প্রবাসে কাশফুলের খোঁজে

কাশফুল হাতে লেখকের মেয়ে
কাশফুল হাতে লেখকের মেয়ে

গ্রামীণ জীবনধারার সঙ্গে কাশফুল বা কাশবনের সম্পর্ক সেই আদিকাল থেকে। কাশের বেড়া (দেয়াল) ও ছাউনি দেওয়া ঘর এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সরঞ্জামাদির মধ্যে সবচেয়ে প্রাকৃতিক। কাশ তার নিজের মধ্যে অনেক বাতাস ধরে রাখতে পারে বলে প্রাকৃতিক শীতাতপযন্ত্রের কাজ করে। গ্রামে দুই ধরনের কাশ পাওয়া যায়। একটার পাতা একটু চওড়া আর অন্যটার পাতা সরু। চওড়া পাতার কাশটাকে আমাদের গ্রামের ভাষায় বলা হতো পাতিল। এর পাতা অনেক ধারালো। কেটে গেলে সেই ঘা সহজে সারে না। বরং সেটা পেকে গিয়ে সেখান থেকে পুঁজ বের হয়, তারপর একসময় শুকিয়ে যায়। এর কাণ্ডটাও একটু স্ফীত হয় আর মূল যায় মাটির অনেক গভীর পর্যন্ত। তাই গ্রামে চলাচলের জন্য মাটি দিয়ে উঁচু করে রাস্তা তৈরি করা হলে মাটি ধরে রাখার জন্য তার দুই ধার দিয়ে সারিবদ্ধভাবে কাশগাছ লাগিয়ে দেওয়া হয়। এই কাশের ফুলের ছড়াটাও অন্যটার তুলনায় একটু বেশি লম্বা ও বেশি সাদা। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় এটাতে ফুল আসে। আমরা দল বেঁধে বড়দের কথা না শুনে কাণ্ডটাকে বাঁকিয়ে এনে কাশফুল পাড়তাম। তারপর সেটা পতাকার মতো হাতে ধরে পাড়াময় ঘুরে বেড়াতাম। এ ছাড়া এই কাশের বনে খয়েরি এক ধরনের পাখি বাসা বাঁধত। আমরা নজর রাখতাম কখন তারা ডিম পাড়ে। কখন ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। তারপর পাখির বাসা থেকে কখনো ডিম আবার কখনো বাচ্চা চুরি করতাম।

কাশফুল হাতে লেখকের ছেলে ও মেয়ে
কাশফুল হাতে লেখকের ছেলে ও মেয়ে

দ্বিতীয় প্রকারের কাশকে আমরা বলতাম কাশি (বইয়ের ভাষা কাশ)। এটা সাধারণত হতো গ্রামের মাঠে। আমাদের এলাকাগুলো একসময় নদীর চর ছিল। তাই কোনো জমি পতিত পড়ে থাকলেই সেখানে আপনা-আপনি কাশবন গজিয়ে উঠত। তবে সেগুলো দৈর্ঘ্যে খুব বেশি বড় হতো না। শৈশবে প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদনের জন্য এই কাশবন বহুল ব্যবহৃত হতো। আর বাসায় আত্মীয়স্বজন এলে যখন অনেক বাচ্চাকাচ্চা একসঙ্গে হতো তখন কাশবনে প্রাকৃতিক কর্মটা সারা অনেকটা উৎসবে পরিণত হতো। এ ছাড়া আমরা এই কাশবনে বাসা বাঁধা ভারই (কোয়েল) পাখির বাসা থেকে ডিম চুরি করে আনতাম। তবে এই কাশফুলগুলো সবচেয়ে ভালো হতো নদীর বুকে নতুন জাগা চরে। আমাদের আগের বাড়িটা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। তাই চর জাগলেই সেখানে আমাদের একটা অস্থায়ী বাড়ি করা হতো চরে শস্য চাষাবাদে সুবিধার জন্য। তখন নৌকা থেকে কাশের বনগুলো দেখতে দারুণ লাগত। বিশেষ করে জ্যোৎস্না রাতে এক স্বর্গীয় দৃশ্যের অবতারণা হতো। আমার বেশ কয়েকবার সৌভাগ্য হয়েছে এই অপূর্ব দৃশ্য দেখার। চরের এই কাশবন গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অন্যতম আয়ের উৎসও। তাই এটা নিয়ে চলত কাইজা (মারামারি)।

