আপন হৃদয় গহন দ্বারে

লেখিকা
লেখিকা

সেদিন আমার এক ক্লাসমেট দুপুরের লাঞ্চ বিরতিতে সুদৃশ্য একটি লাঞ্চ বক্স দেখিয়ে বললেন, খুবই অল্প দামে ও সুস্বাদু খাবার বিক্রি হচ্ছে আমাদেরই ক্যাফেটেরিয়াতে! তোমরা চাইলেই কিনতে পার। আমি সাধারণত দুপুরের খাবার বাড়ি থেকে নিয়েই যাই ক্লাস করতে। সেই সকাল ছটায় বেরিয়ে আবার সন্ধ্যা ছটায় বাড়ি ফিরতে হলে বাইরে আর কতবার খাওয়া যায়! তাও কিনা সপ্তাহের পাঁচ দিনই!

সেই হাইস্কুলে পড়ার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যেত খুব! যখন পড়া না পারার লজ্জা আর বন্ধুদের উপস্থিতিতে বিমল স্যারের ভূগোল ক্লাসের ভর্ৎসনা যেন সদ্য পদার্পণ করা কৈশোরের অস্বাভাবিক দুরন্তপনার মাঝে এক দুর্দমনীয় বেদনার ভার হয়েই সবকিছুকে অবশ করে দিত। লজ্জায় লাল হয়ে যেতাম তখন! পড়ালেখায় ভালো বলে যে এক আধটু সুনাম ছিল, তার ষোলো আনাই মাটি! মনে হতো স্যার যেন উঠে পড়েই আমার পেছনে লেগেছেন, যেকোনো ছলেই আমার আনন্দ মাটি করাই স্যারের কাজ! যদিও জানতাম, ওটা স্যারের স্টাইল; মানুষটা আমায় অত্যধিক স্নেহ করতেন, আজ আমাদের পৃথিবী থেকে তিনি অনেক দূরে চলে গেছেন। আমার এই প্রৌঢ়ে এসে পড়াশোনার এই বহর দেখলে তিনি নিশ্চয়ই খুশি হতেন!

এমন ঝলমলে কৈশোরের দিনগুলোতে ফিরে যেতে যেতে আবার স্মৃতির ঝাঁপি বন্ধ করে নিজের কাজে মনোনিবেশ করতে হতো। এইই জীবনের নিয়ম! কোথায় জন্ম, কোথায় বেড়ে ওঠা আর কোন সুদূরে এসে গাঁটছড়া বাঁধা অবশেষে! একদিন সব দুঃখ-বেদনা জলাঞ্জলি দিয়ে এই মাটিতেই মিশে যাব, এই পরবাসে!

স্মৃতি এক চলমান জান্তব ট্রেন। কী লিখতে এসে কোথায় চলে গেলাম। এবার প্রসঙ্গে ফেরা যাক। কুঁজোর যেমন সোজা হয়ে শুতে ইচ্ছে করে, তেমনি এই দরিদ্রেরও একদিন ক্যাফেটেরিয়াতে খাবার বড় বাসনা হলো। আসলে বাইরে খাওয়ার ব্যাপারে আমার বাছ বিচার আছে। স্বাস্থ্যগত কারণই মুখ্য। তা ছাড়া এ দেশের কোনো খাবারের প্রতি আমার তেমন লোভও জন্মেনি। এ যাবৎ বিদেশবিভুঁইয়ে যতজনের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছে, ইন্ডিয়ান টেস্টের ওপরেই দেখলাম তাদের সকল ভরসা। অন্য কিছু যেমন তেমন খাবারের ব্যাপারে ওয়ার্ল্ড ক্লাস টেস্টের দাবিদার ইন্ডিয়া এ কথা তারা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেন। সেই গরবে আমিও কম গরবিনী নই। আদতে বাংলাদেশের টেস্ট বলে আলাদা কিছু তো নেই এদের কাছে। এরা আলাদাভাবে বাংলাদেশকে খুব কমই চেনেন। সুতরাং, ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ; একই টেস্ট। অন্তত খাবারের কল্যাণে। অনেক বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা এখানে ইন্ডিয়ান নাম দিয়ে ব্যবসা করেন কাস্টমারদের আকৃষ্ট করার জন্য!

