। বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে ঘরে এসে মাকে ফার্স্টক্লাস পাওয়ার সুসংবাদটি দিয়েছিল। তাঁর বিয়ের দুই দিন আগ থেকে যে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল সেই বৃষ্টি শেষ পর্যন্ত সাত দিনের বৃষ্টিতে রূপ নিয়েছিল।

আজকের বৃষ্টিও তার ব্যতিক্রম নয়। আজ শাকিলের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে। শাকিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে স্নাতকোত্তর পাস করার পর একটি বেসরকারি ব্যাংকে প্রবেশনারি অফিসার পদে জয়েন করেছিল। অথচ তাঁর ইচ্ছে ছিল রসায়নে গবেষণা করা। তাঁর সাবজেক্টে কোনো চাকরি না পেয়ে শেষমেশ পেটের তাগিদে ব্যাংকে চাকরি নিয়েছিল। চার বছরের চাকরি জীবনে কখনো সে সুখী ছিল না। মন চাইত কীভাবে রসায়নবিদ্যায় তার জ্ঞান সঞ্চারণ করা যায়। চাকরি করার ফাঁকে ফাঁকে সে বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগল। আইইএলটিএসে সাত স্কোর করার জন্য রাত জেগে ইংলিশ প্র্যাকটিস করতে লাগল। তা না হলে বিলেতের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যায় না। ইত্যবসরে তাঁর জীবনে এক বড় ঘটনা ঘটে গেল। বড় বোন জোর করে তার জন্য পাত্রী ঠিক করে ফেললেন। কেন জানি শাকিল না করতে পারল না। হয়তো আল্লাহ পাক আগে থেকে শারমিনের সঙ্গে তার জোড়া বেঁধে রেখেছিলেন। বিয়ের এক সপ্তাহের মধ্যে সে পূর্ব লন্ডনের কুইনমেরি বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিষয়ে এমএস করার জন্য অফার লেটার পেয়ে গেল। বলা যায় বিয়ে ও বিদেশ যাওয়া তাঁর জীবনের কো-ইনসিডেন্স।

তাঁকে বিদায় দিতে আসা আত্মীয়স্বজন বাড়িতে গিজগিজ করছে। তাঁর হৃদয়ে চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। এই ব্যথা সুখ ও বেদনামিশ্রিত। অফার লেটার পাওয়ার পর পরের সপ্তাহে ইউকের ভিসার জন্য ফরম জমা দেয়। হাতে একেবারেই সময় ছিল না। সেপ্টেম্বর সেশন ধরার জন্য তাড়াহুড়োতে পড়ে গেল। কোনো ঝামেলা ছাড়াই সে ভিসা পেয়ে গেল। তেরো দিন আগে সে লন্ডনের ভিসা পেয়েছে। খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে তাঁকে লন্ডনে চলে যেতে হচ্ছে। একত্রিশে অক্টোবরের মধ্যে ক্লাস ধরতে হবে। শাকিলের নতুন বিবাহিত স্ত্রীকে সঙ্গে নিতে পারছে না। কারণ ডিপেন্ডেন্ট হিসেবে তাঁর বউয়ের জন্য অ্যাপ্লাই করতে পারেনি। হঠাৎ বিয়ের কারণে সবকিছু ঠিকঠাক মতো পরিকল্পনা করা হয়ে ওঠেনি।

এত খুশির মুহূর্তেও তাঁর মন কাঁদছে। কী কারণে মন বেশি কাঁদছে সে বুঝে উঠতে পারছে না। আজকে মনের নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতে নেই। আর কয়েক ঘণ্টা পর সে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবে। ঢাকা থেকে কাল বিকেল চারটায় আমিরাত এয়ারলাইনস করে গেটউইক বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা দেবে। এখন ঘড়িতে রাত নয়টা। এগারোটা ত্রিশ মিনিটে ঢাকাগামী হানিফ এন্টারপ্রাইজে করে তার যাত্রা শুরু হবে। সে একটি ছাতা নিয়ে কবরস্থানের দিকে হাঁটা দিল। অনেক বছর আগে তার মা-বাবা তাকে ছেড়ে পর জগতে চলে গেছেন। তার মন তাঁদের জন্য খুব কাঁদছে। মনে হচ্ছে আজই তাদের ছেড়ে সে অজানার উদ্দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। প্রতি শুক্রবারে কবর জেয়ারত করতে গেলে সে মা-বাবার সাক্ষাৎ পেত। তাঁর মনে হচ্ছে তাঁদের সঙ্গে আজ শেষ সাক্ষাতের জন্য যাচ্ছে। তাঁদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সে ডুকরে কেঁদে ফেলল। মনে হচ্ছে তাঁদের সঙ্গে আর কখনো দেখা হবে না। সেখানে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারল না। দ্রুত বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। ঘরে প্রবেশ করে দেখল তাঁকে বিদায় দিতে আসা মেহমানরা হইহুল্লোড় করছেন। শারমিন তাঁর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আছে। শাকিল লজ্জায় তাঁর পাশে ভিড়তে পারছে না। বউ ও তার দিকে সবাই যেন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ রাখতেই প্রেয়সী চোখ নিচে নামিয়ে নিল। সবাই তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন। বড়রা বিভিন্ন উপদেশ দিতে লাগলেন।

গোছানো শেষ পর্যায়ে। সময় এখন সাড়ে দশটা। দ্রুত সময় চলে যাচ্ছে। শাকিল ঘর থেকে বের হলো। স্বজনেরা সবাই তার পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগলেন। তাঁর মন ব্যাকুল শুধু শারমিনের জন্য। শারমিন ঠিক তার পেছনে। শাকিল ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই দেখল তাঁর দুই গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। শাকিল কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মুহূর্তে সব লজ্জা যেন উড়ে গেল। সে তাঁর জীবনসঙ্গীকে জড়িয়ে ধরল। তাঁর বুক ফেটে যাচ্ছে। শারমিনের কানে কানে সে বলল, তোমাকে অনেক ভালোবাসি, দেখা হবে শিগগিরই। টিপ টিপ বৃষ্টি পড়েই চলেছে। বৃষ্টির সঙ্গে তাঁদের চোখের জল মিশে যেতে লাগল।