নারীদের (কালো মেয়েদের) একাল সেকাল

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আগে আমাদের দাদি-নানিদের যুগে একটা কথা প্রচলিত ছিল—‘জাতের মেয়ে কালোও ভালো, নদীর জল ঘোলাও ভালো’। আমার দাদির গায়ের রং কালো ছিল বলে শুনেছি। কিন্তু তার গুণের আলোতে সেই রং ম্লান হয়ে গিয়েছিল। সেই ব্রিটিশ আমলে তিনি ছিলেন চিন্তা-চেতনায় খুব আলোকিত মানুষ। কলকাতায় পড়াশোনা করতেন। ব্রিটিশ আমলে বৃত্তিও পেয়েছিলেন মেধা ও যোগ্যতায়। সেই যুগের আধুনিক চিন্তায় তিনি সেই সময়ের সমসাময়িক নারীদের থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন।

সেই যুগে কালো, ভালো, দাঁত উঁচু-নিচু নিয়ে মেয়েদের ভাবনা ছিল না। মোটা ছোট সব মেয়েদের সম্মানের সঙ্গে দেখা হতো। বিয়েও হয়ে যেত। আমার সুদর্শন দাদা ছয় দিন নৌকা ঘাটে বেঁধে রেখে অপেক্ষা করছিলেন সৈয়দ বাড়ির সেই গুণী মেয়েকে বিয়ে করতে। সত্যিই নৌকা ঘাটে বাঁধা ছিল। সেই কালো মেয়ের বাবা-মাকে রাজি করাতে পাত্রপক্ষকে সেই যুগে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। আমার ধারণা এই যুগে জন্মালে তাদের বিয়ে বা সংসার হতো কিনা সে নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

আমার দেখা একজন সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা প্রকৌশলী বুয়েটিয়ান মেধাবী নারীকে দেখেছি যিনি খুবই সফল তাঁর পেশা জীবনে, কিন্তু সংসার জীবনে সফল না। তাঁর গায়ের রং আর উচ্চতা, তাঁর এত এত অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। তাঁর ভালো মন, মনুষ্যত্ব ও মেধাকে ছাপিয়ে গিয়ে তাঁর অস্তিত্ব প্রমাণের একমাত্র মাপকাঠি হয়ে গেছে তিনি দেখতে কেমন!

অন্যদিকে কিন্তু এখনো কালো কুচকুচে, খাটো-বেটে ছেলেটা একটা সরকারি চাকরি বা বিসিএস, খুবই ধনী হলে বা দুই-একটা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক হয়ে গেলেই ব্যস এলাকার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটার বিয়ের সম্বন্ধ চলে আসে। মেয়েরাও বিয়ে করে নিয়ে সংসার করে সেই প্রচলিত বাক্য মেনে নিয়ে সোনার আংটি বাঁকাও ভালো। আমাদের সমাজে ছেলেরা সোনার আংটি। ছেলে ফরসা হলেও সুন্দরী মেয়ে চাই আর কালো কুচকুচে হলে তো বেশি সুন্দরী মেয়ে চাই–ই–চাই।

আসুন একটু দেখি খুঁজে দেখি কখন মেয়েরা নারী থেকে পণ্য হতে শুরু করল!

নব্বই দশকের আগে বা পরে যখন থেকে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল দেশে প্রবেশ করে তখন থেকে সুন্দরী মেয়ে কেমন দেখতে তার জন্য একটা মাপকাঠি পেলাম। যেমন সেই ১০০ কোটি মানুষের ভেতর থেকে ছেঁকে বেছে খুঁজে বের করা মাধুরী আর ঐশ্বরিয়া রাইদের নিজের বাড়িতে টিভিতে ড্রয়িংরুমে দেখে নিজের ছেলের বিয়ের জন্য সেই মাপের সুন্দরী মেয়ে খুঁজতে শুরু করি। কোকাকোলার বোতল অনেকটা মেয়েদের শারীরিক অবয়বের মতো বিধায় শুধু নাটক সিনেমার বিজ্ঞাপণেই না কোকাকোলার বোতলের শেপের মেয়ে খোঁজা শুরু হলো পাত্র পক্ষের।

শাবানা–ববিতাদের যুগে একটু মোটা মেয়েদের সুন্দরী মনে করার চল ছিল! আমাদের খালা আর মামিরা যখন শাবানার দুঃখে কেঁদেছেন, কোনো দিন বলতে শুনিনি কেন শাবানা মোটা। আমাদের দেশে যখনই আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে কোকাকোলার বোতলের মতো ফিগারের নায়িকা এসেছে তখন ঢাকাই নায়িকারা পড়লেন বিপাকে। এখন ঢাকাই চলচ্চিত্রেও আর ষাট ও সত্তরের দশকের মতো মোটা নায়িকাদের দাম নেই। সেই সঙ্গে মোটা মেয়েদের পাত্রস্থ করতে একদিকে যেমন কন্যার পিতারা পড়লেন বিপাকে, অন্যদিকে ঢাকার সিনেমার একটু মোটা নায়িকাদের ডাক আসা বন্ধ হয়ে গেল। সেই তুমুল জনপ্রিয় নায়িকা নিজেকে আয়নায় বারবার দেখেন আর প্রশ্ন করেন, কই আগের মতোই তো আছেন, তবে?

