জীবন যেখানে যেমন

অনেক তুষারপাতের পর ড্রাইভওয়ে ক্লিনিং
অনেক তুষারপাতের পর ড্রাইভওয়ে ক্লিনিং

রসায়নের গবেষণাকাজটা ভালো লাগে। অফিসে কাজে ডুবে থাকতে হয়। সততার সঙ্গে ফলপ্রদ কিছু করা, কঠোর পরিশ্রম করা, পরিষ্কার থাকা ও রাখা, বিশ্বাস, সহানুভূতি ও সম্মান ইত্যাদি নিত্যদিনের অভ্যাস। হাতে–কলমে বাংলাদেশে শেখা। ঢের বেশি সাত বছর জাপানি জীবনে দেখে শেখা। নগণ্য হলেও জীবনের যা কিছু ছোট ছোট অর্জন এর প্রায় পুরোদস্তুর ব্যবহার কানাডায়। আছে বিদ্যমান, হয়তো থাকবে আজীবন। জীবন যেখানে যেমন, হোক না টরন্টো, টোকিও বা ঢাকা শহর! মিশে যেতে হয় সবার সঙ্গে, ভালোভাবে। এটা দরকার। চেষ্টা থাকে ভালো কিছুর।

দুই

শীতপ্রধান দেশ কানাডা। শীতে অত্যন্ত বৈরী আবহাওয়া। তাপমাত্রা হ্রাস। হিমশীতল বাতাস। ঘন ঘন তুষারপাত। তুষার বৃষ্টি, তুষার ঝড় আর চারদিকে জমে থাকা বরফের স্তূপ। ২০১৮-১৯ সালের শীতের শুরুতে ঠান্ডা তেমন ছিল না। ডিসেম্বর শেষ অবধিও ছিল সহনীয় মাত্রায়। বৈরী শব্দকে যথার্থভাবে অর্থবহ করেছে এ বছরের জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারির অসহনীয় ঠান্ডা। বাড়ি, মাঠ-ঘাট চারদিকে বরফের চাদর। রাস্তার পাশে জমানো তুষারের উঁচু বরফ টিলা আর হাড় কাঁপানো ঠান্ডা।

মধ্য ফেব্রুয়ারিতেও টরন্টোতে বেশ তুষারপাত হলো। তুষার বৃষ্টিও। ফলে খুব পিচ্ছিল রাস্তা। অহেতুক দুর্ঘটনা এড়াতে অনেকের মতো ড. সুভাসও তুষার বৃষ্টির দিনে অফিসে আসেননি। কর্মক্ষেত্রে আমার বন্ধু তিনি। পরদিন তাঁর কাছে জানলাম, হিমশীতলেও মানবতার তরে কাজের কথা। সেদিন অফিস ছুটি নিলেও বাড়ির কাজে গাড়ি নিয়ে বের হন তিনি। ব্যারি সিটির পথে। কিনতে হবে কটা জিনিস। প্রচণ্ড ঠান্ডা ও প্রায় জনমানবহীন পাশের হাঁটাপথে চোখে পড়ল চল্লিশোর্ধ্ব এক বয়স্ক নারীকে। হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রা, মাইনাস ২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে হাঁটতে থাকা নারীর শারীরিক অবস্থা বন্ধুর চোখে ভালো ঠেকেনি। গাড়ি থামান তিনি। ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আর ইউ ওকে ম্যাম?’ ‘নট ওকে রিয়েলি’ তাঁর গলার অস্পষ্ট স্বরে সহযোগিতা পাওয়ার আকুতি। পরম মমতায় নারীকে গাড়ি করে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে এই বিপদে তাঁর জীবন বাঁচান তিনি।