বন্ধুর দেওয়া খাবারের তথ্য আর দামের ফিরিস্তি শুনে মনে মনে অনেক সাহস আর শক্তি সঞ্চয় করেই ফেললাম। আজ খাব ক্যাফেটেরিয়ায়। সেদিন বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে যাইনি। লাঞ্চ ব্রেকে চলে গেলাম ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্সের ডিপার্টমেন্টে। সেখানেই বিশাল কিচেন কাম ক্যাফে। কারণ, কালনারি ম্যানেজমেন্টের ক্লাস হয় সারা দিনব্যাপী সেই বিল্ডিংয়ে। আর ওরা যে সমস্ত রান্নাবাড়া করেন, সেসবই বিক্রি বাট্টা হয় আমাদের ক্যাফেতে।

কোনো ধরনের অভিজ্ঞতা ছাড়াই খুব সরল অঙ্ক কষে আমার মনে হয়েছিল, যেহেতু শিক্ষানবিশেরা রাঁধছেন, এই খাবার যারপরনাই সস্তা হবে, তার ওপরে বন্ধুর বয়ান তো ছিলই। কিন্তু আমার যে সরল অঙ্কেই গরল ছিল! আদতে যে তথ্যের ভিত্তিতে আমি খাবার কিনতে এলাম, তা আমাদের ক্যাফেটেরিয়াতে নয়। সে অন্য আরেক গল্প; আমিই গুলিয়ে ফেলেছি। আমার ধারণাকে মিথ্যে করে দিয়েই দেখলাম, এই খাবারের দাম অনেক বেশি। এখানের যা মেন্যু তা আমার রুচিতে একটিও রুচবে বলে মনে হলো না, তবুও যা মোটামুটি খেতে পারব তার দাম দশ ডলারের বেশি ছাড়া কম নয়। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। সেই সকাল ছয়টায় নাস্তানাবুদ হয়ে বাস ধরে দেড় ঘণ্টা দৌড়ে তবেই এসেছি ক্লাস করতে। এক কাপ চা ছাড়া এ পর্যন্ত আর কিচ্ছুটি পড়েনি জঠরে। এখন খিদের মানিক জ্বলে, পিত্তি বিহনে বুকের কোণে।

সবচেয়ে কমদামি একটি মেন্যু পছন্দ করলাম। যার দাম সাড়ে চার ডলার, বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২৭৫ টাকা। দশ ডলারে লাঞ্চ করাটা তখনো নেহাতই বিলাসিতা আমার কাছে। তখনো পড়ি। দেশ থেকে আনা জমানো টাকাই তখনো সম্বল। আর কন্যার পিতার সামান্য রোজগার। তাতে কোনোমতে খেয়ে পরে চলে যায়, কিন্তু বাড়তি খরচ। নৈবচ নৈবচ! একটা সেন্ট খরচ করলেও তখন গায়ে লাগে খুব। দেশে ছিলাম দরিদ্র, এবার হয়েছি হতদরিদ্র। সব ব্যাপারে আমাদের কিপটেমি দেখে আমার কন্যা তো বলেই বসল, ‘মা, তুমি তো বললে কানাডায় গেলে আমাদের সবকিছু ভালো হবে, আমি তো দেখছি আমরা আরও গরিব হয়ে গেলাম!’ ওর কথা শুনে আমি কাঁদব না হাসব সেদিন বুঝতে পারিনি। তবে, এই ভেবে শান্তি পেয়েছিলাম, আমরা যে আগেও গরিব ছিলাম সেটা সেই বয়সেই ও বুঝে নিয়েছিল। এ কথা আজ যত সহজে লিখছি, সেদিন অত সহজেই কী মনে নিতে পেরেছিলাম? চোখ ফুঁড়ে, বুক ভেঙে বেরিয়ে এসেছিল আমার শৈলপ্রপাতের ধারা। রুখতে পারিনি তাকে।

