যাত্রাসঙ্গী

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সারা শহর যখন ঘুমিয়ে, তখন আলো জ্বলে উঠল খিলক্ষেতের ১৯ নম্বর রোডের ৩ নম্বর বাসায়। রাত তিনটা বেজে কুড়ি। সবাই ঘুম থেকে উঠে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিচ্ছে। দিদি ব্যাগ গোছাচ্ছে আর একটু পরপর চোখ মুছছে। মা বরাবরের মতোই স্বাভাবিক। সবার ঘুমকাতুরে চোখ জলে টলমল করছে অথচ কেউ কাউকে বুঝতে দিতে চাইছে না। বিশেষত আমার সামনে তো একেবারেই না। সবাই চুপিচুপি কাঁদছে অথচ কেউ যেন কাঁদছে না। আমি আজ চলে যাচ্ছি, সকাল ৭টায় ফ্লাইট। আগামী তিন-চার মাস দেখা হবে না আমার সবচেয়ে কাছের আপনজনদের সঙ্গে। গাড়ি বলা ছিল আগেই। চালক এসে ফোন করতেই আমার লাগেজ আর আনুষঙ্গিক কাগজপত্র নিয়ে সবাই রওনা হলাম বিমানবন্দরে।

খিলক্ষেত থেকে বিমানবন্দর খুব কাছে। গাড়ির ভেতরে সামনের আসনে দাদা। আর পেছনে মা, আমি, দিদি আর মৌলি। গাড়ির ভেতর অদ্ভুত নীরবতা। কেউ কোনো কথা বলছে না। যখন বিমানবন্দরের লেনে গাড়ি ঢুকে গেল, এবার মার কান্নার মৃদু আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। মায়ের মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। আমার বান্ধবী ও আমার আপনজনদের আর মাকে রেখে আমি চলে এলাম কাতার এয়ারলাইনসের কাউন্টারে। গন্তব্য সুইডেন। ট্রানজিট পয়েন্ট কাতারে।

ইমিগ্রেশনের সব ফরমালিটি শেষ করে আমি বসে আছি লাউঞ্জে। এবার চোখ ভিজে উঠছে আপনা-আপনিই। সবার মধ্যে কান্না চেপে রাখার মতো ভয়ংকর কঠিন কাজটি আমি করে ফেলেছি গত কয়েক ঘণ্টায়। এবার চোখের জল আর বাঁধ মানল না। অনেকক্ষণ পর আরও কিছু ফরমালিটি শেষ করে বিমানে উঠলাম। বিমানে উঠে আমার আসন খুঁজে পাচ্ছি না। আরে! আমার উইন্ডো সিটে অলরেডি সুট-টাই পরা একজন মধ্যবয়সী ব্যক্তি বসে আছেন। এমন তো হওয়ার কথা না। তার টিকিট দেখতে চাইলাম। ওনার আসন আমার পাশেরটা। তাহলে আমার সিটে কেন বসবেন! আমাকে দু-একবার অনুনয়-বিনয় করলেন, কিন্তু তাতে লাভ হলো না। ফলে মিনিট দু-একের মধ্যে আমি আমার আসন পেয়ে গেলাম।

সেই লোকটি আমার পাশে। তাঁর মধ্যে রাগ বিরক্তির কোনো কিছুই প্রকাশ পেল না। আরও যেন একটু বেশি নরম হলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আমার পঙ্খীরাজ ঘোড়া ধেয়ে চলল আকাশপানে। মানসিক একটা টানাপোড়েনের পর এখন খুব ক্লান্ত লাগছে। একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যেতে পারে এই সময়ে। কিন্তু পাশে বসা মানুষটি কতটা ভদ্রচিত আচরণ করবেন, তা আমার জানা নেই। যদিও মানুষ সম্পর্কে আমার ইনটিউশন যথেষ্ট উন্নত। সেই হিসেবে বলতে পারি এই লোকটির বাজে কোনো মতলব আছে বলে এখনো মনে হচ্ছে না। তবুও ঘুমিয়ে পড়ার আগে একটু পরখ করে নেওয়া ভালো। আমি চুপচাপ সামনে রাখা বিনোদন পত্রিকা দেখে যাচ্ছি। একটু পর ওই ব্যক্তি নিজেই বলতে আরম্ভ করলেন।

: আপনিও কাতার যাবেন?

: না, সুইডেন।

: এই প্লেন সুইডেন পর্যন্ত যাবে?

: না, এইটা যাবে না। কাতারে নেমে অন্য প্লেনে উঠব। আপনি?

