জহুরা ও একটি পতাকার গল্প

কইগো, ছাতাটা দাও। যেই রোদ! হাটে যামু।

রহিম মিয়ার আওয়াজ শুনে জহুরা তাড়াতাড়ি ছাতা নিয়ে এসে বলল, আব্বা, এই নেন ছাতা। হাটে যাইতাছেন? একটু সাবধানে যাইয়েন। শুনলাম দেশের অবস্থা ভালো না।

রহিম মিয়ার স্ত্রী হনুফা বেগম রান্নাঘর থেকে চিৎকার করতে করতে সারা বাড়ি মাথায় তুলে উঠানে এসে হাজির হলো।

—হায় হায় হায়! এইডা কী করলা বউ? তুমি ক্যান ছাতা লইয়া আইলা? আমি কি মইরা গেছি? সক্কাল সক্কাল তোমার মুখটা না দেখাইলে হইত না? তোমার আব্বা হাটে যাইতাছে। তুমি ক্যান দৌড়ায় আইলা?

জহুরা কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, আম্মা আমি তো ছাতা দিতে আইছিলাম!

হনুফা বেগম খেপে গেলেন, চুপ করো বউ! তোমার মতো অপয়া, অলক্ষ্মীরে ঘরে রাখছি—এইডাই অনেক। নয় বছর হইল বিয়া হইছে, কিন্তু আমার পোলাডারে একটা সন্তান দিতে পারো নাই। আমার বংশডায় একখান প্রদীপ জ্বালাইতে পারো নাই।

রহিম মিয়া স্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলল, আহ্ জয়নালের মা! এত চিল্লাইতাছো ক্যান? ছাতাডাই তো আইন্না দিছে। আর তো কোনো দোষ করে নাই। আমার দেরি হইয়া যাইতাছে। তোমরা একটু সাবধানে থাইকো। শুনছি, পাকবাহিনীরা আমাগো গেরামেও যেকোনো মুহূর্তে ঢুইকা পড়ব। বাজারসদাই যা পারি লইয়া আসি।

রহিম মিয়া তাড়াতাড়ি চলে গেলেন।

শাশুড়ির মুখে অপয়া, অলক্ষ্মী শব্দগুলো জহুরার নিত্য শুনতে হয়। মাঝে মাঝে জহুরার ইচ্ছে করে গলায় দড়ি দিতে। প্রাণহীন রোদে পোড়া তপ্ত উঠোনে দাঁড়িয়ে জহুরা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে।

হনুফা বেগম আবার ধমকে ওঠে, হইছে, আর কাইন্দা নাটক করতে হইব না। দোষ কইরা এখন আবার চোখের পানি ফালায়।

মায়ের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে জয়নাল গামছা দিয়ে ভেজা শরীর মুছতে মুছতে মায়ের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, কী হইল আবার, মা? এত চিল্লাইতাছো ক্যান?

হনুফা বেগম নাকি সুরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, চিল্লাই কী সাধে রে বাপ? তোর বন্ধ্যা বউরে কতবার কইছি বাড়ি থেইক্কা কেউ বাইর হওনের সময় যেন সে সামনে না আসে, কে শোনে কার কথা? তার তো চাঁদমুখখান দ্যাখাইতেই হইব।

জয়নাল তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল, তোর এত্ত বড় সাহস! তুই মায়ের কথার অবাধ্য হইছস? তোর এই অভিশপ্ত মুখ দ্যাখাইতে লজ্জা করে না?

জহুরা ভয়ে কোনো কথা বলল না। কিছু বললেই তো আবার জয়নালের হাতে মার খেতে হবে তাই চোখের জল ফেলতে ফেলতে ঘরে চলে গেল।

জয়নাল জহুরাকে শুনিয়ে শুনিয়ে চিৎকার করে মাকে বলতে লাগল, মা, তুই চিন্তা করিস না। আমি আবারও বিয়া করুম। তোর ঘরে আবারও লক্ষ্মীর পা পড়ব। তুই নাতি-নাতনির মুখ দেখবি। এই অলক্ষ্মীরে যত তাড়াতাড়ি পারি বিদায় করুম।

বদ্ধ দুয়ারে মাথা ঠুকে জহুরা চিৎকার করে ওঠে, হে আল্লাহ! ক্যান আমারে বন্ধ্যা কইরা দুনিয়াতে পাঠাইলা? ক্যান আমি আমার স্বামীরে একটা সন্তান দিতে পারলাম না। ক্যান আল্লাহ?

ভরা পূর্ণিমার রাত। দূর থেকে এশার আজানের মধুর সুর ভেসে আসছে। দাওয়ায় বসে জহুরা নির্বাক তাকিয়ে আছে সুপারিগাছের ফাঁকে উঁকি দেওয়া নিঃসঙ্গ পূর্ণিমার চাঁদের দিকে। আজ সারা দিন জয়নাল একটিবারের জন্যও জহুরার সঙ্গে কথা বলেনি। খুব বড় অন্যায় কি সে করেছিল? স্বামীর কাছ থেকে এত অবহেলা সহ্য হয় না। এই মানুষটা কত ভালোবেসে জহুরাকে বিয়ে করেছিল অথচ আজ ওর মুখটা পর্যন্ত দেখতে চায় না। এত বেশি ঘৃণা করে জহুরাকে। একটা সন্তান না দিতে পারার অপরাধে দিনের পর দিন কত-না অত্যাচার করেছে জয়নাল আর তার মা মিলে। এসব কথা মনে পড়লেই জহুরার দুই চোখ বেয়ে একসমুদ্র নোনা জল গড়িয়ে পড়ে।

এমন সময় রহিম মিয়া চিৎকার করতে করতে বাড়িতে ঢুকল, জয়নালের মা, কই তুমি? তাড়াতাড়ি আসো।

শ্বশুরের আওয়াজ পেয়ে জহুরা এক পা সামনে গিয়েও আবার দাঁড়িয়ে পড়ল। মনে হচ্ছে, খবর ভালো না। সামনে গেলে যদি আবার শাশুড়ি কিছু বলে, তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

হনুফা বেগম ছুটে এসে জিজ্ঞেস করল, কী হইছে? চিল্লাইতাছেন ক্যান?

