ঝরনা, জল ও জঙ্গলের কাব্য

প্রকৃতির সংস্পর্শে শিশুরাই সবচেয়ে বেশি প্রাণবন্ত
প্রকৃতির সংস্পর্শে শিশুরাই সবচেয়ে বেশি প্রাণবন্ত

চারদিকে সমুদ্রবেষ্টিত দ্বীপরাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়াতে আপনি যেদিকে যাবেন সেদিকেই সমুদ্র আর সৈকতের ছড়াছড়ি। কিন্তু নদী ও মিঠা পানির অস্তিত্ব সেই অর্থে নেই। এখানে নদী বলতে ক্রিক বলে খালের মতো এক ধরনের দোপা জায়গা আছে, যেটা বৃষ্টির পানি দ্রুত বের করে দেওয়ার কাজ করে। আর নদী নাম নিয়ে যে নদীগুলো আছে সেগুলোও কোনো না কোনোভাবে সমুদ্রের সঙ্গে সংযুক্ত। তাই এখানে বাংলাদেশের মতো ধীর ও শান্ত প্রবাহের নদী খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে অনেক পাহাড়ি ঝরনা আছে যেখানে মিঠা পানির প্রবাহ বিদ্যমান।

ইউ আকৃতির গাছ
ইউ আকৃতির গাছ

পুলক ভাই, ইলা ভাবি এবং তাঁদের মেয়ে অবনি ও ছেলে অর্ক সমারসবি ঝরনাতে বেড়াতে গিয়ে ফেসবুকে তার ছবি দিলে সেটা মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, কবে আমরাও ওখানে যেতে পারব। হঠাৎই সুযোগটা পেয়ে গেলাম। শ্যালিকা পলি ও ভায়রা ভাই রাজীব পাল ওখানে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। আমরা আগ্রহী শুনে আমাদেরও তাঁদের সঙ্গে যোগ দিতে বললেন। আমরাও সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। সিডনি থেকে সমারসবি ঝরনাতে যেতে ঘণ্টাখানেকের ড্রাইভ। তবে আমরা যেহেতু সিডনির দক্ষিণ-পশ্চিমে থাকি তাই উত্তরের সমারসবি ঝরনাতে যেতে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক সময় লেগেছিল। রাজীব দাদার বুদ্ধি অনুযায়ী গুগল ম্যাপে সমারসবি ঝরনার ঠিকানা দিয়ে আমরা সেই মোতাবেক এগোতে থাকলাম। অবশ্য তাঁরা আমাদের সামনে থেকে আমাদের রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন।

উঁচু পাথরের চাই
উঁচু পাথরের চাই

সিডনি পার হয়ে যেই আমরা প্যাসিফিক মোটরওয়ে এম ১-এ পড়লাম তখন থেকে মুগ্ধ হতে শুরু করলাম। এই প্রথমবার এম ১-এ আসা। এই রাস্তাটার দুই পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিঃসন্দেহে সকলের চোখ জুড়াবে। সেইসঙ্গে তাদের মনকে শান্ত করবে। পাথুরে পাহাড় কেটে কেটে রাস্তার অ্যালাইনমেন্ট ঠিক রাখা হয়েছে। কেউ যখন দুই পাশের সেই পাথুরে পাহাড়ের উঁচু দেয়ালের মধ্যে দিয়ে যাবেন মনে হবে যেন দুই পাশের পাহাড় সটান দাঁড়িয়ে তাকে স্যালুট দিচ্ছে। সঙ্গে আছে দুই পাশের ঘন সবুজ বন। এ ছাড়া, হঠাৎ হঠাৎ মাথার ওপর দিয়ে মাঝেমধ্যে রাস্তা এপাশ থেকে ওপাশে চলে গেছে। সেগুলোকে দেখলে অনেকটা স্বাগতম জানানোর গেটের মতো মনে হবে। এমন সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কখন যে সমারসবি ঝরনার রাস্তায় বের হওয়ার পথে চলে আসবেন টেরই পাবেন না। দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি আপনাকে মোটেও পেয়ে বসবে না বরং মনের মধ্যে এক ধরনের ফুরফুরে ভাব নিয়ে আপনি ঝরনার কাছে পৌঁছে যাবেন।