খাবারের অর্ডার দিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নিয়ে নিলাম। এবার মূল্য পরিশোধ করতে লাইনে দাঁড়িয়েছি। বড় ব্যাগপ্যাকের মধ্যে কিছুতেই আর ওয়ালেট খুঁজে পাচ্ছি না। এই খুঁজে না পাওয়ার অভ্যাস আমার আজীবনের। হাজারো যন্ত্রণায় এই অভ্যাসের আর নতুন কোনো সংস্করণ মিলল না। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পেলাম না মানি ব্যাগ। এদিকে আমার পেছনে লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে, লাঞ্চ ব্রেক বলে কথা, সেটাই স্বাভাবিক। অন্যেরা বিরক্ত হচ্ছে দেখে আমি একটু পাশে সরে দাঁড়িয়ে কাঁচুমাচু মুখ করে ক্যাশে দাঁড়ানো ভদ্রমহিলার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময়ের চেষ্টা করলাম। এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে জীবনে কোনো দিন পড়েছি বলে মনে করতে পারছিলাম না। ঠিক কী যে বলব তাঁকে তাও মাথায় আসছিল না। খাবারটি যেহেতু গ্রেভি, লিকুইড ধরনের, সেটি ফেরত দেওয়ার মতো অবস্থায়ও নেই, শুকনো হলে সেই প্রস্তাব দিতাম। তারাও ফেরত নিতেন, কিন্তু এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়! তবুও, একটু আমতা-আমতা করে বললাম, ইয়ে, মানে, আমি আমার মানিব্যাগ খুঁজে পাচ্ছি না।

তিনি কিছুক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ইটস ওকে। আমি এখন তোমার হয়ে পে করে দিচ্ছি, তুমি পরে এসে আমায় দিয়ে দিয়ো। অমল কৃতজ্ঞতায় আমার মন মোম কোমল হয়ে গেল। বিশালাকায় এক বিগলিত হাসিতে চারপাশ আলোকিত করে বললাম, অনেক অনেক ধন্যবাদ। নিশ্চয়ই। আমি কালই এসে পে করে যাব। তারপরে ক্যাফের টেবিলে বসেই সেই রসামৃতের রসাস্বাদন করলাম। সত্যি বলতে তা গলাধঃকরণ করা যে কী ভীষণ কষ্টকর ছিল তা মনে করলেও এখন গলা আটকে আসছে। তবুও, ক্ষুধার রাজ্যে সবই ছিল সেদিন উপাদেয়।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে নিজের ওপর রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিল। এই সব কিছু ভুলে যাওয়ার জন্য আরও কত যে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে তাই ভাবতে লাগলাম। মনে মনে এও ভাবলাম, দেশে এমন বিপদে পড়িনি কখনো, পড়লে কী হতো? আমার হয়ে কেউ কি প্রায় পৌনে তিন শ টাকার বিল পে করে দিত? এটা ভাবা যায়? আমাদের সমাজে এমনটা হয়? গতকালই একজনের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে বললেন, আপনারা যে বাংলাদেশ দেখে গেছেন এখন আর তেমন নেই! বদলে গেছে অনেক কিছুই। সেই বদলানো সময়ের হাত ধরে দ্রুতলয়ে বদলেছে আমাদের সামাজিক সম্পর্কগুলো! আমাদের অহংকারের বড় ব্যাপারগুলোতে বড় বড় দেয়াল উঠেছে। আর ভালোবাসার বাঁধন আলগা হয়েছে কেবল। হয়েছে শিথিল। সে যেমন পরিবারে, তেমনি সমাজে-রাষ্ট্রে। আমরা একে অন্যের পাশে দাঁড়াই যত, তার চেয়ে বেশি দাঁড়াই না। সত্যিই যদি এমন ঘটনা দেশে ঘটত তবে লজ্জায়, অপমানে মাথাকাটা যেত, খাওয়া তো দূরে থাক, আগে খেয়ে ফেললে হয়তো বমিই করে দিতে হতো।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যে ভদ্রমহিলা আমাকে বিল দিতে সাহায্য করেছিলেন, তিনি জাতিতে কৃষ্ণাঙ্গ। যদিও এই জাতির সম্বন্ধে আমাদের মনেও অন্ধকারের কালোর কিছু কমতি নেই। ওরা বদমেজাজি, ওরা ভয়ংকর, পারে না এমন কিছু নেই। ওদের সম্বন্ধে অনেক নেতিবাচক কথা শুনতে শুনতে সেসবই একসময় বিশ্বাস হয়ে যায়। তা ছাড়া দু–একটি তিক্ত অভিজ্ঞতাও যে ছিল না এমনও নয়। তবুও আজ নতুন করে এই কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে দেখলাম, মনে হলো আমি তাঁকে হাজার বছর ধরেই চিনি। যিনি আমার ইজ্জত বাঁচালেন। তিনি পরমাত্মীয় আমার!