—জয়নালের মা, খবর ভালো না। মিলিটারিরা আমাগো গেরামে ঢুইক্কা পড়ছে। মসজিদে গিয়া দেখি সবাই আলোচনা করতাছে। আমি তাড়াতাড়ি নামাজ সাইরা বাড়িত চইলা আইছি। তোমার পোলা কই?

জয়নালের মা চিৎকার দিয়ে উঠল, হায় হায়, এখন কী হইব? আমাগো গেরামেও ঢুইকা পড়ছে? জয়নাল হেই যে দুপুরবেলা ঘর থেইক্কা বাইর হইছে, এখনো আসে নাই। রাগে চোখ বড় বড় করে জহুরার দিকে তাকাল জয়নালের মা। পোলার মনে শান্তি আছে? এই কালনাগিনী তো আইজকা সকালবেলাই অলক্ষ্মী লাগাইছে। পোলাডা দুপুরে ভাতও খায় নাই। এখন কই গিয়া পইড়া আছে।

জহুরার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। মানুষটা কোথায় গেল? গ্রামে মিলিটারি ঢুকেছে আর তার কোনো খবর নাই।

রহিম মিয়া বিরক্ত হয়ে জয়নালের মাকে বললেন, কথায় কথায় বউমারে দোষ না দিলে তোমার বুঝি ভাত হজম হয় না। পোলাডারে তো বানাইছো একটা বাদাইম্মা। হে তো এমনিই সারা দিন বাইরে ঘুইরা বেড়ায়। তোমরা ঘরের ভেতর চইলা যাও। আল্লাহরে ডাকো। আমি যাই পোলাডারে খুঁইজা লইয়া আসি।

রহিম মিয়া ছেলের খোঁজে আবার বের হয়ে গেলেন।

হনুফা বেগম আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে ঘরের ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিল, জহুরা পেছন থেকে ডেকে বলল, আম্মা দাঁড়ান! আমি আইতাছি আপনার লগে।

জয়নালের মা চিৎকার দিয়ে উঠলেন, খবরদার! আমার ঘরে আওনের চেষ্টা ভুলেও করবা না। তোমারে না একদিন কইছি, তুমি বংশের বাত্তি যেই দিন জ্বালাইতে পারবা, সেই দিন আমার ঘরে আইবা। জয়নালের মা ঠাস করে দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে দিল।

জহুরা নির্বাক বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। শুধু মা হতে পারেনি বলে আজ তাকে এত অপমান আর গ্লানি মাথায় নিয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে হচ্ছে। এভাবে কতক্ষণ কেটে গেল জহুরা জানে না। রাতের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে হঠাৎ গোলাগুলির আওয়াজে জহুরা সংবিৎ ফিরে পেল। মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ আর মানুষের চিৎকারে আকাশ ভারী হয়ে উঠল। জহুরা ভয়ে দিগ্‌বিদিকশূন্য হয়ে শাশুড়িকে ডাকতে লাগল।

—আম্মা, দরজাডা খোলেন। পাকবাহিনীরা আমাগো গেরামডারে ছারখার কইরা ফালাইতাছে।

হনুফা বেগম প্রচণ্ড রাগী, একগুঁয়ে আর আত্মকেন্দ্রিক নারী। নিজের কথার বাইরে একচুলও নড়েন না। জহুরার ডাক শুনে রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে জানালার সামনে এসে দাঁড়াল, বউ, তুমি তোমার ঘরে গিয়া চুপ কইরা বইসা থাকো। আল্লাহরে ডাকো। আমাগো দুইজনের স্বামী বাইরে। হেরা যেন সুস্থভাবে বাড়ি ফিরা আসে, সেই দোয়া করো। যদিও তোমার মতো মেয়েছেলের দোয়া আল্লাহ কবুল করব কি না সন্দেহ, তারপরও সতী নারী স্বামীর জন্য সব করতে পারে। যদি জীবন দিতে হয়, তাও পারে। যাও, নিজের ঘরে গিয়া দরজা বন্ধ কইরা দাও।

মুখোমুখি দুটো টিনের ঘর। মাঝখানে উঠোন। বড় চৌচালা টিনের ঘরটিতে জহুরার শ্বশুর-শাশুড়ি থাকে আর ছোট টিনের ঘরটিতে থাকে জহুরা আর জয়নাল। শুরুতে ভালোই সম্পর্ক ছিল বউ-শাশুড়ির মধ্যে। কিন্তু যখন বিয়ের নয় বছর হয়ে যাওয়ার পরও জহুরার কোলে কোনো সন্তান আসেনি, তখন থেকেই সম্পর্কের অবনতি ঘটে তাদের মধ্যে। হনুফা বেগম জহুরাকে তার ঘরে ঢুকতে নিষেধ করে দেয়। এমনকি হুমকি দিতে থাকে, আর এক বছরের মধ্যে যদি জহুরা বংশের প্রদীপ না জ্বালাতে পারে, তবে জয়নালকে আবারও বিয়ে করাবে।

জহুরার প্রচণ্ড রাগ হলো শাশুড়ির ওপর। এমন ঘোর বিপদেও মহিলা তাকে অপদস্থ করতে ছাড়ছে না। পুরো বাড়িতে এখন মাত্র দুজন মহিলা। কোথায় একসঙ্গে থাকবে, তা না করে নিজের জেদ ধরে বসে আছে।

জহুরা চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। চারদিকে কেবল গুলির আওয়াজ আর মানুষের চিৎকার। শ্বশুর আর স্বামীর দুশ্চিন্তায় অন্ধকার দেখতে লাগল জহুরা।

এভাবে রাতের গভীরতা যত বাড়তে লাগল, উৎকণ্ঠাও দ্বিগুণ হতে লাগল। থেকে থেকে গুলির শব্দ কেবল প্রিয়জন হারানোর বন্দনা করতে লাগল। ওঘর থেকে হনুফা বেগম কেবল জোরে জোরে বিলাপ করতে লাগল আর সবকিছুর জন্য জহুরাকে দায়ী করতে লাগল।

জহুরা নামাজের বিছানায় বসে স্বামী আর শ্বশুরের জন্য আল্লাহর কাছে দুহাত তুলে মোনাজাত করে, হে আল্লাহ! তুমি এই বিপদে আমাগো সাহায্য করো। আমার স্বামী আর আব্বা কেউই এখনো বাড়ি ফিরে নাই। তাগো কোনো খোঁজখবর জানি না। আল্লাহ, তুমি তাদের হেফাজত কইরো। তারা যেন ভালোয় ভালোয় বাড়ি ফিরা আসে। জয়নালের মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। জয়নাল যতই জহুরাকে এখন ঘৃণা করুক না কেন, একটা সময় তো ঠিকই জহুরাকে ভালোবাসত। কত আদর-সোহাগ করত। সেই সব পুরোনো মধুর স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরেই তো জহুরা এখনো বেঁচে আছে।

—আরে আরে কী করেন? ছাড়েন। কেউ দেইখ্যা ফালাইব।

জহুরা উঠানে কাপড় মেলছিল। পেছন থেকে হঠাৎ জয়নাল এসে জহুরাকে জাপটে ধরে।

জয়নাল হাসতে হাসতে বলে, দ্যাখলে দেখুক! আমি আমার চাঁন্দের লাহান বউডারে আদর করলে কার কী?

জহুরা লজ্জায় লাল হয়ে বলে, ধুর, কী যে কন! মায় দ্যাখলে কী কইব? ছাড়েন তো! আমার অনেক কাজ আছে।

—না, ছাড়ুম না। তোরে কাছে পাইলে ছাড়তে মন চায় না। জহুরাকে আরও কাছে টেনে নেয় জয়নাল। কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,
আমাগো পোলা-মাইয়া হওনের পর তো তোরে আর যখন-তখন জড়ায় ধরতে পারুম না, তাই যত পারি তত...।

জহুরা আসলে কল্পনার ঘোরে ছিল। ছেলেমেয়ের কথাটা মনে আসতেই সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। মানুষটার কত স্বপ্ন ছিল ঘর আলো কইরা পোলা-মাইয়া হইব। সব স্বপ্ন আমি ভাইঙা দিলাম। হে আল্লাহ! কেন আমারে বন্ধ্যা কইরা দুনিয়াতে পাঠাইলা?

এমন সময় হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ। জয়নাল হয়তো ফিরেছে। জহুরা তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিল। জয়নাল না, রক্তাক্ত অবস্থায় এক যুবক হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। জহুরা ভয়ে চিৎকার করতে চাইলে ছেলেটি জহুরার মুখ চেপে ধরল। জহুরার সমস্ত শরীর ভয়ে কাঁপছে। ছেলেটি ফিসফিস করে বলল, ভয় নাই। আমি মুক্তিযোদ্ধা। আমারে মিলিটারি ধাওয়া করছিল। হাতে গুলি লাগছে। বুবু, কিছু সময়ের জন্য তোমার ঘরে আমারে একটু আশ্রয় দাও। কাঁপা কাঁপা স্বরে কথাটা বলতে বলতেই ছেলেটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

ছেলেটির মুখে বুবু ডাক শুনে জহুরার বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যায়। কত বছর পর বুবু ডাকটা শুনল! আট বছর বয়সে পানিতে ডুবে মারা যায় জহুরার ছোট ভাই কাজল। জহুরার আদরের ছোট ভাই! বুবু বুবু বলে সারাক্ষণ জহুরার পেছনে পেছনে ঘুরত। কাজল মারা যাওয়ার পর আর কেউ এভাবে জহুরাকে বুবু বুবু বলে ডাকেনি। জহুরা তাড়াতাড়ি দরজা আটকে দিল। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণে ছেলেটি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। জহুরা কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। হাতে গুলি লেগেছিল। গুলিটা বাঁ হাতের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। রক্ত পড়া বন্ধ করার জন্য ছেলেটি হাতটা গামছা দিয়ে বেঁধেছিল কিন্তু যতটুকু রক্ত বের হয়েছে, তাতে ছেলেটি দুর্বল হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। জহুরা হাতে বেঁধে রাখা গামছাটা খুলে পরিষ্কার একটা কাপড় দিয়ে ক্ষতস্থানটা বেঁধে দিল। আরেকবার ঘরের দরজাটা খুলে দেখল কোথাও রক্ত পড়ে আছে কি না। ওঘর থেকে শাশুড়ির বিলাপ আপাতত বন্ধ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে গেছে। জহুরা আবারও ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিল। কিছু সময়ের জন্য জহুরা যেন মনের অজান্তেই নিজের হারানো ভাইকে খুঁজে পেল।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পুরো গ্রাম মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়েছে। আশপাশের সব গ্রামে পাকবাহিনী আক্রমণ করলেও রতনপুর নামের ছোট্ট শ্যামল গ্রামটার খোঁজ ওরা পায়নি। দেশকে শত্রুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এ গ্রামের যুবকেরা গোপনে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। আশপাশের অন্যান্য গ্রামের যুবকেরা এ গ্রামে গোপন যুদ্ধশিবিরে প্রশিক্ষণ নিতে এসেছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। গ্রামের কিছু পাকিস্তানপন্থী খোঁজ পেয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের। তারাই খবর দেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীদের আর মুহূর্তেই শান্তির রাজ্য রতনপুরে অশান্তি নেমে আসে।

মধ্যরাত। জহুরা ছেলেটির মাথার কাছে বসে আছে। ছেলেটি ধীরে ধীরে চোখ খুলল। মাথা এখনো ঝিমঝিম করছে। জহুরা স্নেহের সুরে ছেলেটিকে বলল, ভাই, এখন কেমন লাগতাছে?

ছেলেটি ভীষণ দুর্বল। মৃদু স্বরে উত্তর দিল, এখন একটু ভালো লাগতাছে। বুবু, তোমারে অনেক ধন্যবাদ। তুমি আমারে আশ্রয় না দিলে এতক্ষণে মইরা পইড়া থাকতাম।

—অমন কথা কয় না ভাই। তুমি বহ। তোমার লাইগা ভাত লইয়া আসি। মুখটা কেমন শুকায় আছে।

ছেলেটি প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত। ভাতের কথা শুনে যেন আবারও জীবন ফিরে পেল।

জহুরা চুপিচুপি ঘর থেকে বের হয়ে রান্নাঘরে ভাত আনতে গেল। খাবার নিয়ে যখন উঠান পার হয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল, তখন হঠাৎ হনুফা বেগম জহুরাকে ডাক দিলেন, বউ, এত রাইতে খাওন নিয়া কই যাও? জয়নাল আইছে?

জহুরার বুকটা ধক করে কেঁপে উঠল। জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়ানো হনুফা বেগমের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে জহুরা বলল, না মা। আপনের পোলা আহে নাই। আমার অনেক খিদা লাগছে তাই ভাত নিতে আইছি। আপনি ঘুমাইতাছেন তাই ডাকি নাই। খাড়ান, আপনার খাওন লইয়া আসি।

—থাক থাক। আমার জন্য তোমার ভাবতে হইব না। স্বামী-শ্বশুর এখনো বাড়ি ফিরে নাই, বাইচ্চা আছে না মইরা গেছে ঠিক নাই, তোমার গলা দিয়া খাওন ক্যামনে নামব, হেইডাই ভাবতাছি। এ জন্যই তোমারে আল্লাহ বন্ধ্যা কইরা দুইন্নাতে পাঠাইছে। যার অন্তরে দয়ামায়া নাই, তারে আর...।

জহুরা আর সইতে পারল না। না চাইতেও অনুচ্চস্বরে শাশুড়িকে বলে ফেলল, থামেন আম্মা। আর না। বন্ধ্যা বন্ধ্যা কইতে কইতে আমারে শেষ কইরা ফালাইতাছেন। আপনি তো মাইয়া মানুষ, ক্যামনে আরেকজন মাইয়ারে এইভাবে কষ্ট দিতাছেন আর আমি বন্ধ্যা হেইডা আপনি নিশ্চিত হইলেন ক্যামনে? আপনের পোলারও তো সমস্যা হইতে পারে হেইডা ভাবেন না ক্যান?

হনুফা বেগম তেলেবেগুনে জলে উঠল, কী কইলি কালনাগিনী? আমার পোলার সমস্যা? দাঁড়া, ভালোয় ভালোয় জয়নাল ফিরা আসুক। তোরে তাড়ায় আবারও আমার পোলারে বিয়া করামু।

জহুরা আর কোনো কথা বলল না। সোজা ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল।

ছেলেটি মাথা নিচু করে চুপ করে বসে আছে।

—নাও ভাই। ভাত খাও।

—আমার জন্য ভাত আনতে গিয়া তোমার অনেক কথা শুনতে হইল বুবু!

জহুরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, নারে ভাই। এগুলা আমার প্রতিদিনই শুনতে হয়। পোড়াকপাল নিয়া আইছি দুইন্নাতে। মা হইবার পারি নাই। বন্ধ্যা মেয়েছেলে...বলেই জহুরা কান্নায় ভেঙে পড়ল।

—বুবু, কাইন্দ না। আমার মন বলে তুমি বন্ধ্যা না। আল্লাহ তোমার মতো এত ভালা একটা মানুষরে বন্ধ্যা কইরা সৃষ্টি করে নাই। তুমি দেইখো, তুমিও মা হইবা।

জহুরা চোখ মুছে বলে, ভাই, এখন খাও তো! রাইত পোহায় যাইতাছে।

অভুক্ত ছেলেটি গোগ্রাসে ভাত খেতে লাগল। মনে হচ্ছে, কত জনম পর এক মুঠো ভাত সে পেয়েছে। কত তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। জহুরা মুগ্ধ হয়ে দেখছে। চোখের সামনে যেন ছোট ভাই কাজলের মুখটা ভেসে উঠল।

—ভাই, তোমার নাম কী?

—সবুজ।

—আমার ছোট ভাই কাজল বাইচ্চা থাকলে তোমার লাহান এত বড়ই হইত। আচ্ছা ভাই, যুদ্ধ তোমার ভয় লাগে না?

সবুজ হাসে আর বলে, ভয় লাগব ক্যান? দেশটারে বাঁচাইতে হইব না? পাকিস্তানি শত্রুগুলারে মাইরা বিনাশ না করা পর্যন্ত শান্তি নাই।

—তোমার মায় তোমারে দিল যুদ্ধে যাইতে?

সবুজের দুচোখ ছলছল করে উঠল, শুরুতে দিতে চায় নাই। অনেক কান্নাকাটি করছে। কিন্তু যখন দ্যাখল একের পর এক নিরীহ মানুষগুলারে ওই শত্রুরা গুলি কইরা মারতাছে, তখন মায় নিজে আমারে কইল, যা বাজান, যুদ্ধে যা। দেশটারে বাঁচা। মিলিটারির থেইক্কা সবুজ পতাকাডা ছিনায় আন। আমাগো গেরাম তো ছারখার কইরা দিছে। আমি গোপনে তোমাগো গেরামে যুদ্ধের ট্রেইনিং নিতে আইছি। কিন্তু এই গেরামের কিছু লোক পাকিস্তানিগো আমাদের শিবিরের কথা ফাঁস কইরা দিছে। আমি কোনো রকমে জানডা হাতে নিয়া পালায় আইছি।

জহুরা কৌতূহল নিয়ে সবুজকে জিজ্ঞেস করে, এই শরীর নিয়া আবারও কি যাইবা যুদ্ধে?

সবুজ দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দেয়, অবশ্যই যামু। এখনই তো সময়। দেশের জন্য দরকার হইলে জান দিমু, তবুও শত্রুর হাতে দেশটারে বিক্রি করুম না।

সবুজের কথায় জহুরার মনটা ভরে গেল।

—ভাই, তোমার লগে আমারে যুদ্ধে নিবা? আমিও যুদ্ধ করুম।

সবুজ হাসতে হাসতে বলে, তুমি যুদ্ধে যাইবা? তোমার মতো এমন লক্ষ্মী একটা মাইয়ার যুদ্ধে গিয়া মরণের দরকার নাই। তুমি বাড়িত থাইক্কা আমার জন্য দোয়া কইর আমরা যেন দেশটারে স্বাধীন করতে পারি। আর বুবু, আমার একটা কথা তুমি রাখবা?

—কী কথা, ভাই?

—যুদ্ধে বাঁচুম কী মরুম জানি না। তুমি যদি পারো, আমাগো গেরাম সৈয়দপুরে আমার মায়েরে একটু দেইখ্যা আইসো। মায়ে আমার জন্য ভাত বাড়ছিল কিন্তু আমি খাওনের সুযোগ পাই নাই। তুমি মারে কইয়ো, আমার বড় বইনে আমারে প্যাট ভরাইয়া ভাত খাওয়াইছে। কী, পারবা না কইতে, বুবু।

সবুজের কথা শুনে কেঁদে ফেলল জহুরা, ভাই, এমন কথা কয় না। আমি যামু তোমাগো বাড়ি। আমার ভাই দেশটারে স্বাধীন কইরা সবুজ পতাকা নিয়া ফিরা আইব।

এভাবে সবুজ আর জহুরা কথা বলতে বলতে ফজরের আজানের সুর ভেসে এল। সবুজ এবার যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো।

—বুবু, এখন আমার যাওনের সময় হইয়া গেছে। একটু পরে ভোরের আলো ফুইট্টা উঠব। তার আগে আমার এইখান থেইক্কা চইলা যাইতে হইব। পাকিস্তানিরা বাড়ি বাড়ি গিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ করতাছে।

—ভাই, যাওন নাই। কও আসি। সাবধানে যাইয়ো।

সবুজ জহুরাকে উদ্দেশ করে বলল, বুবু, তুমি সাবধানে থাইকো। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তোমার স্বামী আর শ্বশুর যেন সুস্থভাবে ফিরা আসে।

সবুজ জহুরার কাছে বিদায় নিয়ে দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে চলে গেল।

একটা দুর্বিষহ নির্ঘুম রাত্রি আর অনিশ্চিত প্রতীক্ষায় ক্লান্ত হয়ে কখন জহুরা ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছে টের পায়নি। ঘুম যখন ভাঙল, তখন পুরো বাড়িটি ঘিরে ফেলেছে মিলিটারিরা। ওদের চিৎকারে পুরো বাড়ি যেন থরথর করে কাঁপছে! জহুরা ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে জানালা একটু ফাঁক করে বাইরে তাকাল।

গ্রামের মাতব্বর কেরামত আলীসহ দশ-বারোজন মিলিটারি। হনুফা বেগম পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। জহুরা কী করবে বুঝতে পারছে না।

মিলিটারির মধ্য থেকে যে অফিসার সে হনুফা বেগমকে উচ্চ স্বরে জিজ্ঞেস করল, তুমহারি ঘারমে মুক্তি হে?

হনুফা বেগম হাঁ করে তাকিয়ে আছে? কেরামত আলীর দিকে তাকিয়ে হনুফা বেগম বলল, বেডায় কয় কী?

কেরামত আলী সদ্য পাকিস্তানিদের সহযোগীর খাতায় নাম লিখিয়েছে। সে হনুফা বেগমকে ফিসফিস করে বলল, তোমাগো বাড়িতে কি কোনো মুক্তিযোদ্ধা আসছিল?

হনুফা বেগম ভয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কোনো কথা বলল না।

অফিসার চিৎকার দিয়ে ধমকে উঠল, চুপ কিউ হো? সাচ বাতাও। কোই মুক্তি আয়া থা?

জহুরা কিছু বুঝতে পারছে না। ঘর থেকে বের হওয়া উচিত হবে কি না, সেটা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছে। শাশুড়ি বৃদ্ধ মানুষ, তাকে হয়তো ছেড়ে দেবে কিন্তু জহুরার সঙ্গে যদি খারাপ কিছু ঘটে, সেই দুশ্চিন্তায় বাইরে বের হওয়ার সাহস করছে না।

হনুফা বেগমের ঠোঁট কাঁপছে। তোতলাতে তোতলাতে বলল, কেউ নাই!

অফিসার চেঁচিয়ে রাইফেল তাক করল হনুফা বেগমের দিকে, ঝুট! সাচ বাতা। আগার নেহি বাতায়া তো গুল্লি মারদুঙ্গা!

হনুফা বেগম ভয়ে শিউরে উঠল। দুহাত উঁচু করে বলল, ওরে বাবারে! আমারে মাইরেন না!

কেরামত আলী বলল, কাইল রাইতে এক মুক্তিযোদ্ধা গুলি খাইয়া এদিকেই ঢুকছিল, আমার লোকে দেখছে। তুমি যদি না কও তো বিপদে পড়বা।

হনুফা বেগম জহুরাকে রাতে খাবার নিতে দেখে সন্দেহ হয়েছিল তাই রাতের আঁধারে পা টিপে টিপে এসে জহুরার ঘরে কান পেতেছিল। ভেতরে জহুরার সঙ্গে অন্য আরেক পুরুষের কণ্ঠও শুনতে পেয়েছিল। কিন্তু ওরা এত ফিসফিস করে কথা বলছিল যে বাইরে থেকে কী বলছে কিছুই সে বুঝতে পারেনি। রাতে জহুরা শাশুড়ির মুখের ওপর অত বড় কথা বলেছে তার ছেলেকে নিয়ে। প্রতিশোধের আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছিল হনুফা বেগমের অন্তরে। এখনই সুযোগ জহুরাকে একটা উচিত শিক্ষা দেওয়ার।

হনুফা বেগম হাতের আঙুলের ইশারায় জহুরার ঘরটিকে দেখিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে অফিসারসহ মিলিটারির দল জহুরার ঘরটিকে ঘিরে ফেলল। অফিসার ধীরে ধীরে জহুরার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দরজায় কয়েকবার ধাক্কা দিল।

—আন্দার কই হ্যায়?

জহুরা বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। মায়ের সমতুল্য শাশুড়ি এটা কী করল। হয়তো জহুরা নিঃসন্তান, তাই তিনি তাকে দুচোখে দেখতে পারতেন না। তাই বলে এভাবে জহুরাকে ফাঁসিয়ে দেবে? রাতে জয়নালকে নিয়ে অমন কথা বলায় এমন প্রতিশোধ নেবে?

জহুরা দরজা খুলছে না বলে অফিসার আনোয়ার বুট দিয়ে জোরে জোরে দরজায় লাথি দিতে লাগল। জহুরা ভয়ে ভয়ে দরজা খুলল।

অফিসার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জহুরার দিকে তাকাল। জহুরার লম্বা ঘোমটার আড়ালে ওর মুখটা দেখা যাচ্ছে না।

অফিসার ঘরের ভেতরে কেউ আছে কি না জিজ্ঞেস করল। জহুরা না-সূচক মাথা নাড়ল। অফিসার আনোয়ার তার সঙ্গের এক সৈন্যকে ভেতরে তল্লাশি চালাতে বলল। ভেতরে তল্লাশি শেষে সেই সৈন্য এসে জানাল কেউ নেই। কিন্তু রক্তমাখা সেই গামছা হাতে করে নিয়ে এল।

গামছাটা হাতে পেয়ে অফিসারের মাথায় রক্ত উঠে গেল। জহুরাকে গামছাটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, ইয়ে খুন কাহাছে আয়া? কিসকা খুন?

জহুরা চুপ করে মাথা নিচু করে রইল।

ওপাশ থেকে হনুফা বেগম শকুনের দৃষ্টি নিয়ে জহুরার দিকে তাকিয়ে আছে আর মনে মনে বলছে, পরপুরুষরে ঘরে ঢুকায় পিরিত করার মজা এবার বুঝো।

জহুরাকে দেখে অফিসার আনোয়ার রাইফেল দিয়ে এক ঝটকায় জহুরার ঘোমটা খুলে ফেলল। মুহূর্তেই ঘোমটার আড়ালে আচ্ছাদিত জহুরার মুখখানা ভেসে উঠল নরপিশাচের সামনে। জহুরার দিঘল কেশের খোঁপাটা খুলে গিয়ে আছড়ে পড়ল কোমরে। অদ্ভুত সুন্দর টানা টানা চোখ দুটো ভয়ে শিউরে উঠল। জহুরার সর্বাঙ্গে রূপের ছটায় অফিসারের পাগল হওয়ার উপক্রম। ক্ষুধার্ত বাঘের মতো জহুরার দিকে একপলক তাকিয়ে রইল। আরও একবার জিজ্ঞেস করল, কাল রাত কই আয়া থা?

জহুরা মাথা নাড়ে।

ক্যাপ্টেন এবার পেছনের দিকে তাকায়। জহুরার শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করে, ইয়ে লাড়কি কন হ্যা?

কেরামত মিয়া বলে ওঠে, ইনকা বেটেকা পত্নী।

অফিসার মুচকি হাসি দিয়ে বলে ওঠে, বহুত সুন্দর হ্যা। মুঝে ইসকো চাহিয়ে। আর কোনো কথা বলল না। এক ঝটকায় জহুরাকে নিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল। নির্বাক দর্শকের মতো তাকিয়ে রইল হনুফা বেগম। এতখানি আশা করেনি। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীদের বন্দুকের নিশানা স্তব্ধ করে দিয়েছে তার বিবেককে। ওঘর থেকে কেবল জহুরার আর্তচিৎকার ভেসে আসছিল। নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে যুদ্ধের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হলো জহুরাকে। নরপিশাচ তার ক্ষুধা মিটিয়ে বের হয়ে এল।

কেরামত মিয়া কিছু না বোঝার ভান করে বলল, এইখানে থাইক্কা আর লাভ নাই। চলেন অন্য কোথাও গিয়া মুক্তিগুলানরে খুঁজি।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা একে একে এক চিলতে উঠানকে শোকের পৃথিবী বানিয়ে বিদায় নিল। শূন্য ঘরে সর্বস্ব হারিয়ে পড়ে রইল জহুরার নিথর আত্মাটা। হনুফা বেগম ঠায় দাঁড়িয়ে রইল তপ্ত উঠোনে। জহুরার মুখোমুখি হওয়ার সাহস এখন তার নেই।

এভাবে কিছুক্ষণ কেটে গেল দুই প্রান্তের দুই নীরব নারী মূর্তির। হঠাৎ জয়নালের চিৎকার শোনা গেল। বাবার মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে ফিরেছে সে। স্বামীর মৃতদেহ দেখে হনুফা বেগমের গগনবিদারী চিৎকারে আকাশ ভারী হয়ে উঠল। জয়নাল মাকে জানাল, গত রাতে মিলিটারির ভয়ে সে বাড়ি আসার সাহস করেনি। জয়নালের বয়সের ছেলেদের দেখলেই গুলি চালাচ্ছে। রহমত মিয়া ছেলেকে খুঁজতে গিয়ে গোলাগুলির মাঝে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।

জয়নাল চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, মা, আমি আমার বাজানরে বাঁচাইতে পারলাম না!

নিজের সতীত্ব হারিয়ে জহুরা পাথরের মূর্তির মতো তার ঘরে পড়ে আছে। বাইরে কী হচ্ছে, কিছুই সে টের পায়নি।

হনুফা বেগম জহুরার সঙ্গে মারাত্মক অন্যায় করেছে। নিজের দোষ ঢাকার জন্য সে এবার জহুরাকে গালমন্দ করা শুরু করল।

—জয়নালরে সব দোষ তোর ওই অপয়া বউয়ের। এই অলক্ষ্মীরে রাখছি বইলাই আইজ তোর বাপটারে হারাইছস। ও যদি কাইল সক্কালবেলা ঝামেলাডা না বাধাইতো, তাইলে আইজ আমি বিধবা হইতাম না।

জয়নাল রক্তচক্ষু নিয়ে চারদিকে জহুরাকে খুঁজতে লাগল।

—মা, নবাবের বেটি কই?

হনুফা বেগম চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলল, বাজানরে, তোর বউ আর সতী নাইরে বাপ। দুশ্চরিত্রা মেয়েছেলে কাইল রাইতে এক বেডা নিয়া ওই ঘরে থাকছে আর আইজ মিলিটারি আইসা ওর বাকি ইজ্জতটাও কাইরা নিছে।

জয়নাল এক দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেল। বিধ্বস্ত জহুরাকে দেখে প্রথমে আঁতকে উঠল। এরপর এক ঝটকায় জহুরার চুলের মুঠি ধরে টেনেহিঁচড়ে উঠানে এনে ফেলল। যাচ্ছেতাই গালমন্দ করা শুরু করল। শ্বশুরের লাশ দেখে যখন আর্তনাদ করে কাছে যেতে চাইল, তখন হনুফা বেগম আর জয়নাল মিলে জহুরাকে বন্ধ্যা আর নষ্টা মেয়ে বলে অপমান করে বিদায় করে দিল। জয়নালকে সন্তানের পিতা হতে অক্ষম বলার শাস্তি মাথায় নিয়ে জহুরা নয় বছরের সংসার ত্যাগ করল।

যুদ্ধ শেষ। ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে ক্ষতবিক্ষত বাংলাদেশের আবারও জেগে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা। প্রিয়জন হারানোর ব্যথা বুকে নিয়ে আবারও নতুন স্বপ্ন বুকে নিয়ে মানুষের পদচারণ শুরু হয়েছে।

দুই.

আজ হনুফা বেগমের মনে ভীষণ আনন্দ। পুরোটা বাড়ি রঙিন কাগজে সাজানো হয়েছে। আজ জয়নালের বিয়ে। বিবাহিত জীবনের দীর্ঘ নয় বছর সন্তানের জন্য প্রতীক্ষার অবসান হবে, সেটা ভেবে জয়নালও ভীষণ রোমাঞ্চিত। জহুরাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর গেল কয়েক মাস আর কেউ জহুরার খোঁজ করেনি। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জহুরা সবুজদের গ্রামে গিয়ে ওর মায়ের সঙ্গে দেখা করে। অসহায় জহুরার আশ্রয় মেলে সবুজের মায়ের ছোট্ট ঘরে। যুদ্ধের বাকি সময়টায় জহুরা সবুজের মায়ের সঙ্গেই ছিল। সবুজ যুদ্ধ থেকে আর ফেরেনি। স্বাধীন দেশের পতাকা আনবে বলে মায়ের কাছে যে কথা দিয়েছিল, সে কথা সবুজ রেখেছে, কিন্তু মায়ের কোলে ফেরা হয়নি।

এত দিন রাগে-ক্ষোভে জহুরা স্বামীর সঙ্গে দেখা করবার প্রয়োজন বোধ করেনি। কিন্তু আজ যখন শুনল জয়নালের বিয়ে, তখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। গ্রামের এক বাউলের কাছ থেকে সব সময় জহুরা স্বামী আর শাশুড়ির খোঁজ নিত।

—মা, আপনে এইখানে খাড়ান, আমি ভেতরে যাই।

—এই শরীর নিয়া একলা যাইবা? পারবা?

—পারব মা! চিন্তা কইরেন না।

সবুজের মাকে জহুরা মা বলে ডাকে। জয়নালের সঙ্গে দেখা করতে জহুরা সবুজের মাকে সঙ্গে নিয়ে ওদের বাড়িতে এসেছে।

বরযাত্রী সবে রওনা দেবে। এমন সময় অন্তঃসত্ত্বা জহুরাকে দেখে সবাই থমকে দাঁড়াল। হনুফা বেগম আর জয়নালের চোখ কপালে। যে নারীকে এত দিন তারা বন্ধ্যা ভাবত, সে গর্ভবতী!

হনুফা বেগম অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, জহুরা? তুমি বাইচ্চা আছ? তুমি পোয়াতি?

জয়নাল বিস্ফোরিত চোখে গর্ভবতী জহুরার দিকে তাকিয়ে আছে। নয় বছর জহুরার গর্ভে কোনো সন্তান আসে নাই আর এখন কিনা।

সবাই কানাঘুষা করা শুরু করে দিল। জহুরা কি আবার বিয়ে করেছে? জয়নালের সঙ্গে তো ওর তালাক হয়নি। তাহলে পেটে বাচ্চা এল কী করে?

