সুমনের রামানুজন

শ্রীনিবাস রামানুজন
শ্রীনিবাস রামানুজন

কেবল মাত্র নতুন হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছি। গ্রামের আধা সরকারি প্রাইমারি স্কুল থেকে শহরের স্কুলে। স্কুলের নাম কে এম লতিফ ইনস্টিটিউট। দক্ষিণ অঞ্চলে এই স্কুলের বেশ নাম ডাক। বাবা আমাকে স্কাউট -ডেতে স্কাউটের পুরো একটা সুট কিনে দিয়েছিলেন। অক্সফোর্ড সুজ, ক্যাসিও ঘড়ি (সিলভার বেল্ট), ঢাকা টেইলার্স থেকে প্যান্ট ও শার্ট। ততদিনে আমার একটা সাইকেলও কেনা হয়ে গিয়েছিল। নতুন স্কুলে আমরা ১১ ইউনিয়নের ছেলেমেয়ে ভর্তি হয়েছিলাম এবং বাইরের সরকারি কর্মচারীদের ছেলেমেয়েও ছিল। প্রথম দিন স্কুলে গিয়েছিলাম ২০ ফেব্রুয়ারি। স্কাউটের একটা অনুষ্ঠান ছিল। কিন্তু আমি মনে করেছিলাম ওই দিন একুশে ফেব্রুয়ারি। হাতে একগুচ্ছ ফুল নিয়ে স্কুলে গিয়েছিলাম। সেদিন সবার সামনে কী লজ্জাটাই না পেয়েছিলাম। চরমমাত্রায় নাজেহাল হয়েছিলাম। এরপর থেকে ফুল হাতে নিতে ভয় পাই।

আমাদের প্রাইমারি স্কুল থেকে আমি একাই ওই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। তাই আমার পূর্ব পরিচিত কোনো বন্ধু ছিল না। পরদিন একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমি স্কুলে এলেও কোনো ফুল নিয়ে আসিনি। বড় ভাইয়া সকালে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। আর পকেটে একটা ১০০ টাকার একটা নোট গুঁজে দিয়েছিলেন। ওই স্কুলে অনেক ছেলেমেয়ে পড়লেও আমার তেমন কোনো বন্ধু ছিল না। মনে মনে ভাবতাম নতুন কোনো বন্ধু হলে এই ১০০ টাকা দিয়ে তার সঙ্গে রসমালাই খাব ৪৮ টাকার। এক বাটি রসমালাই তখন ২৪ টাকায় বিক্রি হতো। কিন্তু ওই দিনও কারও সঙ্গে তেমন বন্ধুত্ব হয়ে ওঠেনি। আর কাউকে দাওয়াতও দিইনি এই ভেবে, যদি আমার দাওয়াত ফিরিয়ে দেয়।

পরদিন আমি সাইকেল নিয়ে একাই স্কুলে এসেছি। কিন্তু বাড়ি থেকে আরেকজনকে আমার পেছনে পেছনে আসার জন্য নিয়োগ দিয়েছিল, যাতে পথে কোনো বিপদ আপদ না হয়। প্রথম ক্লাস বাংলা। জাহাঙ্গীর স্যার ক্লাস নেবেন। স্যার সেদিন সবার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। তবে সবার কাছে স্যারের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোমার বাবার পেশা কী?

সবাই তখন মনে মনে বাবার পেশাটাকে ঘষামাজা শুরু করে দিয়েছিল। এই যেমন ধরুন, যার বাবা কৃষক সে বলল সংসারী। যার বাবা ভ্যান চালান সে বলল ড্রাইভার। গাড়ির নামটা আর উল্লেখ করেনি। অনেকে ছোটখাটো মিথ্যা বলেছিল। তবে সেদিন আমি বুঝেছিলাম আব্বাকে শুধু আমিই ভালোবাসি না। সবাই সবার বাবাকে ভালোবাসে। গ্রামের ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষক অথচ এই পেশার নাম কেউ বলল না। হয়তো সমাজ এটাকে ছোট চোখে দেখে, তাই বলে না। ও হ্যাঁ, অনেকে তার বাবার পেশা বলার সঙ্গে সঙ্গে তার বাবা সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তাও বলার চেষ্টা করে। আমার সামনের বেঞ্চের ছেলেটিকে প্রশ্ন করার পর তার উত্তর শুনে সবাই একটু অবাক হলাম। কোনো ঘষামাজা ছাড়া উচ্চস্বরে বলে উঠল ‘কৃষক’, আমার বাবা একজন কৃষক। স্যারও মনে হয় এমন উত্তর আশা করেননি। তবে ছেলেটার চোখেমুখে সবার প্রতি একটা বিরক্তের ছাপ ছিল।