: আমি কাতারেই।

: ও আচ্ছা।

লেখিকা
লেখিকা

তারপর আবার নীরবতা। কথা বলে মনে হলো, মানুষটা সহজ ও সাধারণ। কথার মধ্যে আঞ্চলিক ভাষার টান চলে আসে। মেয়েদের একটা সিক্স সেন্স কাজ করে পুরুষের ব্যাপারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হাবভাব আর চোখের তাকানো দেখেই আন্দাজ করতে পারে পুরুষটি কেমন হতে পারে। আমি এবার নিশ্চিন্ত হয়ে চোখ বুজেছি। ঠিক কতক্ষণ পেরিয়ে গেল মনে নেই আর। একটা সময় ঘুমের মধ্য টের পাচ্ছি কেউ আমাকে ডাকছে। তাকিয়ে দেখি, আমার সহযাত্রী ভদ্রলোক। বিমানবালা খাবার সার্ভ করছেন। সহযাত্রী আমাকে বললেন, ‘আপনি একটু বলে দেন না, কী খাব।’ ‘আমি বলে দেব কেন? আপনার যা ইচ্ছা, নিতে পারেন। মেনু তো আপনার হাতেই।’ লোকটা বললেন, ‘আমি ভালো ইংরেজি বুঝি না। আচ্ছা, সমস্যা নাই। আপনি যা নেবেন, আমিও তাই নেই। অসুবিধা নাই।’

অন্য কোনো সময় হলে আমি নিশ্চিতভাবে কিছুটা বিরক্ত হতাম। কিন্তু এই লোকটার কথার মধ্যে একধরনের সহজাত সরলতা আছে। চাইলেও হয়তো চট করে মুখের ওপর বিরক্তি দেখানো যায় না। আমি বললাম, ‘আমি ভেজ (ওহ, উনি তো ইংরেজি ভালো বোঝেন না), মানে নিরামিষ খাই। আপনি নিরামিষ খাবেন?’ লোকটা মনে হয় একটু ভরসা পেলেন। বললেন, ‘নিরামিষ খাওয়া যায়। আর যদি মুরগি-টুরগি পাওয়া যায়, তাহলে সেগুলোও বলতে পারেন।’ আমি তারপরে আমাদের দুজনের জন্যই খাবার নিলাম। খেতে খেতে এবার একটু আলাপ জমতে শুরু হলো। আমিই জিজ্ঞেস করি।

: আপনি বিমানে প্রথমবার যাচ্ছেন?

: জি, এর আগে বিমানে উঠি নাই। এই প্রথম।

: কাতারে প্রথমবার যাচ্ছেন, কাজে?

: কাজেই (আরেকটু থেমে, মুখের খাবার চিবোতে চিবোতে...) কাজ খুঁজতে। আশা করি এক দুই মাসে জোগাড় করে ফেলব। ইনশা আল্লাহ।

আমি একটু অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকালাম। এবার একটু ভালো করে খেয়াল করলাম, খুব কম দামি একটা খয়েরি রঙের স্যুট আর কালো রঙের প্যান্ট। টাইটাও ঠিকঠাক বাঁধা হয়নি। গায়ের রং কালো, মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। দেখে মনে হয়, সব সময় একটা চিন্তার মধ্যে আছেন, অন্য জগতে।

: কাজ না পেয়েই যাচ্ছেন? আপনাকে ভিসা অফিসে আটকায়নি?

: ম্যানেজ করসি। এলাকার এক ভাই কাতারে কাজ করে, তার কাজের ঠিকানা দিয়ে আর কিছু কাগজপত্র দেখিয়ে ম্যানেজ করে ফেললাম। অনেক দিন সময় লাগসে। অনেক জায়গায় ঘুরতে হইসে।

: ও আচ্ছা। উনি কি তাহলে চাকরি পাইয়ে দেবেন?

: না, না। এলাকার ভাই, বোঝেন না! তার নিজেরই নাকি থাকার সমস্যা। তার ওপরে তারও চাকরি পাকা হয় নাই। নিজেই বিভিন্ন জায়গায় জায়গায় ঘুরে চাকরি খুঁজতে হইব। একটা না একটা তো হইবই।

লক্ষ করলাম, তিনি পুরো আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে শুরু করে দিয়েছেন। দুই বাঙালি এক জায়গায় হলে গল্প জমে যাবে এইটাই স্বাভাবিক। আর আমারও একটু কৌতূহল হচ্ছে তার কথাবার্তা শুনে। আবার প্রশ্ন করলাম, ‘এত দিন কী করতেন? দেশে পরিবারের সমস্যা হবে না?’ মানুষটা ছোট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘সমস্যা আর নতুন কী? সমস্যার মধ্যেই তো আছি এত দিন ধরে। চারটা মেয়ে আমার। বড়টা ক্লাস টেনে পড়ে। বাকিরা ছোট ছোট। সবার ছোটটা ৯ মাসের। এত দিন তেমন কিছুই করি নাই। বাদাইম্যা হয়া ঘরে বইসা ছিলাম। বাপের কিছু জমি ছিল, সেগুলা দিয়েই সংসার চলছে৷ বিভিন্ন সময়ে অভাবে পড়ে একটু একটু করে জমিজমা বিক্রি করতে হইসে। এখন আর কিছুই বাকি নাই। বড় মেয়েটার বিয়ের সম্বন্ধ আসা শুরু হইসে বিভিন্ন জায়গা থেকে। বুঝেনেই তো, বিয়ে মানেই অনেক টাকাপয়সার ব্যাপার। আমি অত টাকা কই পাই, বলেন? তাই অনেক ভাবনাচিন্তা করে এই ডিসিশন নিলাম। দুই-এক বছরে টাকাপয়সা কামাই কইরা মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিব আর সংসারটা ভালোভাবে চালাব।’