তবে এখন দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে।

এখন শাবানা বা শাবনূররা সুন্দরী কিনা সেটা তুলনা করার জন্য বিশ্ব সুন্দরী ঐশ্বরিয়া রাইরা আছেন। প্রেমিকরাই বা বাদ যাবে কেন। প্রেমিক ও স্বামীরা বউয়ের রান্না তেলে ভুনা ভুনা বিরিয়ানি খেয়ে কোমল সুন্দর থলথলে ভুঁড়িতে হাত বুলিয়ে টিভির চ্যানেলটা বদলাতে গিয়ে বউ ও প্রেমিকার দিকে, ‘একটু ওজনটা কমাতে পারলে তোমাকেও না ঐশ্বরিয়া রায়ের মতো লাগত।’

নিখুঁত সুন্দরী হতে গিয়ে মেয়েরা এখন আত্মহত্যাও করেছে। আমার পরিচিত একজন মেয়ের কাছে শুনেছি ক্লাসমেট সহপাঠী থেকে আত্মীয়রা বা অন্য সুন্দরী মেয়ে বান্ধবীরা পর্যন্ত কথায় কথায় ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত করতে ছাড়েন না। স্কুলশিক্ষক একজন খুবই অসাধারণ গুণী নারীকে দেখলাম দীর্ঘ জীবন একা থেকেছেন কারণ কালো বলে পাত্রপক্ষের অপমানে আর বিয়েটা হয়নি।

বেগম রোকেয়া অনেক আগে বলে গিয়েছিলেন, ‘যে শিক্ষা একমাত্র নারী মুক্তি দিতে পারে’! কিন্তু বেগম রোকেয়া এ-যুগে জন্মালে বলতেন একমাত্র সুন্দরী হলেই কেবল নারীর মুক্তি ও মর্যাদা হতে পারে।

তবে এই চিত্র কেবল আমাদের উপমহাদেশেই। যদি সারা-পৃথিবীতেই তাই হতো তাহলে বারাক ওবামা কালো বউকে ভালোবেসে ঘর করতেন না। আফ্রিকার কালোরা সাদাদের দেশেও একজন কালো মেয়েকেই ভালোবাসে। জন্মের পরে গায়ের রং কালো বা ফরসা হওয়া এক জেনেটিক্যাল, দুই সেই দেশের আবহাওয়া আর জলবায়ুর সঙ্গে সম্পর্কিত। এখানে সেই মেয়ের কোনো হাত নেই। বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতাই অনেক সাদা মেয়েদের পেছনে ফেলে কালো মেয়েরা বিজয়ের মুকুট মাথায় নিলেও আমাদের দেশ এখনো এতটা উদার হতে পারেনি। এই সব দেশে সেই কোকাকোলার ফিগারের পোশাক থেকে বেরিয়ে মেয়েরা ঢিলেঢালা পোশাকে ঘরে-বাইরে কাজ করছেন। চকচকে সিরিয়ালের নিখুঁত সুন্দরীদের দেখে দেখে আমাদের দেশেও মানুষের মাথায় ঢুকে গেছে সেই সারাক্ষণ সুন্দর নিখুঁত থাকার প্রতিযোগিতা!

কিন্তু ইউরোপ–আমেরিকার রাস্তার বিলবোর্ডে ছবিগুলোর বিজ্ঞাপনে সাদার পাশাপাশি কালো মেয়েদেরও দেখেছি। বড় বড় বিলবোর্ড। কোনো মেকআপ নেই। বরং হাইহিলের খটখট শব্দ, ফ্যাশন আর মেকআপ থেকে এই সব দেশে বেরিয়ে আসাকেই স্মার্টনেস মনে করে। তারা হাইহিল ও মেকআপকে একটু বেশি ফেমিনিজম মনে করে।

আমাদের দেশে মানুষের চিন্তা–চেতনা, মস্তিষ্ক–মননে যত দিন আমরা বর্ণবাদ থেকে বেরোতে না পারব তত দিন নারীদের মুক্তি নেই।