এই গল্পের সুবিধার জন্য তার একটা নাম দেব। আমি তার আসল নামটা লিখব না। তার নাম দিলাম সুমন। তার মনটা যে কত সুন্দর ছিল তা গল্পের পরবর্তী অংশে দেখা যাবে। মজার বিষয় হলো, আমার বাবার দুটো পেশা। শিক্ষকতা ও ব্যবসা। আব্বা শিক্ষক হিসেবে নিজেকে বেশি পছন্দ করতেন। আমি তাঁকে ব্যবসায়ী বলতে পছন্দ করতাম। তবে ওই দিন আমি এর একটিও বলিনি। মুখ ফসকে বের হয়ে গেছে কৃষক। স্যারকে তোতলানো কণ্ঠে বলেছিলাম আব্বা কৃষক। মনে হয় সুমনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার ইচ্ছা থেকেই আব্বার পেশা মিথ্যা বলেছিলাম।

সুমন মোটামুটি চলিত বাংলায় কথা বলত। তবে খানিকটা আঞ্চলিক ভাষারও টান আছে। আমি আঞ্চলিক ভাষাতেই কথা বলতাম। কয়েক দিনের মধ্যে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। তবে সে অনেক বেশি ক্লাসে অনুপস্থিত থাকত। আমরা দুজন শেষের দিকের একটা বেঞ্চে বসতাম। তবে আমাদের পড়ালেখা বা দুষ্টামির বাইরে তেমন কোনো কথাবার্তা হতো না। সে সাইকেল চালাতে পছন্দ করত। তার বাড়ি শহর দেখে দুই কিলোমিটার দূরে। আমার বাড়ির আর তার বাড়ির পথ ভিন্ন। তার আসতে দেরি হলে মাঝে মাঝে আমি সাইকেল নিয়ে এগিয়ে যেতাম। কিন্তু কখনো তার বাড়িতে যাওয়া হয়নি। কিছুদিনের মধ্যে আমাদের একটা পছন্দের ও কমন বিষয় খুঁজে পাওয়া গেল। সে প্রচণ্ড রকমের গণিত ভালো পারত ও পছন্দ করত। কিন্তু আমাদের একটা দুর্বলতাও ছিল। আমরা দুজনই খুবই ইংরেজিতে কাঁচা ছিলাম। নতুন নতুন কয়েক দিন যাওয়ার পরই শুরু হলো এ জন্য স্যারের পিটুনি। ইংরেজি ক্লাসে দুজনে পাল্লা দিয়ে বেতের বাড়ি খেতাম।

ইব্রাহিম স্যার তখন ইংরেজি পড়াতেন। স্যারের হিটলারের মতো গোঁফ ছিল বলে সুমন সব সময় হিটলার স্যার বলে ডাকত। কয়েক দিনের মধ্যে পাস্ট টেনস না পারায় ডজন বেতের বাড়ি খেয়েছিলাম। মেলা দিন অসুস্থও ছিলাম। দাগগুলো বহুদিন ছিল। সুমন আমার মন ভালো করার জন্য স্যারকে প্রায়ই আমার সামনে গালি দিত। প্রতিদিন বেতের পিটুনি না খাওয়ার জন্য নানা বুদ্ধি করতাম। সুমন আমাকে একদিন একটা বুদ্ধি দিয়েছিল এবং সেটা খুবই কাজে দিয়েছিল। বলেছিল স্যার যখন বেত দিয়ে পিটুনি দেবে বেতের সঙ্গে সঙ্গে হাত নিচে নামিয়ে ফেলবি। তবে টাইমিংটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্যার যাতে বুঝতে না পারেন এবং আগে পরে যেন না হয়। এটা আমরা বেশ দক্ষতার সঙ্গে করেছিলাম।

যা হোক, পরে বুঝতে পারলাম সুমন শুধু গণিতে না ফিজিকসেও চরম ভালো। স্যার ক্লাসে ঢুকতেন একটা মোটা ডিকশনারি নিয়ে। বাংলা একাডেমির ডিকশনারি। এর অল্প কয়েক দিন পর আমরা বৃষ্টির মধ্যে সাইকেল চালাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমাদের চোখে পড়ল আমাদের সহপাঠীরা একটা বাসার সামনে অপেক্ষা করছে। সবার কাঁধে ব্যাগ। তবে ওই দিন শুক্রবার ছিল। একটু খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ক্লাসের সবাই স্যারের বাসায় কোচিং ব্যাচে পড়ে। ওই দিন জানতে পারলাম ভালো স্কুলে পড়লেও প্রাইভেট পড়তে হয়। ভালো স্কুল হলেই যে পড়ালেখা স্কুলে শেখা যায় এটা সত্য না এবং স্যারদের বাসায় পড়ার জন্য বেশ টাকার প্রয়োজন।

তারপর আমরা বৃষ্টিতে সাইকেল চালাতে চালাতে সুমনের বাড়ির দিকে দিয়েছিলাম। আমাদের সাইকেল চালানোর বিভিন্ন কৌশল ছিল। এই যেমন একজনে প্যাডেল দেব অন্যজন গতি ও দিক কন্ট্রোল করবে। হঠাৎ সুমন আমাকে তাদের বাড়ি যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাল।আমার আগে থেকেই ইচ্ছা ছিল। সেদিন সুমনদের বাড়িতে আমি অন্য একটা জগতের সন্ধান পেলাম। তার ঘরে বেশ কিছু বই ছিল।একাডেমিক লেখাপড়ার বাইরে ষষ্ঠ শ্রেণির একজন ছাত্রের কাছে যে এত বই থাকতে পারে তা আমার জানা ছিল না। সে যে ছবি আঁকে, তাও জানতে পারলাম। তাদের কাঠের ঘর। তার ঘরে সে আর ওর ছোট ভাই শাকিল থাকত। ঘরের বেড়ার সঙ্গে লাগানো নানা ছবি। মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মিনার, ফুল, পাখি আরও নানা কিছু। প্রত্যেকটা ছবির মধ্যে নানা গাণিতিক নম্বর দেওয়া। ছবির মধ্যে অঙ্ক কোথা থেকে এল তা আমার মাথায় ঢুকল না। তার একটা ডায়েরিও ছিল। যার মধ্যে তার সংগ্রহে ছিল নানান ছবি। যার বেশির ভাগ ছিল আমার অপরিচিত। একটা অল্প বয়সের মানুষের সাদাকালো ছবি দেখিয়ে সুমন বলল, উনি আমার গুরু। ছবির নিচে বাংলায় শিশুসুলভ হাতের লেখায় লেখা ছিল শ্রী রামানুজন। কোনো এক পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছে।

‌আমরা সবাই একই এলাকায় থাকি। অথচ ও কত আলাদা । মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেও এই অদ্ভুত মানুষকে চিনতাম না। ওর নিজের জগৎটা সত্যি অনেক গভীর ছিল। ওই দিনের অন্তত চার বছর পর আমি জেনেছিলাম, রামানুজন এই উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ।
...

মো. শহিদুল ইসলাম: শিক্ষার্থী, ওয়ারটার রিসোর্সেস অ্যান্ড হাইড্রোইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং, থ্রি গর্জেস ইউনিভার্সিটি, হুবেই, চীন। ইমেইল: <[email protected]>