আমি একটু আবেগপ্রবণ, এটা ঠিক। কিন্তু তাঁর কথাগুলো শুনে আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না কী বলব এই মুহূর্তে। গলা শুকিয়ে গেল। মুখ থেকে আপনি বেরিয়ে এল, ‘কাতার যাওয়ার টাকা পেলেন কোথায়? এত টাকা, বিমানের ভাড়া।’ এই সব প্রশ্ন ছিল?

: এক মহাজনের থেকে সুদে টাকা নিলাম ২ লাখ। ওই টাকা কাতার যাওয়ার কাজে লাগাইসি। চাকরি পাওয়ার পর ধীরে ধীরে শোধ দিব।

: আপনার কী মাথা খারাপ? সুদে কেউ টাকা নেয় এই যুগে!

: আর কই টাকা পাব বলেন, ব্যাংকেও এত টাকা দেয় নাই আমাকে, কিছু করি না যে!

: আপনি দেশে ফিরবেন কবে?

: জানি না। কয় বছর লাগে তা তো কইতে পারি না...! একেবারে টাকাপয়সা জোগাড় কইরা দেশে ফিরব।

আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। চুপ করে ভাবছি। আমি তো অন্তত জানি, কত দিন পরে ফিরব দেশে। কিছুটা আমার ইচ্ছা–অনিচ্ছার ওপরও নির্ভর করে। আর এই লোকটা! এক অজানা জগতে পাড়ি জমাচ্ছে। কোনো লেখাপড়া নেই, চাকরি নেই, কোথায় থাকবে এখনো নিশ্চিত না। আর ২ লাখ টাকা সুদে নিয়ে, বাড়িতে বউ আর মেয়েদের রেখে তাদের ভালো ভবিষ্যতের আশায় কোনো এক মরণজালে জড়িয়ে গেল। আর যদি চাকরি না পায়। যদি বিদেশে খাবার না জোটে। দেশে ফিরে আসার মতো টাকাও তো তাঁর সঙ্গে নেই। আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না।

এরপর আমার আর ওই লোকটির সঙ্গে কথা হয়নি। কাতারে নেমেই আমি দৌড়, অন্য টার্মিনালের দিকে। প্লেনে চড়ে বসি আবার। সিটে বসতেই মনে হলো, আমি কেন ওই লোকটিকে আমার উইন্ডো সিটটি ছেড়ে দিলাম না। জীবনে প্রথমবার প্লেনে চড়েছিলেন। হয়তো জানালা দিয়ে মাটির পৃথিবীটা আরও একবার দেখতে চেয়েছিলেন কিংবা মেঘের অনেক ওপর দিয়ে কেমন করে ছুটে যায় প্লেন...দেখতে চেয়েছিলেন! আমি দিইনি। আমি বুঝিনি। সারা পথজুড়ে শুধু তাঁর মুখটাই মনে পড়ে যাচ্ছে। প্ল্যান ল্যান্ড করল ৬ ঘণ্টা পর। বাইরে বেরিয়ে আসতেই আমার প্রিয়জনেরা আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনায় স্বাগত জানাল। আচ্ছা, কাতারের ওই লোকটিকে কেউ নিতে আসেনি? একা একা কোথায় যাবে? কোন দিকে?

আমার এখনো মাঝেমধ্যেই সেই লোকটির কথা মনে পড়ে। তিনি ভালো আছেন তো? মেয়ের বিয়ের টাকা জোগাড় করে স্বপ্নপূরণ করে একদিন সত্যি দেশে যাবেন তো? যাবেন তো, না...।

(আমার প্রথম সুইডেন আসার প্রথম যাত্রাসঙ্গীর জীবনের গল্প। তাঁর নামটা জানা হয়নি। আমি জানি, তিনি আমার এই লেখাটি পড়ে দেখার সময়ও পাবেন না। হয়তো খুব কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন বা আগের চেয়ে ভালো আছেন। শুধু জানবেন, আমি আপনাকে মনে রেখেছি, আপনার প্রথম বিদেশযাত্রার যাত্রাসঙ্গী।)