বাংলাদেশে থাকাকালে আমরা থাকতাম উত্তরার কাছে। আমার মেয়ে তাহিয়ার জন্ম বাংলাদেশে। তাহিয়া একটু বড় হওয়ার পর থেকে সে ছিল আমার সব ধরনের পাগলামির নিত্য সহচর। শরৎকাল এলে কাশফুল জোগাড় করা আমাদের কাছে জরুরি মনে হতো। ব্যস, বাপ-বেটি মিলে চলে যেতাম উত্তরার পেছনে দিয়াবাড়িতে। আর হাত ভর্তি করে তুলে নিয়ে আসতাম কাশফুল। তারপর সেই কাশফুল দিয়ে আমরা বাসার বারান্দা সাজাতাম। মেয়ের মা বলত, এতে ঘর নোংরা হয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। তাহিয়া কাশফুলকে পতাকার মতো করে ধরে বাড়িময় দাপিয়ে বেড়াত। আমি সেটা দেখতাম আর মনে মনে শৈশবের দিনগুলোর কথা ভাবতাম। সেই কাশফুল তুলতে গিয়ে একদিন একজনের সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি তার গরুগুলোকে চড়াতে এনেছিলেন। আমি তাহিয়াকে বললাম, দাদুর সঙ্গে তোমার ছবি তুলে দিই। সে সানন্দে রাজি হয়ে গেল। এভাবে বাংলাদেশে দিনগুলো আমাদের ভালোই কাটছিল।

কাশফুল হাতে লেখকের প্রতিবেশীর মেয়ে জেইনা
কাশফুল হাতে লেখকের প্রতিবেশীর মেয়ে জেইনা

কিন্তু জীবনের গতিময়তায় একদিন অস্ট্রেলিয়া এসে হাজির হলাম আমরা। এখানে ট্রেনে একদিন যাওয়ার পথে বাইরে কাশফুল দেখে মেয়ে বলল, ‘বাবা তুমি তো আমাকে এখনো কাশফুল এনে দাওনি।’ আমারও মনে হলো আমরা অনেক কিছুই আবিষ্কার করেছি এখানে এসে। কিন্তু কাশফুল জোগাড় করা হয়নি। প্রতিবছর শরৎকাল এলেই আমি মনে মনে প্রতি মুহূর্ত খুঁজে ফিরি সাদা কাশফুল। খুঁজতে খুঁজতে গত বছর সন্ধানও পেয়েছি বেশ কয়েক জায়গায়। এর মধ্যে একটা কনস্ট্রাকশন সাইট। সেটার চারদিকে তারের বেড়া দেওয়া। তাই ঢুকতে পারিনি। ট্রেনে যেতে যেতে একটা বনের মধ্যে দেখলাম কাশফুল। কিন্তু ওখানে কীভাবে পৌঁছানো যায়, সেটা এখনো বের করতে পারিনি। এ ছাড়া একবার দেখেছিলাম সিডনি বিমানবন্দরের ঠিক উল্টো পাশে বেশ কিছু কাশফুলের ঝোপ।

একদিন ট্রেনে করে অফিসে আসার সময় জানালা দিয়ে দেখছিলাম কোথাও কাশফুলের দেখা পাওয়া যায় কি না? ওলাইক্রিক স্টেশন পার হয়ে রেললাইনের ডান দিকে ঘন বন। দৃষ্টি রেখেছিলাম সেদিকে। বন শেষ হওয়ার পর দেখি রেললাইনের তারের বেড়ার সঙ্গে একগুচ্ছ কাশফুল। দেখে এতই খুশি হলাম যে মনে হলো, তখনই গিয়ে তুলে নিয়ে আসি। কিন্তু বিরতিহীন ট্রেন হওয়ায় পরের স্টেশনে নামা সম্ভব হলো না। ভাবলাম সপ্তাহান্তের দিনগুলোতে এসে নিয়ে যাব। কিন্তু মনে একটা শঙ্কা কাজ করছিল, যদি এই সময়ের মধ্যে কোম্পানির লোকজন কেটে ফেলে দেয়। কারণ কাশফুল শুকিয়ে গেলে সেটা বাতাসে ভেসে পরিবেশ নোংরা করে। সিদ্ধান্ত নিলাম শনিবার খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে যাব টরেলা স্টেশনে। কাশফুলের চিন্তায় রাতে ঠিকমতো ঘুম পর্যন্ত হলো না। রাতে দুবার ঘুম ভেঙে গেল। সকাল হতে না হতেই আর দেরি করলাম না। টোরেলা স্টেশনে যেতে হলে প্রথমে ওলাইক্রিক স্টেশনে যেতে হয়। তারপর আবার উল্টোদিকে ফেরত এসে নামতে হয়। যাওয়ার পথে আবারও কাশফুলের অবস্থানটা দেখে নিলাম। আগের দিন একগুচ্ছ দেখে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেদিন দেখলাম মাত্র একটা। ওলাইক্রিক স্টেশনে নেমে ফিরতি ট্রেন ধরে টোরেলা স্টেশনে নেমে রাস্তা পার হয়ে কাশফুলের কাছে পৌঁছে গেলাম।

