শুনতে পাই যা শুনতে চাই

সপরিবার লেখক
সপরিবার লেখক

‘We hear what we want to hear.’

স্কুলের শেষে ছুটির সময় আমার চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে যারিয়াকে আনতে গিয়ে বিভিন্ন দেশের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলতে বেশ আনন্দই লাগে। একজন ইতালিয়ান দাদির সঙ্গে গল্প হয়, যিনি দুই নাতিকে স্কুলে দিয়ে যান। আবার ছুটির সময় নিতে আসেন। আরও আছেন বেশ কয়েকজন, যাঁরা এখানে প্রাত্যহিক ভাষা ইংরেজির চেয়ে যিশুখ্রিষ্টের মুখের প্রাচীন ভাষা ‘আরামাইক’-এ গল্প করেন। সিরিয়ার খ্রিষ্টধর্মের অনুসারীরা সিডনির এই অঞ্চলের বাসিন্দা। আছেন মুম্বাই শহরের একজন। এ ছাড়া ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ফিজি, সামোয়া ও টোঙ্গার মানুষ। আমার ব্যক্তিগত আগ্রহের গবেষণার বিষয় ‘মানব পৃথিবী’ (Human Geography)। পৃথিবীজুড়ে হরেক রকমের মানুষের দেখা পাওয়া, তাদের সংস্কৃতি অনুভব করতে পারা আমার কাছে ‘ঈদের খুশির মতো বিষয়’। ওই দিন স্কুলের ঘণ্টা দেওয়ার মিনিট পাঁচ আগে গল্প করছি, পাশেরজনের সঙ্গে পরিচয় নেই দেখে আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার বাড়ি কি ভিয়েতনাম?’

উত্তর এল আমার না জানা কোনো আঞ্চলিক উচ্চারণে ইংরেজিতে, কানে এল ‘Et ti mo’, খেয়াল করলাম চেহারা অনুন্নত নাসিকাসমৃদ্ধ, চোখে উত্তর আমেরিকার আদিবাসী ভাব আছে। আমি দুয়ে দুয়ে চার মেলালাম, বাপরে এস্কিমো! আমি আনন্দে গদগদ হয়ে বললাম, ‘আপনিই প্রথম এস্কিমো, যাঁর সঙ্গে আমি কথা বলছি, আগে কখনো এই সৌভাগ্য হয়নি!’

আমি এরপর থেকে স্কুলে গেলেই খুঁজি তাঁকে। কী জিজ্ঞেস করব চিন্তা করি। কিছুই যে জানি না। এটা জানি যে Inuit নামের মতো কোনো জাতি, ভাষা আছে এস্কিমোদের মাঝে। সিডনি এমনিতেই মানুষের রঙের বাজার। বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করলে ম্যানচেস্টার থেকে সাও পাওলো, কোরিয়া, লাটভিয়া, ইস্পাহান, জিম্বাবুয়ে, টার্কি, তাতারস্তান কত উত্তরই না পেয়েছি। এতে এবার এস্কিমো যুক্ত হলো!

কয়েক দিন আগে স্কুলে গিয়ে ওই ভদ্রমহিলাকে পেয়ে আবার আনন্দিত হয়ে গেলাম। কী জিজ্ঞেস করব, সেটা নিয়ে চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে গেলাম। ইগলু বানানো নিয়ে নাকি সিডনির গরম বরফের দেশের মানুষ কীভাবে সহ্য করেন, তাই জানব কি?

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘সিডনিতে অনেকজন আছেন আপনার দেশের মানুষ?’

উত্তর এল, ‘অনেক এবং অনেক!’

‘ওহ, তাই নাকি!’ মনে হলো বাহ, মেরু অঞ্চলের এত মানুষ এখানে থাকে! ‘তা কী ভাষায় কথা বলেন দেশে আপনারা?’

‘চাইনিজ, ইন্দোনেশিয়ান, ইংরেজি, এই তো।’

আমি অঙ্কে হোঁচট খেয়ে ভূগোল, ভাষা, চেহারা, ভাষার টান নতুন করে মেলাতেই দুই চারের পর ছয় করে মুচকি হাসি দিলাম। আমার শোনার ভুলে ‘Et ti mo’ হয়ে গেছে ‘Eskimo’, উনি আসলে ‘East Timor’-এর বাসিন্দা। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি নতুন দেশ। অস্ট্রেলিয়ার খুব কাছে। ইন্দোনেশিয়া থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত। ভুল শুনেছি ভেবেই খুব মজা লাগল। আমি তো আরেকটু হলে ইগলু আর মেরু ভালুকের কথা জিজ্ঞেসই করে ফেলতাম!

তবে নিশ্চয় কোনো না কোনো দিন সত্যি করে একজন এস্কিমোর সঙ্গে কথা হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত ইগলু আর মেরু ভালুক নিয়ে প্রশ্নগুলো আমার আপন ‘ভূগোলে’ সযত্নে জমা থাক। আপাতত পূর্ব তিমুরের মানুষের কাছে তাঁদের গল্প দিয়ে আমার মানব পৃথিবীর বাগান সাজাই।