পরদিন যথারীতি আমি ক্লাসে গিয়েই ক্যাফেতে ছুটে গেলাম দেনা শুধতে। গিয়ে দেখি তিনি সেই সময়ে ডিউটিতে নেই! তাড়াহুড়োতে সেদিন তাঁর নামখানা জিজ্ঞেস করাও হয়নি। সেই সময়ে যিনি ক্যাশ কাউন্টারে ছিলেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, গতকাল এই সময়ে কে ডিউটিতে ছিলেন আপনি জানেন কি? তিনি ডিউটি রোস্টার দেখে নাম বললেন, জেনিফার। আমি বললাম, ইয়েস, জেনিফার। আমি কি তার সঙ্গে একটু দেখা করতে পারি। তিনি জানতে চাইলেন কেন। তিনিই আমাকে সাহায্য করতে পারবেন এও জানালেন। আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, আসলে একটু ব্যক্তিগত। তিনি জানালেন, আজ জেনিফারের ডিউটি নেই। আপনাকে কাল আসতে হবে। আমার পরদিন মাত্র একটি ক্লাস।

সাড়ে নয়টায় ক্লাস শেষ করে সপ্তাহের এই একটি দিন ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে বাড়ি না ফিরতে পারার বেদনার চেয়ে না খেয়ে শুঁটকি দিয়ে বসে থেকে দেনা শোধ করার অপেক্ষার আনন্দ সহস্র গুণ বেশিই সে কথা আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না। গেলাম আবার যথারীতি। গিয়ে যখন বললাম, আমি টাকাটা ফেরত দিতে এসেছি, তিনি খানিকটা বিস্ময় নিয়ে তাকালেন, বললেন, আই ডিড নট গেট ইউ। কীসের টাকা? আমি তাঁকে মনে করিয়ে দিলাম, একদিন আগে দুপুরবেলার সেই ঘটনা। তিনি হেসে ফেললেন। বললেন, আমি তো পে করেই দিয়েছিলাম। লাগবে না। আমি বললাম, কেন? আমি দিয়ে দেব এমনটা বলেছিলাম। তখন তিনি বললেন, আমি ভাবিনি তুমি ফিরে আসবে। তবে দাও, আমি পাঁচ ডলারের একটি নোট দিয়ে বললাম, আমার কাছে খুচরো নেই। তিনি বললেন, তাঁর কাছেও খুচরো নেই। আমি সহাস্যে জানালাম, ইটস ওকে। আমার পঞ্চাশ সেন্ট লাগবে না, ইউ ক্যান কিপ ইট। সেদিনের বিপদ তাড়িনির কাছে কৃতজ্ঞতাবোধের যে পাওনা সঞ্চিত হয়েছে সেখানে পঞ্চাশ সেন্ট তো নস্যি!

পরবাসের নানান অভিজ্ঞতার ঝুলি ঘাঁটতে গিয়ে এমন টুকরো টুকরো ভালো লাগাগুলো মনের কোণে মোম কোমল আলো ছড়ায়। মুক্তো দানার মতো স্বচ্ছ, শুভ্র গ্রন্থনে ভালোবাসার আলো হয়ে থাকে। আর তাই একসময় পরবাসই হয়ে যায় আপন ঠিকানা। তবুওতো মন কাঁদে! দেশের মাটির গন্ধে বিভোল হয় মন। মা যেমন সন্তানের জন্য যা কিছু ভালো, যা কিছু সুন্দর তাইই সব সময় চায়, তেমনি আমার এই ভালো লাগাগুলো, ভালোবাসাগুলো জমা থাকে আমার দেশের জন্য। মানুষের জন্য। মানুষই আমার বড় শিক্ষালয়। (চলবে)

ধারাবাহিক এ রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: