পরকীয়া একধরনের প্রতারণা

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

সংসার মানে দুজন মানুষের পাশাপাশি হাত ধরে চলার অঙ্গীকার। সেই দুজন মানুষের মধ্যে যখন তৃতীয় কেউ চলে আসে তখন সম্পর্ক অন্যদিকে মোড় নেয়। সেটা স্বামী-স্ত্রী দুজনের ক্ষেত্রেই হতে পারে। স্বামী অন্য কোনো নারীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে পারেন কিংবা স্ত্রী অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে। আর এই সম্পর্ককেই আমরা মূলত পরকীয়া বলি। সাধারণত দেখা যায় অসুখী দম্পতিরা পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। কেউ তাদের মানসিক শান্তির জন্য, কেউ তাদের শারীরিক চাহিদার জন্য। যে কারণেই জড়াক না কেন, একটা বিষয় এখানে স্পষ্ট (স্বামী-স্ত্রী) সম্পর্কের মধ্য থেকে আরেকটা সম্পর্ক তৈরি করা এটা এক ধরনের প্রতারণা।

অনলাইনে দেখলাম মোস্তফা মোরশেদ আকাশ নামের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যা করার আগে তিনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জানিয়েছেন তার স্ত্রী তানজিলা হক মিতু পরকীয়া জড়িত ছিল। অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে তিনি কিছু ছবি ও ভিডিও দিয়েছেন।

তারা দুজনই শিক্ষিত। মিতুর যদি আকাশকে ভালো না লাগত তিনি তাকে ছেড়ে চলে আসতে পারতেন। কারণ তিনি স্বাবলম্বী একজন মানুষ। আকাশের সঙ্গে থেকে অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা, সেটাই তো প্রতারণা। আর আকাশের যদি কোনো শারীরিক সমস্যা থাকত সে ক্ষেত্রেও চিকিৎসা করাতে পারতেন পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে।

অনেকে বলবেন, আকাশ কেন ডিভোর্স দেয়নি? আমার ধারণা, কারণ তার বিয়ের দেন-মোহর ছিল সম্ভবত পঁচিশ লাখ টাকা। যেটা তার ফেসবুক বন্ধুর স্ট্যাটাসের মাধ্যমে জেনেছি। ডা. আকাশকে আমিও চিনতাম ফেসবুকের মাধ্যমে। ডিভোর্স দিলে একজন তরুণ ডাক্তার এত টাকা কোথায় পাবেন?

আকাশ বলেছে, আমাকে ভালো না লাগলে চলে যাও, তবুও চিটিং করনো না। বিয়ের আগেই মিতুর সম্পর্ক ছিল অন্যের সঙ্গে। সেটা জেনেও মিতুকে বিয়ে করেছেন, কারণ তিনি মিতুকে ভালোবাসতেন। ভালোবাসা না থাকলে যেকোনো একটা কারণ দেখিয়ে তারা বিয়ে ভেঙে দিতে পারতেন। ডিভোর্সের ক্ষেত্রে মিতুর অপশন ছিল সহজ আইনগত দিক থেকে। যেটা আকাশের ছিল না।

একজন মানুষ কখন আত্মহত্যা করে? যখন সে ভেতরে ভেতরে একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। একটু একটু করে সে ক্ষয়ে যেতে থাকে। সে একেবারে কাছের মানুষের দ্বারা মানসিক বা শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তখন তার কাছে মনে হয় কী লাভ বেঁচে থেকে। যাকে ভালোবাসলাম সেই তো আমার না। এই বিষয়টা আকাশের ক্ষেত্রে ঘটেছে। তিনি না পারছেন মিতুকে ছাড়তে, না পারছেন অন্য একজনের সঙ্গে মিতুর সম্পর্ক মেনে নিতে। তার বুকে অভিমান জমতে জমতে এমন একটা পর্যায়ে চলে গেছে, তিনি হয়তো ভেবেছেন কী লাভ আর বেঁচে থেকে।

সেজান মাহমুদ নামে একজন বলেছেন, আত্মহত্যা একটি রোগ, মানসিক অসুখ।

আমার প্রশ্ন এই মানসিক রোগটা কীভাবে আসে? কারও কাছ থেকে প্রতারিত হয়েই তো সে মানসিক রোগী হয়। রোগ তো একদিনে হয় না। দীর্ঘ একটা সময় ধরে কাছের কারও কাছ থেকে যখন প্রতারিত হয় তখনই সে মানসিক রোগী হয়। বিশেষ করে ভালোবাসার ক্ষেত্রে। কাউকে সত্যিকারভাবে ভালোবাসলে তার প্রতারণা মেনে নেওয়া খুব কঠিন। যেটা আকাশ মেনে নিতে পারেননি।

শুধু আকাশ কেন? আমার স্বামী যদি অন্য কোনো নারীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়েন তাহলে সেটা তো আমিও মেনে নেব না। আর আমার স্বামী কি মেনে নেবেন আমি যদি অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক করি? না নেবেন না।

লেখিকা
লেখিকা

আবার অনেক স্বামীর পরকীয়া আছে জেনেও স্ত্রী সংসার করছেন সামাজিকতার জন্য। ছেলেমেয়ে থাকলে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে। সেটা যদি কেউ মেনে নেন সেটা তার ব্যাপার। অনেকের আবার যাওয়ার জায়গা থাকে না বলে সংসারে থেকে যান।

আসলে স্ত্রী বা স্বামী নয়, বিষয়টা হলো একটা সম্পর্কের বন্ধনে থেকে আরেকটা সম্পর্ক তৈরি করাই প্রতারণা। একজন মানুষ যখন দুই-তিনটা রিলেশন একসঙ্গে চালিয়ে যান, তখন তিনি নিজের সঙ্গেও প্রতারণা করেন। এটাও একধরনের মানসিক অসুস্থতা। আমাদের সমাজে কারও ডিভোর্স হলে পরিবার, প্রতিবেশী সবাই ধিক্কার দেন। এই ধিক্কারের ভয়ে অনেকে গোপনে সম্পর্ক রেখে সংসার চালিয়ে যান।

মিতুর সে ভয়টা থাকার কথা না। কারণ তিনি আমেরিকায় থেকেছেন। স্বাবলম্বী ও শিক্ষিত। তার অনেকগুলো চয়েজ ছিল। যেটা আকাশের ছিল না। প্রথমত আকাশ তার দেনমোহরের কাছে বাঁধা ছিল। ডিভোর্স দিলে এত লাখ টাকা তিনি কোথায় পেতেন? দ্বিতীয়ত ভালোবাসার মানুষকে তিনি হারাবেন এটা মেনে নিতে পারছিলেন না।

আকাশ আর ফিরে আসবেন না। কিন্তু আমাদের সমাজে অনেক পরিবার আছেন যারা এ রকম সমস্যায় ভুগছেন। কিন্তু লজ্জা ও সামাজিকতার ভয়ে কাউকে বলতে পারছেন না।

তাদের বলছি, আপনার সংসারে অশান্তি হলে, কী নিয়ে হচ্ছে। আগে সমস্যাটা খুঁজে বের করুন। তারপর সর্বোচ্চ চেষ্টা করুন সমস্যা সমাধান করার। যদি ব্যর্থ হন, তাহলে সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসুন। অন্তত নিজের কাছে স্বচ্ছ থাকুন। তারপর অন্য সম্পর্কে জড়ান। মানুষ কী ভাববে তার চেয়েও বড় কথা আপনি নিজের সম্পর্কে নিজে কী ভাবছেন।

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মাঝে দেয়াল থাকা উচিত নয়। এই সম্পর্কটা এমন একটা সম্পর্ক, একজন নিচে নামলে অন্যকেও নামতে হয়। একজন ভালো থাকলে অন্যকেও ভালো রাখতে পারে।

আমি শুধু একটি কথাই বলব, জীবনসঙ্গীকে বোঝার চেষ্টা করুন, সেটা উভয়ের ক্ষেত্রে। অনেক সময় আমরা বুঝতে পারি না। এমনও হতে পারে তিনি আপনাকে অনেক ভালোবাসেন, অনেক চান, কিন্তু লজ্জায় বলতে পারেন না। আর তার এই না পারাকে আপনি অক্ষমতা ধরে নিচ্ছেন। ভাবছেন আপনাকে অবহেলা করছে, দূরে সরে যাচ্ছে। তাকে সময় দিন। সরাসরি তার সঙ্গে কথা বলুন। এতে সমাধান হলে ভালো, না হয় সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসুন। কিন্তু একই সঙ্গে দুটি সম্পর্কে জড়াবেন না। এতে প্রতারণা তো হবেই সেই সঙ্গে অনেক সমস্যাও তৈরি হবে।

সবচেয়ে বড় কথা নিজের বিবেকের কাছে স্বচ্ছ থাকুন। সম্পর্কের কাছে সৎ থাকুন। এতে করে আপনিও ভালো থাকবেন, আপনার পরিবারের মানুষগুলোও ভালো থাকবে।