বিশ্বাসে শঙ্কাও থাকতে পারে। হরেক রকম মানুষের বাস আমাদের এই সমাজে। বৈচিত্র্যময় আমরা। মানুষ চেনা দায়। সহযোগিতার আশ্বাসে কঠিন বিপদেও অতি সতর্ক মানুষ সাড়া দেন না। মনে শঙ্কা, ট্রাপে পড়ার ভয়। একই দিন ফিরতি পথে প্রচণ্ড শীতে জবুথবু অবস্থায় বাসের অপেক্ষায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুজনকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন ড. সুভাস। তাঁরা সাহায্য নেননি। জানতে পারলাম, তাঁরা দুজন ছিলেন তরুণী। অনুমান করে বলেন, তাঁরা দুজন ভারত থেকে পড়তে আসা কলেজছাত্রী হবে হয়তো। সহাস্যে বন্ধুকে বলি, আমি জানি তুমি পরোপকারী ভালো মানুষ। তবে এই গল্প তোমার সহধর্মিণীকে বোলো না! লাজুক হাসি তাঁর চোখে। বিপদ আঁচ করতে পারছেন বোধ হয়, তাই সায় দিলেন আমার কথায়!

মিস্টার এরাম (ছদ্মনাম), পরিচিত একজন মানুষ। অল্প চেনা। তুষারপাতে জমা বরফে ঢাকা গাড়িটা পরিষ্কার না করেই তাড়াহুড়ো করে রাস্তায় নামান তাঁর স্ত্রী। সজোরে ধাক্কা দেন রাস্তায় বাঁক নিতে থাকা আমার গাড়িটাকে। পরক্ষণেই সে কী কান্নাজড়ানো ভয় তাঁর চোখেমুখে। শান্ত করতে অভয় দিই আমি। স্বামীর সঙ্গে আলোচনা শেষে দুজনে আমার কাছে এলেন। একই দিন, কয়েকবার। বিনীতভাবে অনুরোধ করলেন, গাড়ি ইনস্যুরেন্স কোম্পানির ঝামেলায় না যেতে। দায়িত্ব নেন, গাড়ি ঠিক করার পুরো খরচ দেবেন। তাদের ওয়াদাকে সম্মান করেছি। দিন যায়। ব্যস্ততা কাটিয়ে, তাদের জানিয়ে গাড়ি মেরামত করালাম। এবার খরচের বিলটা দিই এরামকে। কিসের বিল? মাথায় যেন তাঁর আকাশ ভেঙে পড়ল, বেইমানের এই অবাক জিজ্ঞাসা! আরেকজনের মধ্যস্থতায়, আর কয়েকবারের চেষ্টাতেও কোনো কাজ হয়নি। কথা তিনি রাখেননি। মেরামতের ৪০০ ডলার আর পাইনি। নির্লজ্জ তিনি। দেশের মানুষ তাঁর অরিজিনের নাম শুনতে চাইবেন না।

টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের কিতাহারা গ্রুপের বেসবল জেতা দল
টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের কিতাহারা গ্রুপের বেসবল জেতা দল

তিন.

পথ চলতে কোনো কিছু খাবার পর জাপানিরা র‌্যাপিং পেপার বা অবশিষ্টাংশ কাছাকাছি কোথাও ময়লার নির্দিষ্ট বিনে ফেলে। ময়লার বিন না পেলে তা সঙ্গে নিয়েই পথ চলে তারা। আবর্জনা যত্রতত্র ছুড়ে ফেলা ওদের স্বভাবে নেই। নিজের কাপড় ধুতে মেশিনে দেওয়ার আগে প্যান্ট বা শার্টের পকেট থেকে অনেক দিন চকলেট, চুইংগামের র‌্যাপিং পেপার বের করেছি। একই কারণে সেগুলো পকেটে ছিল। পোষা প্রাণীকে অনেক জাপানি নিজ সন্তানের মতো লালনপালন করে। কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরে পোষা প্রাণীকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে হাঁটে। তখন মালিকের হাতে থাকে পলিথিন ব্যাগ। প্রাণীটি মল ত্যাগ করলে তা পলিথিন ব্যাগে নেওয়া হয়, রাস্তায় ফেলে রাখা হয় না। একবার ভাবুন তো, আপনার চারপাশের পরিবেশটা কেমন। পরিবর্তন সম্ভব, ইচ্ছাশক্তিই দরকার।