হনুফা বেগম জহুরার সামনে এসে দাঁড়াল। আজ ছেলের বিয়ে আর এমন সময় জহুরা পথ রুদ্ধ করে এসে দাঁড়িয়েছে। নির্ঘাত বিয়ে ভেঙে আবার জয়নালের সংসারে আসার উদ্দেশ্য।

হনুফা বেগম রক্তলাল চোখে জহুরাকে জিজ্ঞেস করল, ক্যান আইছস এইখানে? তোর পেটে কার বাচ্চা? কার পাপ পেটে লইয়া আমার পোলার বিয়াডা ভাঙতে আইছস? তুই তো একটা দুশ্চরিত্রা। তোরে তো হেই দিন ওই মিলিটারি বেডা নষ্ট করছিল। হের বীজ লইয়া লজ্জা করল না এতগুলান মানুষের সামনে দাঁড়াইতে?

জহুরা এবার চিৎকার করে উঠল। থামেন! বিয়ার পর যখন মা হইতে পারি নাই, তখন অলক্ষ্মী, অপয়া, বন্ধ্যা বইলা অপমান করতেন, আর এখন যখন আমার গর্ভে সন্তান আইছে, তখন কন দুশ্চরিত্রা? মা, আমি দুশ্চরিত্রা? আমারে মিলিটারি নষ্ট করছে? ভুইল্লা গেছেন সেই দিনের কথা? আমি আপনের পোলারে পিতা হইতে অক্ষম কইছিলাম বইলা প্রতিশোধ নিতে আপনে সেই নরপশুরে আমার দিকে ঠেইলা দিছিলেন? ক্যামনে পারছেন একটা মাইয়া মানুষ হইয়া নিজের পোলার বউরে অন্য বেডারে দিয়া নষ্ট করাইতে?

জয়নাল জহুরাকে ধমকে উঠল, চুপ কর জহুরা! মায়েরে আর একটাও ওলট-পালট কথা বলবি না। তোর কত্ত বড় সাহস, তুই আমারে অক্ষম কস? ইজ্জত হারায় পোয়াতি হইছস?

—হ, আমি ইজ্জত হারায় পোয়াতি হইছি। ইজ্জত না হারাইলে তো জানতামই না আমি বন্ধ্যা না! কত কষ্ট দিছো তোমরা সবাই মিল্লা আমারে। কত অপমান করছ। বিয়ার নয়টা বছর আমি একটা সন্তানের মুখ দেখবার জন্য ছটফট করছি। আমার পেটের সন্তান তো নিষ্পাপ। ওর তো কোনো দোষ আছিল না।

জহুরা এবার হনুফা বেগমের চোখে চোখ রেখে বলল, আপনের পোলারে বিয়া করাইবেন? আপনের পোলার আসলেই বাপ হওনের ক্ষমতা নাই। মা হইতে না পারলে ক্যান শুধু মাইয়াগো গালি শুনতে হইব? পোলারে আরও দশটা বিয়া করান না ক্যান, সন্তানের মুখ কোনো দিনও দেখব না।

জয়নাল চিৎকার করে এসে জহুরার সামনে এসে দাঁড়াল। তুই সীমা ছাড়ায় গেছস জহুরা। তুই আমারে কস সন্তান হইব না? তোর এত্ত বড় সাহস? পেটে পাপ লইয়া আইসা গর্ব করস? তোর এই গর্ব আমি ছুটাইতাছি।

জয়নাল এক ঝটকায় জহুরাকে টেনে বাড়ির বাইরে নিয়ে গেল। কষে জহুরার গালে এক চড় বসিয়ে দিল। সবুজের মা জয়নালকে অনুরোধ করল ওকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু জয়নাল আক্রোশে জহুরাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে মাঠে ফেলে দিয়ে চলে গেল। জহুরার পেটে প্রচণ্ড আঘাত লাগল। সবুজের মা ছুটে এসে জহুরার কাছে বসল। প্রসবের তীব্র যন্ত্রণায় জহুরা ছটফট করতে লাগল। সবুজের মা একটু সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে লাগল কিন্তু কেউ এল না। অবশেষে সবুজের মা জহুরার গর্ভ থেকে তার সন্তানটিকে পৃথিবীর আলো দেখতে সাহায্য করল।

সবুজ মাঠটা রক্তে লাল হয়ে আছে। জহুরার কোলে ছোট্ট ফুটফুটে এক পুত্রসন্তান। সন্তানকে বুকে নিয়ে জহুরা কাঁদছে! এক মুহূর্তের জন্যও জহুরার মনে সন্তানের প্রতি কোনো ঘৃণার সঞ্চার হয়নি। মা না হওয়ার তীব্র যন্ত্রণা থেকে আজ সে মুক্তি পেয়েছে।

সবুজের মায়ের দিকে তাকিয়ে জহুরা বলল, মা, ভাই আমারে কইছিল, দেশ স্বাধীন কইরা লাল-সবুজের পতাকা লইয়া আইব। ভাই তো আর ফিরে নাই। এই লন আপনের পতাকা। আমার পোলাডার নাম দিলাম পতাকা। লাল-সবুজের পতাকা।

জহুরার জ্বলজ্বলে দুটো চোখ আত্মবিশ্বাসে ভরে উঠল।

আমি বীরাঙ্গনা জহুরা। দেশের জন্য সম্ভ্রম হারাইছি। এক মুক্তিযোদ্ধারে আশ্রয় দিছি। যত দিন বাঁইচ্চা থাকমু, তত দিন গর্বের সাথে আমার পতাকা লইয়া মাথা উঁচু কইরা ওরে মানুষ করুম। আমার পতাকা আমার গর্ব, আমার মাতৃত্বের অহংকার!
...

শাহীন আক্তার স্বাতী: কানাগাওয়া কেন, জাপান।