জুলিয়েট হাউস

ভেরোনাতে এক দিন
ভেরোনাতে এক দিন

উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ারের নাম শুনলেই প্রথমে মনে আসে ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’-এর কথা। আর রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েটের সঙ্গে গেঁথে আছে ইতালির সুন্দরতম শহর ভেরোনার নাম। এই অমর প্রেমকাহিনির চিত্রপট ভেরোনা শহরের দুই অভিজাত পরিবারের দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করেই। শুধু রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েটই না, উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ারের লেখা ‘দ্য টু জেন্টেলম্যান অব ভেরোনা’ নামের সেই সময়কার তুমুল জনপ্রিয় নাটকের পটভূমিও এই ভেরোনাতে। সুতরাং ঐতিহাসিক সেই ভেরোনা শহর দেখা একটা অন্য রকম আনন্দের। অবাক করা সব মজার তথ্য জানা আরও আনন্দের।

ভেরোনাতে দর্শনার্থীদের জন্য সব থেকে আকর্ষণীয় স্থান হলো জুলিয়েট হাউস। মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল, নাটকের কাল্পনিক এই বাড়ি এল কোথা থেকে। গাইডকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, বাড়িটা নাকি আসলেই সে সময়ের ‘ক্যাপেলো’ পরিবারের ছিল। পরবর্তী সময়ে ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য ভেরোনা কমিউনিটি কিনে নেয় ১৯০৫ সালে। সেই থেকে এটা দর্শনীয় স্থান হিসেবে অবারিত। ধারণা করা হয়, উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ার কোনো একসময় ভেরোনাতে এসেছিলেন এবং এই বাড়িটাকে স্মরণে রেখে তাঁর অমর সৃষ্টি কল্পনা করেন।

জুলিয়েট ব্যালকনি
জুলিয়েট ব্যালকনি

আশ্চর্য হলাম জেনে, নাটকে দুই পরিবারের যে দ্বন্দ্ব দেখানো হয়েছিল, বাস্তবে এমন কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। এটাই হয়তো লেখকের ক্যারিশমা। নাটকে বর্ণিত রোমিওর ডাকে সাড়া দিতে জুলিয়েট ছুটে এসে যে বারান্দায় দাঁড়াত, সেটার আদলে একটা জুলিয়েট ব্যালকনি এখনো আছে এই বাড়িতে। মজার ব্যাপার, সারা পৃথিবী থেকে এখনো জুলিয়েটের কাছে কপোত-কপোতীরা চিঠি লেখেন প্রেম-সম্পর্কিত উপদেশের জন্য। নথিপত্রের হিসাব অনুযায়ী ১৯৩০ সালের পর থেকে আজ অবধি এই চিঠি লেখার সিলসিলা চলে আসছে। আরও মজার বিষয়, এই রকম চিঠির সংখ্যা নেহাত কম না। প্রতিবছর পাঁচ হাজারের বেশি চিঠি আসে জুলিয়েটের নামে। এসব চিঠি তিন ভাগের দুই ভাগ আবার লেখেন মেয়েরা।

প্রেম-সম্পর্কিত নানান সমস্যার সমাধান বা উপদেশ বা আশীর্বাদস্বরূপ এসব চিঠির উত্তর দেওয়ার ব্যবস্থা আছে আজও। জুলিয়েট হাউসের দোতলায় একটা অফিস আছে। এখানে যাঁরা এই চিঠিসংক্রান্ত কাজ করেন, তাঁদের বলা হয় জুলিয়েট সেক্রেটারিজ। বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এসব হালের রোমিও বা জুলিয়েটরা শুধু দূর থেকে চিঠি লিখেই ক্ষান্ত দেন না, দূরদূরান্ত থেকে এখানে আসেন একবার এই বাড়িটা দেখতে এবং সঙ্গে নিজেদের মনের মানুষের উদ্দেশে চিঠি বা চিরকুট লিখে জুলিয়েট হাউসের উঠানের চারপাশের দেয়ালে সেঁটে দিতে। আবার কেউ কেউ লাভ লকের ওপর দুজনের নাম লিখে মানত করে এখানের গ্রিলে আটকিয়ে রেখে যান। এমনকি খেয়াল করে দেখলাম পুরো উঠানের চারপাশের দেয়ালের প্রতিটা ইটের ওপরে একজন অন্যজনকে উদ্দেশ করে উইশ লিখে রেখেছেন। আর এটা চলছে শত বছর ধরে।

