কে জানত সেদিন

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

ফ্লোরিডা প্রণালি আটলান্টিক মহাসাগরের মেক্সিকো উপসাগরের সঙ্গে সংযুক্তকারী এক সমুদ্রপথ। পথটির উত্তরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের দক্ষিণতম প্রান্তে অবস্থিত ফ্লোরিডা কিজ দ্বীপপুঞ্জ। পথটির দক্ষিণে ও দক্ষিণ-পূর্বে আছে দ্বীপরাষ্ট্র কিউবা ও বাহামা দ্বীপপুঞ্জ।

আমার ছেলেমেয়ে জনাথান ও জেসিকা টেনিস খেলোয়াড়। ওরা এবারের টেনিস ট্যুরে বেছে নিয়েছিল ফ্লোরিডা টুর অ্যারাউন্ড। তাদের সঙ্গে আমার সহধর্মিণী মারিয়া ও আমিও ছিলাম। জেসিকার প্রথম খেলা ছিল মায়ামির কোরাল গাবেলে অরেঞ্জ বল টুর্নামেন্টে। এই টুর্নামেন্টকে আনঅফিশিয়াল ওয়ার্ল্ড কাপ টেনিস টুর্নামেন্ট বলা হয়। পৃথিবীর কমপক্ষে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশটি দেশের ছেলেমেয়েরা এই খেলায় অংশগ্রহণ করে থাকে। শর্ত একটি তা হলো এসব খেলোয়াড়দের তার দেশের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় থাকতে হবে মেধা তালিকায়। হতে হবে ১২, ১৪, ১৬ ও ১৮ বছরের কোনো এক বয়সের মধ্যে। জেসিকা সুইডেনের হয়ে খেলে গার্লস আন্ডার ১৪–তে। জনাথান জুনিয়র টেনিস শেষ করেছে। তাই সে খেলে প্রো-ট্যুর আইটিএফ যা এটিপি ওয়ার্ল্ড ট্যুরের ইভেন্ট। তার খেলা হয় ওয়েস্ট পাল্মবিচে ও পরে টাম্পাতে। জেসিকার প্রথম খেলা পড়ে ভেনেজুয়েলার সঙ্গে। সেই ম্যাচে জেসিকা জিতেছে। পরের ম্যাচ পড়ে আমেরিকার সঙ্গে। জেসিকা মোটামুটি ভালো খেলে এবং তৃতীয় রাউন্ড পর্যন্ত ছিল তার পারফরমেন্স। এরপর রওনা দিই ওয়েস্ট পাল্মবিসে যেখানে জনাথান খেলছিল।

প্রসঙ্গত বলতে হয়, আমাদের এই জার্নির প্ল্যানটা ছিল কিছুটা ভিন্ন ধরনের। যেহেতু জনাথান ও জেসিকা দুজনেই খেলছে এবং একই সময় খেলা চলছে, তাই আমরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছি। আমি আর জেসিকা কোরাল গাবেলে। ওদিকে জনাথান ও তার মা মারিয়া ওয়েস্ট পাল্মবিচে। মায়ামি ট্যুর শেষে আমরা সবাই যাব টাম্পাতে। যেখানে শুধু জনাথান খেলবে। পরে খেলা শেষে তিন দিন ছুটি কাটাব আমার বড় ভাই অধ্যাপক ড. মান্নান মৃধার বন্ধু ড. ফিরোজ ভাই ও সালমা ভাবির সঙ্গে পোর্ট মায়ারে। তারপর ফিরব সুইডেন।