ঝরনায় শীতল পানির স্পর্শ
ঝরনায় শীতল পানির স্পর্শ

সমারসবি ঝরনার ঠিক পাশেই গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা আছে। তবে সেখানে পার্কিং করতে হলে কিছু ডলার খরচ করতে হবে। এ ছাড়া, ঝরনায় ঢোকার মুখের রাস্তাতেও বিনা মূল্যে পার্কিং করা যায়। তারপর পায়ে হেঁটে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আপনি ঝরনার কাছে পৌঁছে যাবেন। ঝরনার পাশেই বসার বেঞ্চ ও বার-বি-কিউয়ের ব্যবস্থা আছে। আর আছে টয়লেট। তবে এখানে গোসলখানা নেই। তাই ঝরনাতে গোসল করে টয়লেটে গিয়ে আপনাকে কাপড় বদলে নিতে হবে। আমরা একটা গাছের ছায়ায় আমাদের জিনিসপত্র রেখে হুড়মুড় করে ঝরনার কাছে নেমে গেলাম। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে উৎসাহী মনে হলো ছোট রায়ান ও তাহিয়াকে। তারাই আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। ঝরনাটা মোট তিন ভাগে বিভক্ত। ওপরের অংশ, মাঝের অংশ ও নিচের অংশ। আমরা শুরুতেই ওপরের অংশে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। তাহিয়া আর রায়ান যথারীতি তাদের মতো করে আনন্দে মেতে উঠল। আর তাদের সঙ্গে যোগ দিল তাদের খালা পলি। সত্যি কথা বলতে পানির প্রবাহ দেখে কিঞ্চিৎ হতাশই হলাম। তখন রাজীব দাদা বললেন, দাদা এটাতো ওপরের অংশ, মাঝের ও নিচের অংশে গেলে অনেক পানি পাওয়া যাবে।

খাঁড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠানামা করতে হয়
খাঁড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠানামা করতে হয়

এরপর তাহিয়ার দেখানো পথে আমরা মাঝের অংশে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আসলেই ওপরে যেটাকে শীর্ণ প্রবাহের ঝরনা মনে হচ্ছিল মাঝে সেটাকে বেশ বড় প্রবাহের ঝরনা মনে হলো। আসলে ওপরের অংশে পানি ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে সেটাকে শীর্ণ মনে হচ্ছিল। আমরা সবাই কখনো একা একা আবার কখনো দল বেঁধে ঝরনার পানিতে গোসল সেরে নিলাম। ঝরনার পানির ঠান্ডা পরশে প্রাণটা নিমেষে জুড়িয়ে গেল। ঝরনার পাশেই একটা গাছ ইংরেজি ইউ অক্ষরের মতো করে বেড়ে উঠেছে। আমরা সেখানে বসে ছবি তুলে নিলাম। তার পাশেই উঁচু পাহাড়ে উঠে তাহিয়া ধ্যান করার ভঙ্গিতে ছবি তুলে নিল। রাজীব দাদাই আমাদের সমস্ত ছবি তুলছিলেন। এরপর আমরা একেবারে নিচের অংশে চলে গেলাম। নিচের অংশের বিশেষত্ব হচ্ছে নিচের অংশের পানি মাঝের অংশের চেয়ে আরও বেশি ঠান্ডা। সেই পানিতে গোসল করতে গিয়ে পলি ছেলেমানুষি এক বিশাল চিৎকার দিল। সেই চিৎকার শুনে ওখানে আসা এক অস্ট্রেলিয়ান পরিবার হেসে খুন। কারণ তারাও একটু আগেই সেখানে ভিজছিল। তারা বলল, আসলেই এখানে পানি অনেক ঠান্ডা। পাশেই ঝরনার পানি পড়ে পাথরের গায়ে একটা হাঁটু পরিমাণ গভীরতার গর্ত হয়ে সেখানে পানি জমেছিল। তাহিয়া আর রায়ান তার মধ্যে নেমে আর উঠতে চাইছিল না।