জুলিয়েট মূর্তি
জুলিয়েট মূর্তি

দেয়ালে এত পরিমাণ চিরকুট লাগানো ও নোংরা করার হাত থেকে জায়গাটাকে বাঁচাতে ভেরোনা প্রশাসন বাড়িটির প্রবেশদ্বারে প্লাস্টিকের ওয়াল তৈরি করে দিয়েছে যাতে সহজে পরিষ্কার করা যায়। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, শুধু জুলিয়েটের কাছে লেখা চিঠি এতটাই জনপ্রিয় যে ‘লেটারস টু জুলিয়েট’ নামে হলিউড আস্ত একটা রোমান্টিক মুভিও তৈরি করে ফেলেছে ২০১০ সালে। সুতরাং বোঝাই যায় কোন পর্যায়ের রোমান্টিক স্থান এটি। এখানে যে দিকেই তাকানো হোক না কেন, রোমান্টিক ভিউ পাওয়া যাবে। এমনকি জুলিয়েট হাউসের সব ঘরেই রোমিও আর জুলিয়েটের স্মরণে সেই সময়কার জিনিসপত্রে সজ্জিত আছে। এসব দেখার মধ্যেও যথেষ্ট রোমাঞ্চ আছে। মাত্র ২ ইউরো দিয়ে এই ঐতিহাসিক বাড়ির ভেতর ঘুরে দেখা যায়।

রোমান্টিক কাপলদের জন্য আছে এক চরম আকর্ষণ। ৫ হাজার ইউরো বা ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে তাঁদের মধুচন্দ্রিমার এক রাত কাটাতে পারবেন এই বাড়ির একটা কক্ষে। সঙ্গে থাকবে রাজকীয় আপ্যায়ন।

ভেরোনা এম্ফিথিয়েটার বা অ্যারেনা
ভেরোনা এম্ফিথিয়েটার বা অ্যারেনা

সব থেকে হাস্যকর অভিজ্ঞতা হলো, জুলিয়েট হাউসের উঠানে একটা বেদিতে জুলিয়েটের একটা পিতলের মূর্তি আছে অনেক পুরোনো। অনেকে এই মূর্তির বরাত দিয়ে বলে থাকেন, আদতেই জুলিয়েট নামের কোনো তরুণী ছিলেন এই বাড়িতে। জুলিয়েট মূর্তিকে কেন্দ্র করে ভেরোনাতে একটা মিথ প্রচলিত আছে, যদি কেউ এই জুলিয়েট মূর্তির বুকের ডান পাশ স্পর্শ করে, তাহলে তার ট্রু লাভ খুঁজে পাবে খুব শিগগিরই। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে হাজার হাজার রোমিও-জুলিয়েট সেটা স্পর্শ করতে লাইন ধরবেন। পাক্কা ১১ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে মূর্তিটির কাছে যেতে পেরেছিলাম। স্পর্শ করেছিলাম কি না, সেটা না হয় না-ই বলি।

এ ছাড়া ‘এদিগে’ নদীর তীরে গড়ে ওঠা ভেরোনা অসম্ভব সুন্দর ও গোছানো একটা শহর। ভেরোনাতে মেডিয়েভাল স্থাপনাসহ দেখার আরও অনেক কিছুই আছে। প্রাচীন শহুরে নির্মাণ ও স্থাপনার জন্য ইউনেসকো এই নগরীকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভেরোনা এম্ফিথিয়েটার বা অ্যারেনা, যেটা এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আর ঘোষণা করে যাচ্ছে হাজার বছর আগেকার রোমান শৌর্যবীর্যের কথা। গ্ল্যাডিয়েটরেরা একসময় একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ করত আর চারপাশে হাজার হাজার দর্শক উল্লাস করত তা দেখে। একসঙ্গে ৩০ হাজার মানুষের ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন এই এম্ফিথিয়েটার বা অ্যারেনা হল ইতালিতে তৃতীয় বৃহত্তম। তখনকার দিনে এটা এত বড় ছিল যে, পুরো ভেরোনার সব মানুষ একসঙ্গে এটায় জমায়েত হতে পারত।

সান পিয়েত্র ক্যাসেল
সান পিয়েত্র ক্যাসেল

এ ছাড়া আছে রোমান থিয়েটার, সান পিয়েত্র ক্যাসেল, ল্যাম্বের্টি টাওয়ার ও কাস্তেল ভেচ্চিও ক্যাসেলসহ অনেক অনেক দর্শনীয় স্থান সেই সঙ্গে ভেরোনার টিপিক্যাল খাবার তো আছেই।
...

মোহাম্মাদ মেহবাহুল হক: The University of Bologna, Bologna, Italy. ফেসবুক: <www.mezba.info>