টরেলা স্টেশনে কাশফুলের ঝাড়
টরেলা স্টেশনে কাশফুলের ঝাড়

কাশফুলের কাছে পৌঁছে দেখি ঝাড়টা কাঁটাতারের বেড়ার বাইরে। আর অনেকগুলো ফুলের মধ্যে একটা কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক গলে রেললাইনের এলাকায় ঢুকে পড়েছে। তাই সেটা ছাড়া বাকি ফুলের ছড়াগুলো কেটে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আমি কাশফুলের ঝাড়টা দেখে বুঝলাম এটা আমার ছোটবেলায় দেখা পাতিল গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। পাতাগুলোর কিনার বেশ ধারালো। তবুও আমি সেই ধার উপেক্ষা করে একেবারে গোড়া থেকে ফুলের ছড়াটা ভেঙে নিলাম। পরে অনেক কসরত করে কাঁটাতারের বেড়ার ওপর দিয়ে বের করে আনলাম। হাতে নিয়ে দেখলাম সব মিলিয়ে উচ্চতায় আমার চেয়ে লম্বা। তারপর সেটাকে পতাকার খুঁটির মতো করে ধরে স্টেশনে চলে এলাম। ট্রেনের দোতলায় উঠে সোজা করে ধরে রাখতে গিয়ে লক্ষ করলাম সেটা ট্রেনের ছাদের সঙ্গে লেগে যাচ্ছে। তাই দোতলা থেকে নেমে দুই বগির মাঝামাঝির জায়গাটাতে বসলাম। খেয়াল রাখলাম যাতে রোদ না লাগে। কারণ এই ফুল ঝাড় থেকে তুলে ফেলার পর দ্রুতই শুকিয়ে বাতাসে ভাসতে শুরু করে।

তারপর মিন্টো স্টেশনে নেমে সেগুলো গাড়ির পেছনের সিটে কাত করে রেখে দিলাম। কারণ সোজা করে রাখলে গাড়ির প্রস্থে কুলাচ্ছিল না। তারপর সরাসরি গেলাম রূপা বৌদিদের বাসায়। এই মানুষটা যেকোনো উপলক্ষেই ছেলেমানুষের মতো খুশি হন। এ ছাড়া কাশফুল বিষয়ে ওনার উত্তেজনা অনেক বেশি ছিল। হাতের কাছে পেয়ে একেবারে বাচ্চাদের মতো করে হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেখছিলেন। তাঁর মেয়ে এলভিরা এসেও সেটা ছুঁয়ে দেখল। এরপর আমি আমাদের বাসার উদ্দেশে রওনা দিলাম। তাহিয়া তো কাশফুল দেখে হাজারো প্রশ্ন ও বিভিন্নভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে শুরু করল। মাঝে ছেলে রায়ান এসে তাহিয়ার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইছিল। আমরা কয়েকটা ছবি তুলে ফেললাম। এরপর আমাদের প্রতিবেশী ফাহিমা এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। তিনিও আমাদের মতোই অনেক বেশি খুশি হলেন। তিনি সবাইকে ডেকে ডেকে দেখাতে শুরু করলেন। একসময় তাঁর শাশুড়ি সন্ধ্যা ভাবি এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। ফাহিমার মেয়ে জেইনাও এল।

কাশফুলের ঝাড়
কাশফুলের ঝাড়

মাত্র একটি কাশফুল একসঙ্গে এতগুলো মানুষকে আনন্দ দিতে পেরেছে দেখে আমার খুবই ভালো লাগছিল। ভোরের ঘুম বাদ দিয়ে কাশফুল তুলে আনার কষ্টটাকে সার্থক মনে হচ্ছিল। প্রকৃতি আমাদের আশপাশেই আনন্দের অনেক উপকরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে। আমরা যদি আমাদের দৃষ্টি স্মার্টফোনের স্ক্রিন থেকে একটু সরিয়ে পাশে তাকাই, তাহলেই দেখতে পাব প্রকৃতি কত উদারভাবে আমাদের সুখী করার হাজারো উপকরণ সাজিয়ে রেখেছে।
...

লেখকের ই-মেইল: <[email protected]>