পুনরাবৃত্তি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। আজ বোধ হয় একটু বেশি হয়ে গেছে। নিজের অজান্তেই দীপ্তির হাত উঠে গিয়েছিল। এতবার ভাবে আরও ধৈর্য ধরা শিখতে হবে, তারপরও প্রায়ই ধৈর্য ধরতে ফেল করে যায় সে। কেন যে এমন হয়! আর আমারই বা দোষ কী, দীপ্তি ভাবল। এত হুলুস্থুল পর্যায়ের দুষ্টুমি আমি একা কত সামলাব? মাথাটা যে খারাপ করে দেয় বাচ্চাটা! অসম্ভব রকমের সব কাজ করে, যা কল্পনারও বাইরে। কী করে মেজাজ ঠিক রাখি তখন? আর মেয়েকে দেখ, এটুকু বয়স, সে কী তার অভিমান! কে বলবে বয়স মাত্র চার। ঠোঁট ফুলিয়ে সোফায় মুখ ঢেকে শুয়ে পড়লেই যেন পুরো পৃথিবীর কাছে নালিশ করা হয়ে যায়।

রাগটা কমে আসার পর দীপ্তির মনটা আর্দ্র হয়ে হায় হায় করে উঠল। গুটিগুটি পায়ে সে মেয়ের কাছে চলে এল। তার ছোট্ট মামণিটার ঘুমন্ত চোখের কোণে এখনো পানি চিকচিক করছে। আস্তে করে সেগুলো মুছে দিয়ে দীপ্তি মেয়ের গালে চুমু খাওয়ার জন্য মুখটা নামাতেই হঠাৎ করে অনেকগুলো বছর আগের একটি দৃশ্য তার চোখের সামনে ভেসে উঠল।

দুষ্টু দীপ্তি কখনোই ছিল না। তবে অনেকটা বয়স পর্যন্ত ভয়ংকর জেদি ছিল সে। ঠিক তেমনি রাগী ছিলেন তার মা। এই রাগ আর জেদের মিশ্রণে প্রায়ই তাদের ঘরে লঙ্কা কাণ্ড ঘটত। ১২–১৩ বছর পর্যন্ত দীপ্তি প্রচুর মার খেয়েছে। এ রকমই কোনো একদিন অনেকখানি প্রহারের পর জিদ করে রাতে ভাত না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। মাঝরাতে এক কোমল স্পর্শে তার ঘুম ভেঙে গেল। কে কে বলে চিৎকার দেওয়ার আগেই সে বুঝতে পারল, মা তার মাথায় আর পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে দিচ্ছেন। পাশ ফিরলে মা টের পেয়ে যাবেন দীপ্তি জেগে গেছে। তাই চোখ বন্ধ করে চুপচাপ ঘুমের ভান করে দীপ্তি চুপচাপ পড়ে রইল। আদরের সঙ্গে সঙ্গে তার মা নীরবে কাঁদছেন, সেটাও সে অনুভব করতে পারছিল। একবার তার মনে হলো উঠে বসে মায়ের হাত দুটো ধরে বলে, মা কেঁদো না, আমি আর তোমাকে রাগাব না। পরক্ষণেই ভাবল, না থাক। মা তার চোখের পানি দীপ্তিকে দেখাতে চান না দেখেইতো সে ঘুমোনোর পরে ওকে আদর করতে এসেছেন। এত বড় মেয়ের কাছে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করতে চাইছেন না যখন, তখন দীপ্তিরও চুপ করে থাকা উচিত।

এত দিন পেরিয়ে গেছে, কিন্তু মাকে আর কখনোই বলা হয়নি, সে রাতে তার স্নেহধন্য দীপ্তিকে তিনি জীবনের অনেক গভীর একটা সত্যি উপলব্ধি করিয়েছিলেন। সে জেনে গিয়েছিল মায়েদের সঙ্গে জিদ করে কোনো লাভ নেই। কারণ তাদের রাগের পেছনেও এক সমুদ্র মমতা লুকোনো থাকে।

আজ সময়ের চাকা ঘুরে ঘুরে ঠিক সেই রাতে দীপ্তিকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। এ রকম পুনরাবৃত্তি এক জীবনে ঘটবে কখনো কি সে ভেবেছিল? রাগ, অভিমান, মায়ের ভালোবাসা সব একই আছে, শুধু পাত্র পরিবর্তিত হয়েছে। কী অদ্ভুত এই জীবন চক্র! বারবার মানুষকে মনে করিয়ে দেয় তারা মমতার এক কঠিন শেকলে বাঁধা পড়ে আছে। তাদের ভূমিকার পরিবর্তন হবে কিন্তু ভালোবাসা অনন্তকাল ধরে একই থাকবে।
...

সারা কুশরা দ্যুতি: বেডফোর্ড, ইংল্যান্ড।