ইচ্ছে হলেই যেখানে–সেখানে ধূমপান করা যায় না। ধূমপানের জন্য নির্ধারিত ও নিরাপদ জায়গা থাকে বিশ্ববিদ্যালয়, বাসস্টেশন ও ট্রেনস্টেশনে। প্রফেসর ওয়াতানাবে ধূমপান করতেন। ছাত্র–শিক্ষক পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছেন, দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই। শেষে জলন্ত সিগারেটের অবশিষ্টাংশ অবশ্যই নিভিয়ে যথাস্থানে স্তূপ করা দায়িত্ব। সেটা তারা করে। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক প্রফেসর, আমার পিএইচডির সিনিয়র বস ড. কিতাহারা সেনসে পার্টির সময় খুব অ্যালকোহল খেতেন। গবেষণা দলের অনেকেই অ্যালকোহল নেন সেখানে। অধিক খেয়ে মাতাল হওয়া না। তাঁদের নৈতিক শিক্ষা হলো মাতলামি আর অন্যায়কে অবশ্যই না। তাঁরা এসবের ঊর্ধ্বে।

সেই দুজন শিক্ষাগুরুর ল্যাবে টোকিওতে বেশ কটা বছর একসঙ্গে কাটিয়েছি। কী পায়নি তাঁদের কাছ থেকে! পেয়েছি শিক্ষা আর গবেষণাসহ জীবনের সব বড় বড় সহযোগিতা। ল্যাবের পাশেই বিশাল বড় অফিস কক্ষ তাঁদের। দেয়ালে সাঁটা খ্যাতনামা গবেষকদের ছবি, থরে থরে সাজানো জৈব রসায়নের সব আন্তর্জাতিক জার্নালগুলো, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, আছে আরও কত কী! সব পরিষ্কার পরিপাটি। নিজেরাই সাজিয়ে রাখেন, আর পরিষ্কার করেন। নেই কোনো কর্মচারী। প্রায় ২৫ জনের এই রিসার্চ গ্রুপ। বছরে অন্তত দুবার শহরের বাইরে গ্রুপ সফর হয়। কতই না মজার সেসব স্মৃতি! ছিল বেসবল খেলা, বোওলিং খেলা, ওনসেন বাথ ইত্যাদি। ওনসেন বিশ্বব্যাপী জাপানের নিজস্ব বিশেষত্ব। গরম পানির বিশাল আঁধারে সবার কাপড়হীন গোসল। প্রকৃতিতে মিশে যাওয়া। সফর শেষে হোটেল ছাড়ার আগে চোখে পড়ে প্রফেসর ওয়াতানাবে আমাদের গ্রুপের ব্যবহৃত বাথরুম পরিষ্কার করছেন। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় মাথা নুয়ে আসে। নিজেকে কী আর অগোছালো রাখা যায়?

সকাল সাড়ে আটটায় সবার আগেই ল্যাবে আসেন প্রফেসর ওয়াতানাবে। সকাল নয়টা থেকে রাত দশটা, সবাই কাজের মধ্যে নিমগ্ন থাকেন। আবিষ্কারের নেশা সবার অন্তরে। সেদিন রাত ১১টায় কাজ শেষে ল্যাব থেকে বের হলাম। বাসায় যাব। প্রফেসর ওয়াতানাবে আর আমি একই ট্রেনে উঠলাম। টোকিও অতি ব্যস্ত শহর। ট্রেনে বসার কোনো সিট আমরা পাইনি। বসে থাকা মানুষের সামনে ট্রেনের হাতল ধরে দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যাচ্ছি। চার স্টেশন পর আমার সামনের সিট খালি হলো। প্রফেসরকে সেখানে বসার অনুরোধ করলাম। বললেন, সেই সিটে আমার অধিকার বেশি। তিনি দাঁড়িয়েই থাকলেন, আমাকেই বসতে হলো। শ্রদ্ধা তো এসবেই আসে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে লেখক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে লেখক

চার.

পশ্চিমা দেশে বসবাস। জাপানে উচ্চতর শিক্ষা। প্রাণের বাংলাদেশটা দিয়েছে জন্ম। শিখিয়েছে মায়ের বাংলা ভাষা। দিয়েছে খেলার জন্য লাল-সবুজের পুরো জমিনটা। দুহাত ভরে দিয়েছে শিক্ষার অধিকার। গুটিসুটি পায়ে স্কুলে যাওয়া। সেখান থেকে কলেজ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ।

মায়ের সঙ্গে যুক্ত থাকা জন্মের নাড়িটা দেশেই পোঁতা আছে। মমতাময়ী মা আমার চলে গেছেন ২০০৫ সালের ২৯ আগস্টে। যে মাটির গন্ধ শুঁকে বড় হয়েছি, সেই অজপাড়াগাঁয়ে কবরে শান্তিতে ঘুমাচ্ছেন তিনি। মাটির মানুষ, আমার জীবনের শিক্ষক। দেশ ছাড়ার আগে ২০০৩ সালে শেষ দেখা। বিদায় নিয়েছি জাপানের পথে উড়াল দেব বলে। মা বলেছেন মানুষ হও। বড় হও। তাঁর জীবনের সবটুকু ভালোবাসা নিংড়িয়ে আমাকে দিয়ে দিয়েছেন। পরিবারের সবাইকে খাইয়ে, পরে অবশিষ্টাংশটুকু কখন যেন খেতেন। তাঁর জীবনভর দীর্ঘ অসুস্থতায় অপারগ এই হতভাগার এতটুকু সহায়তা তিনি পাননি।

বাংলা মায়ের কোলে বসে অভাবী ভুখানাঙ্গা, দিনমজুর, সমাজের অনেক উঁচুদরের যোগ্যতাসম্পন্ন আর বিত্তবান সব ধরনের মানুষের সঙ্গে সেখানে মেশা হয়েছে। স্মৃতির জানালা খুলে এখন তাকিয়ে আছি, সব দেখছি। জানালাটা মাঝে মাঝে, হঠাৎ হঠাৎই কেন জানি খুলে যায়। দেখি সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নায় ভরা দিনগুলো। অপূর্ণতা আছে, খুব বড় অপূর্ণতা। চোখের অবিরাম জলে ভেজা অপূর্ণতা।

খুব যত্নে লালিত স্বপ্ন ছিল। একদিন শিক্ষক হব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। কাজ করব, মানুষ গড়ব। দেশের জন্য। না সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। ছুটেছি দেশের টানে, বারে বারে। মোট তিনবার (২০০৬ থেকে ২০০৯)। রসায়ন বিভাগের শিক্ষক হওয়ার চেষ্টায়। যোগ্যতার ত্রুটি ছিল না। হয়নি। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক অধ্যাপক কিতাহারা ও অধ্যাপক ওয়াতানাবেরও সে কী সাপোর্ট! তাঁরাও খুব চেয়েছিলেন। তৃতীয়বারে, প্রাণের কার্জন হলে দাঁড়িয়ে চোখের অবিরাম জলে ভিজিয়েছি গায়ে থাকা জামাটা। গড়িয়ে পড়া সেই জলে কার্জন হলের মাটিও সিক্ত হয়েছে। রসায়ন বিভাগের একজন তরুণ শিক্ষক তখন পাশে দাঁড়িয়ে।

পাঁচ.

দেশমাতা তুমি করো তৈরি। করো লালনপালন। দাও শিক্ষা। তোমার সন্তানদের ছড়িয়ে দিয়েছ বিশ্বব্যাপী। এগিয়ে দিয়েছ তুমুল প্রতিযোগিতার মাঠে। শ্রমজীবী, চাকরিজীবী, গবেষক, বিজ্ঞানী, শিক্ষক সবাইকে, সারা দুনিয়ায়। সন্তানেরা অবশ্যই ভালো করছে। তোমার জমিনটাতে পড়ে থাকা সবকিছু বিশ্ব দরবারের কত কাছাকাছি? তুমি ভালো আছ তো? তোমার সামান্য অসুস্থতাতেও তোমার সন্তানেরা লুকিয়ে কাঁদে।
...

ড. মো. সাদেকুল ইসলাম পিএইচডি: রিসার্চ সায়েন্টিস্ট, জৈব রসায়ন।
ই–মেইল: < [email protected]>