আপন থেকে পর ভালো

আমি খুব একটা মানুষের সঙ্গে মিশতে না পারলেও অসামাজিক নই। মানুষের সঙ্গে সাধারণ ভদ্রতাটুকু বজায় রাখতে জানি। আমার ভুবনের পুরোটা জুড়েই ছিল আমার মা-বাবা আর ভাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাইনাল ইয়ারে থাকাকালে হুট করে বিয়ে হয়ে যায় এক অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসীর সঙ্গে। বিয়ের পরপরই ফাইনাল পরীক্ষা। এ ছাড়া বাইরে যাওয়ার কাগজপত্র গোছানো। সবকিছু মিলে কেমন যেন এক নিমেষেই সময় চলে গেল।

২০১৫ সালের মাঝামাঝি আমি অস্ট্রেলিয়ায় এলাম। সাধারণত কোনো একটা নতুন দেশে যাওয়ার আগে মানুষ সেখানে থাকা পরিচিত মানুষের খোঁজ নেয়। নিতান্ত একই দেশের কেউ হলেও তাকে আপনের চেয়ে আপন মনে হয়। সে দিক দিয়ে আমি মোটামুটি ভাগ্যবানই বলা চলে। আমার মায়ের খালা-খালু, তিন খালাতো ভাই, তাঁদের বাচ্চাকাচ্চা সবাই এখানে থাকেন। মায়ের খালাতো ভাই শুনতে অনেক দূরের শোনালেও আমাদের সঙ্গে তাঁদের ভালো সম্পর্কই ছিল। তাঁরা অস্ট্রেলিয়ায় খুব বেশি দিন হয়নি এসেছেন। দেশে তাঁদের বাড়ি আর আমার নানাবাড়ি পাশাপাশি। সারাক্ষণ যাওয়া–আসা ছিল। এমনকি আমি চলে আসার আগে আমার ওই নানির সঙ্গে দেখা করে বলে এলাম, আপনি কবে যাবেন? আমি তো ওই দেশে কাউকে চিনি না। তাঁরাও আমাকে এই দেশ সম্পর্কে ভালো–মন্দ ধারণা দিলেন। আমি যখন আসি, নানা-নানি তখন দেশে। আর আমার মামারা অস্ট্রেলিয়ায়। আব্বু একদিন মোবাইলে এক হাজার টাকা রিচার্জ করে এনে বললেন, দেখি তো ওদের একটু ফোন দিয়ে বলি যেন মেয়েটাকে একটু দেখে রাখে। আব্বু তখনো ফেসবুক বা এ–জাতীয় কিছু সম্পর্কে জানতেন না। তো আব্বু ফোন দিয়ে আমার লোকাল গার্জিয়ান বানিয়ে দিলেন আমার মামাদের।

এরপর আমি এলাম। তেমন পরিচিত কেউ নেই। বাঙালিরা যেখানে থাকেন, আমরা সেখান থেকে একটু দূরেই থাকি। বলে রাখা ভালো, আমার বর ঘরকুনো মানুষ। কাজের পর তিনি নিজের জগতে থাকতেই পছন্দ করেন। আমার মাঝেমধ্যে খারাপ লাগে। আম্মু একদিন বললেন, তোর মামার বাসা থেকে ঘুরে আয়। আমরা ফোন দিলাম। মামা বললেন, তারা বাসায় নাই। পরে ফোন দেবেন বললেন। আর কোনো যোগাযোগ করেননি।

এরপর অনেক দিন গেল। বছরও গেল। কোনো এক ঈদের সময় মামা দেশে গেলেন। আমার মায়ের মনে হলো, আহারে মেয়ে আর জামাইকে একটা কাপড় যদি পাঠাতে পারতাম! মা মামাকে বললেন। মামা বললেন, ঠিক আছে আমি নিয়ে যাব, সমস্যা নাই। তিনি আম্মুর থেকে প্যাকেট নিলেন। কিন্তু ওটা তিনি আদৌ সঙ্গে নিয়ে এসেছেন, নাকি দেশেই রেখে এসেছেন খবর নেই। ওনারও আর কোনো খবর নেই। এদিকে আম্মু বলেন, একটা ফোন দিয়ে দেখ কী বলে। আমি বললাম, আগে একবার ফোন দিয়েছিলাম, মনে নাই তোমার? আমি পারব না। মা আমাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল শুরু করলেন। যা হোক, ফোন দিলাম। বললেন যে এনেছেন তিনি। আমাকে বললেন, আমার ভার্সিটির সামনে দিয়ে যাবেন। ওনার অফিস ওখানেই! প্যাকেট পেয়ে আম্মুকে জানালাম। আম্মু বললেন, বাসায় যেতে বলে নাই? আমি কড়া করে বলে দিলাম, আর যেন কিছু না পাঠান।

আরও বছরখানেক কেটে গেল। পরের বছর কোরবানির ঈদ। আমরা ক্যানবেরায় যাব। আমার বরের বন্ধু আর ভাবি খুব করে বললেন তাঁদের সঙ্গে ঈদ করতে। ঈদের দুই দিন আগে আমার ওই যে নানি, তিনি ফোন দিলেন। বললেন, আপু আসো, একসঙ্গে ঈদ করি। আমি অসুস্থ মানুষ। কত দিন হসপিটাল ছিলাম। আমি বললাম, আমরা তো একজনের বাসায় যাব বলে ঠিক করেছি। যদি সময় পাই দেখা করে যাব। ক্যানবেরার পথেই তাঁদের বাসা। নানিও বললেন, আচ্ছা আমি অপেক্ষা করব। বরের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করলাম ঈদের দিন সন্ধ্যায় মামার বাসায় যাব। সেখান থেকে একবারে বাসায় চলে আসব। ঈদের দিন সকালে আমি মামাকে ফোন দিলাম। তিনি কাজে ছিলেন। আমি তাঁকে বললাম আমরা আসছি রাতে।

এই ফাঁকে বাসার বাচ্চাদের জন্য চকলেট আর হাবিজাবি কিনলাম। সারা দিন ভালোই কাটল ক্যানবেরার ভাই-ভাবির সঙ্গে। বিকেলের দিকে রওনা দেওয়ার সময় মামাকে মেসেজ পাঠালাম আমরা রওনা দিচ্ছি। বাসার ঠিকানাটা একটু পাঠান। কোনো উত্তর নেই। আবার পাঠালাম। ফোন দিলাম। অনেকক্ষণ পর উত্তর দিলেন। আমি কাজে, ভাবিকে ফোন দিয়ে জানাচ্ছি। আমরা তখন তাদের বাসা থেকে আধঘণ্টা দূরে। মেসেজ পাঠালেন, সবাই তো দাওয়াতে গেছে, তোমরা কালকে আসো।

একটা লাইনে আমার মাথা ঘোরানো শুরু করল। বরকে কীভাবে বলব এই কথা? তাঁকে বললাম, কোথাও থামাও, আমার খারাপ লাগছে। ও বলল, চলেই তো এসেছি, চলো মামার বাসায় যাই একবারে। আমি বললাম, আমি পারব না আজকে, খুবই খারাপ লাগছে। গাড়ি ঘুরিয়ে আমরা বাসার দিকে রওনা দিলাম। তারপর আরও সাড়ে তিন ঘণ্টা আমার কীভাবে পার হয়েছে, তা শুধু আমিই জানি। আজ পর্যন্ত আমি আমার বরকে এ কথা বলিনি। কোন মুখে বলব? নিজের পরিচিত মানুষ থেকে যে ব্যবহার পেলাম, একবারে অপরিচিত মানুষ এর থেকে অনেক অনেক আপন করে নিয়েছেন। এ জন্যই বোধ হয় বলে, আপন থেকে পর ভালো!