পৃথিবীর উত্তরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
পৃথিবীর উত্তরের একটি দেশ নরওয়ে, আর নরওয়ের উত্তরের একটি শহর ট্রমসো। এখানে গুটিকয়েক বাংলাদেশির বসবাস। বছরের সাত থেকে আট মাস বরফের চাদরে ঢেকে থাকে ট্রমসো। প্রতিকূল আবহাওয়া আর দেশি জিনিসপত্রের অপ্রতুলতা থাকা সত্ত্বেও আমরা এখানকার বাংলাদেশিরা চেষ্টা করি আমাদের দেশের সংস্কৃতিকে এখানে ধারণ ও পালন করতে। এর ধারাবাহিকতায় আমাদের এবারের আয়জন ছিল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন।
খুব অল্প সময়ে সবকিছু জোগাড় করা ছিল আমাদের জন্য কিছুটা চ্যালেঞ্জিং। আমরা এখানে যারা বাংলাদেশি আছি সবাই কোনো না কোনোভাবে এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইউনিভার্সিটি অব ট্রমসো, যা কিনা এখন আর্কটিক ইউনিভার্সিটি অব নরওয়ে নামে পরিচিত। এক দিনের মধ্যে আমরা সিদ্ধান্ত নিই এই বিশ্ববিদ্যালয়েই আমরা পালন করব এ বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি। এ ক্ষেত্রে আমাদের ট্রমসো বাংলাদেশি কমিউনিটি ও ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন একসঙ্গে কাজ করে। আমরা অত্যন্ত গর্বিত ও আনন্দিত ছিলাম যে আর্কটিক ইউনিভার্সিটি অব নরওয়ের মাননীয় রেক্টর নিজে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এবং পুরো অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।
আমাদের অনুষ্ঠানটি তিনটি ভাগে ভাগ করা ছিল। প্রথম পর্বে ছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ভিনদেশিদের কাছে তুলে ধরা। এরপর রেক্টরসহ অন্যদের বক্তব্য। দ্বিতীয় পর্বে ছিল শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ। আর তৃতীয় পর্বে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশিসহ অন্য দেশের নাগরিকেরাও অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে ছিলেন নরওয়েজীয়, রাশিয়ান, ইউক্রেনীয়, মঙ্গোলীয়, ভারতীয়, জিম্বাবুয়ানসহ আরও কয়েকটি দেশের নাগরিকেরা। দর্শকসারিতে ছিলেন অন্তত ৩০টি দেশের নাগরিক। বাংলাদেশিরা গান, আবৃত্তি ও নৃত্য পরিবেশন করেন। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটি কোরাস গেয়ে আমরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু করি। আমাদের ছোট ছোট বাচ্চারা বাংলা ছড়া বলে শোনায়। অনুষ্ঠান শেষে দেশীয় খাবারেরও আয়োজন করা হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বিরিয়ানি আর পায়েস।
এ অনুষ্ঠান পালনের সার্থকতা হলো, অনেকেই যাঁরা ২১ ফেব্রুয়ারি বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কী এ সম্পর্কে আগে জানতেন না, তাঁদের কাছে আমরা আমাদের দেশের একটি ইতিহাস তুলে ধরতে পেরেছি। একটি ভাষার জন্যও যে জীবন দেওয়া সম্ভব, এটা অনেকে ভাবতেও পারেন না। কিন্তু আমরা তা ১৯৫২ সালেই করে দেখিয়েছি। পৃথিবীর মানুষ দেখেছে হয়তো আমরা আমাদের দেশ থেকে ৭ হাজার ৫০০ কিলোমিটার দূরে আছি, কিন্তু এই দূর দেশে হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজের দেশের ঐতিহ্যকে লালনপালন করা সম্ভব। অনেক প্রতিকূলতা এ জন্য বললাম, কারণ শহীদ মিনার বানানোর প্রয়োজনীয় জিনিস জোগাড় করতে আমাদের তিন দিন লেগে যায়। ছেলেরা রাত তিনটা পর্যন্ত জেগে থেকে শহীদ মিনার বানানোর কাজ শেষ করে। তবে খুশির ব্যাপার হচ্ছে, রেক্টর আমাদের উৎসাহ দেন এমন প্রোগ্রাম যেন আমরা প্রতিবছর আয়োজন করি।
এমন একটি অনুষ্ঠান আয়জনের জন্য আমি ট্রমসো বাংলাদেশি কমিউনিটি ও ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট ইউনিয়নকে অশেষ ধন্যবাদ জানাব। সেই সঙ্গে আশা রাখব, প্রতিবছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমরা যেন এভাবে সবাই একাত্ম হয়ে পালন করতে পারি।