জনাথান কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছে। এবার যেতে হবে টাম্পাতে। ওয়েস্ট পাল্মবিচ থেকে সকাল সকাল গাড়িতে করে রওনা দিয়েছি। পথে হঠাৎ দেখি রাস্তার দুই ধারে লেক বয়ে চলেছে এবং শত শত কুমির পাড়ের ওপরে মনের আনন্দে সূর্যের তাপে বিশ্রামে মগ্ন। কুমির দেখেছি সি-ওয়ার্ল্ড বা বিশ্বের বিভিন্ন চিড়িয়াখানাতে। কিন্তু এভাবে রাস্তার দুই ধারে শত শত কুমির এই জীবনে প্রথম দেখলাম। পথে হরেক রকম মজার মজার পশুপাখি দেখতে দেখতে তিন ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। আমরা এসে হাজির টাম্পাতে। টাম্পার খেলার শুরুতে জনাথান হাঁটুতে ব্যথা পায়। ফলে তার পক্ষে আর খেলা সম্ভব হয়নি। তাই আমরা সরাসরি চলে গেলাম পোর্ট মায়ারে।

পোর্ট মায়ার বিচের সঙ্গেই ফিরোজ ভাই করেছেন সুন্দর একটি বাড়ি। সেই বাড়ির আশপাশ সবুজে ভরা। মজার ব্যাপার তাঁদের বাড়ির বাগানে আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, নারিকেল, লিচু, আখ, শাক-সবজি সবকিছুতে ভরা। বলতে গেলে ছোট্ট বাংলাদেশ ফ্লোরিডাতে। সবাই খুব আনন্দ ফুর্তির মাঝে আছি। ফিরোজ ভাই ও সালমা ভাবির আদর–যত্ন আমাদের মুগ্ধ করে তুলেছে। বছর দুই আগে ফিরোজ ভাই ও সালমা ভাবি সুইডেনে এক কনফারেন্সে এসেছিলেন আমাদের স্টকহোমে। তাই সবাই সবাইকে আগে থেকে চেনা-জানার কারণে মেলামেশাটা জমে উঠেছে।

পোর্ট মায়ারের পাড়ে গড়ে উঠেছে লি কাউন্টি শহর। যেখানে ফিরোজ ভাইয়ের বিরাট ক্লিনিক। আমরা শহর ঘুরতে হঠাৎ চোখে পড়ে গেল বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস এডিসনের বাগান বাড়ি। টমাস এডিসন অন্ধকার জগতে আলোর সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন তার বাল্ব আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। টমাস এডিসনের আদি বসতবাড়ি নিউজার্সির ওয়েস্ট অরেঞ্জে। তবে জীবনের অনেক সময় ও শেষের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন এই ফ্লোরিডাতে। পোর্ট মায়ারে শীত ও বসন্তের সময় ছিল তাঁর জীবনের বেশি সময়ের বাস।

পাঠক কেন আজ এসব কথা? অনেক দিন ধরে আমি লেখালেখি করছি প্রতিবন্ধীদের নিয়ে। তাদের বর্তমান সমস্যার কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছি নানাভাবে। যাতে করে তাদেরও ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। প্রতিবন্ধী হতে পারে বা দিতে পারে পরিবর্তন করে গোটা বিশ্বকে, যদি তারাও একটু সহানুভূতি পায়। এমন ঘটনা পৃথিবীতে রয়েছে যা জানা বা অজানা থাকতে পারে। আজ বলব আমার পোর্ট মায়ারে লি কাউন্টি শহরের ওপর গড়ে ওঠা টমাস এডিসনের রহস্যময় জীবনকাহিনির একটু অংশ এবং তাঁর বাগান বাড়ি ভ্রমণের গল্পের সঙ্গে তাঁর ইলেকট্রিক বাল্ব আবিষ্কার নিয়ে কিছু কথা।

টমাস আলভা এডিসন জন্ম ১৮৪৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। মৃত্যু ১৮ অক্টোবর ১৯৩১। টমাস বিশ্বের মানব কল্যাণে ও বিশ্বের কলকারখানাতে রেভল্যুশন সৃষ্টি করেছিলেন ইলেকট্রিক বাল্ব তৈরি করে।

টমাস স্কুল জীবন শুরু করেছেন। বেশি দিন না যেতেই স্কুলের শিক্ষক তাঁর হাতে একটি চিঠি তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘টমাস চিঠিখানা তোমার মাকে দেবে।’ টমাস বাড়িতে এসে তাঁর মার হাতে চিঠি দিতেই মা তৎক্ষণাৎ চিঠি পড়তে শুরু করেন। টমাসের মায়ের চোখ ভরা জল, যা শুধু ঝরছে। টমাসের তাঁর মায়ের চোখে জল দেখে মাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘মা তোমার চোখে জল কেন? তুমি কাঁদছ কেন? কী এমন কথা লিখেছে যে তুমি কাঁদছ?’ মা চোখ মুছে টমাসকে বলেন, ‘বাবা আমার গর্ব লাগছে তোমার শিক্ষকের চিঠি পড়ে।’ কী লিখেছে মা আমার শিক্ষক? লিখেছে তুমি তোমার স্কুলের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র, তারা তোমাকে যুগোপযোগী ও তোমার প্রয়োজন মতো শিক্ষা দিতে পারবে না। কারণ তেমন যোগ্যসম্পন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা তাদের নেই। এমনকি যোগ্যসম্পন্ন শিক্ষকও নেই। তাই তারা লিখেছে আমি তোমার একমাত্র শিক্ষক ও মা। যে পারবে তোমাকে সুশিক্ষা দিতে। টমাস বলেছিলেন তাঁর মাকে, ‘তাহলে তো ভালোই হবে মা, আমি তোমার থেকে শুধু ভালোবাসা নয় এখন থেকে প্রশিক্ষণও পাব। কীই না মজা হবে।’

টমাস শুধু শিক্ষা নয় সুশিক্ষা পেয়েছিলেন জীবনে। পৃথিবীর অন্ধকারকে আলোময় করেছিলেন তিনি তাঁর ইলেকট্রিক বাল্ব তৈরি করে। তারপর অনেক বছর পার হয়েছে। তাঁর মা মারা গেছেন অনেক দিন আগে। একদিন হঠাৎ তাঁর কেন যেন একটু অস্থিরতা লাগছে। টমাস পুরোনো স্মৃতিচারণের সঙ্গে খুঁজছেন ঘরের অনেক পুরোনো কাগজপত্র। হঠাৎ আলমারির কোণে তাঁর নজরে পড়ে ছোটবেলায় তাঁর মাকে শিক্ষকের দেওয়া সেই চিঠি। টমাস কিউরিয়াস হয়েই চিঠিখানা খুলে পড়তে গিয়ে অবাক, হতভম্ব ও দিশেহারা হয়ে পড়েন। মা যা তাঁকে বলেছিলেন তার কোনো কথাই তো এখানে লেখা নেই!

স্কুলশিক্ষক লিখেছিলেন, তোমার ছেলে প্রতিবন্ধী, সে খুবই দুর্বল সব বিষয়ে, তাকে দিয়ে শিক্ষা হবে না। তাই পারলে তুমি নিজেই তোমার ছেলের দায়িত্ব নেও। আমরা পারব না এমন গাধাকে শিক্ষা দিতে।

যে কথা শিক্ষক লিখেছিলেন, সে কথা বিশ্বাস করেননি টমাসের মা সেদিন। টমাসের মা টমাসকে সেই কথা বলেছিলেন যে কথা টমাসের মা বিশ্বাস করেছিলেন তাঁর ছেলে টমাসের ওপর। Edison cried for hours and then he wrote in his diary: ‘Thomas Alva Edison was an addled child that, by a hero mother, became the genius of the century.’

পোর্ট মায়ারে টমাসের বাড়িতে তাঁর ডায়েরি পড়তে গিয়ে আমার চোখে জল এসেছিল। মনে পড়ে গেল হাজার হাজার প্রতিবন্ধীদের কথা। মনে পড়ে গেল নহাটার কথা। মনে পড়ে গেল মাগুরার কথা। মনে পড়ে গেল বাংলাদেশের কথা। আমি বাংলাদেশ, আমার নাম বাংলাদেশ। আমি প্রতিবন্ধী নই, আমি মানুষ, আমাকে অবহেলা কর না। আমাকে একটু সহানুভূতি ও সুযোগ দিলে আমিও গণতন্ত্রের সোনার বাংলা গড়তে পারব।

রহমান মৃধা। ইমেইল: <[email protected]>