আশপাশের পাথরের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে মানুষ কেউ আড্ডা দিচ্ছেন আবার কেউ তাস নিয়ে বসে গেছেন। অতি উৎসাহীরা আরও নিচে নেমে দেখছিলেন ঝরনাটা কীভাবে আরও নিচে নেমে গেছে। ঝরনার পানির কুলকুল ধ্বনির সঙ্গে অবিরাম ঝিঁঝিপোকার ডাক মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে এখানে। আপনি একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন সেটা। নিচের অংশে দ্বিতীয়বারের মতো গোসল সেরে আমরা ওপরে ওঠা শুরু করলাম। নিচে নামার ব্যাপারটা যত সহজ ছিল ওপরে ওঠার ব্যাপারটা ততটাই কঠিন। বিশেষ করে রায়ানকে কোলে নিয়ে ওপরে উঠতে গিয়ে আমরা হাঁপিয়ে গেলাম। কিন্তু আমাদের সামনেই একজন নারী অন্য একজন নারীকে তার কাঁধে নিয়ে সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলেন দেখে আমরা মনে কিছুটা সাহস ফিরে পেলাম। তাঁর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমরা তাঁর সাহসের প্রশংসা করে বাহবা দিলাম। তিনি হাসিমুখে আমাদের শুভেচ্ছা জানালেন। তবুও মাঝেমধ্যে দাঁড়িয়ে একটু একটু করে বিশ্রাম নিয়ে এগোচ্ছিলাম। ওঠানামার রাস্তাটা অনেক বেশি শীতল ও মনোরম। কোথাও কাঠের সিঁড়ি আবার কোথায় পাথরের সিঁড়ি। এভাবে একসময় আমরা ওপরে উঠে এলাম।

সমারসবি ঝরনার মাঝের অংশ
সমারসবি ঝরনার মাঝের অংশ

ওপরে এসে কাপড় বদলেই আমরা বাসা থেকে রান্না করে নিয়ে আসা পাস্তার বাটি খালি করে ফেললাম। কিন্তু তাতে খিদে না মিটে বরং বেড়ে গেল। পলি বলল, এরপর এলে আমরা বার-বি-কিউয়ের ব্যবস্থাসহ মাদুর আর চা বানিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে আসব। তাহলে যতক্ষণ খুশি ততক্ষণ থাকা যাবে। খাওয়াদাওয়া শেষ করে আমরা আড্ডা দেওয়া শুরু করলাম।

সিডনিপ্রবাসী বাংলাদেশি কেউ যদি শহরের যান্ত্রিকতায় ক্লান্ত হয়ে একটু নিরিবিলি প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটাতে চান তাহলে চলে যেতে পারেন সমারসবি ঝরনাতে। যাওয়া আসা ও ওখানে থাকার পুরো সময়টা আপনি নিশ্চিতভাবেই উপভোগ করবেন। ফেরার সময় তাহিয়া বলল, বাবা তুমি আমার গানটা দাও। ও বাংলা স্কুলের পাশাপাশি আমাদের বাড়ির মালিক নাজমুল ভাইয়ের কাছে অনিয়মিতভাবে গান শিখছে। নাজমুল ভাই ওকে এখন একটা বাংলাদেশের গান শেখাচ্ছেন। গাওয়ার শুরুতেই সে নাজমুল ভাইকে গানের কথার মানে জিজ্ঞেস করেছিল। নাজমুল ভাই ওকে খুব সুন্দরভাবে সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। রাস্তার দুই পাশের রঙিন পাথরের পাহাড় দেখে তাই ওর মনে হয়েছে সেই গানটার কথা। তাহিয়ার প্রস্তাব শুনে আমার গিন্নি ইউটিউবে খুঁজে সেই গানটা ছেড়ে দিলেন—

‘গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ
আমার মন ভুলায় রে।’
...

মো. ইয়াকুব আলী। ইমেইল: <[email protected]>