নদীর জীবন

বো বোয়িং ক্রিক
বো বোয়িং ক্রিক

সারা দিন সংসারের কাজকর্ম শেষ করে বিকেলে পরিজান বিবি একটু অবসর পান। তখনই নাতি দুটোকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। অবশ্য অন্য সময়ে ব্যস্ত থাকলেও ঠিকই নাতিদের খোঁজ রাখেন। ছেলের স্ত্রীরা তাদের ঠিকমতো খাওয়াচ্ছে কিনা, তারা কোথায় খেলাধুলা করছে কোনো কিছুই তাঁর নজর এড়ায় না। ভাদ্র মাসের পরপরই যখন পদ্মার পানিতে টান পড়েছে তখনই শুরু হয়েছে ভয়াবহ নদীর ভাঙন। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে যে জায়গা দেখে সবাই ঘুমাতে যায় তার বেশির ভাগই সকালবেলা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রতিদিনই বিভিন্ন খেত থেকে পাকা ও আধা পাকা ফসল তুলে এনে বাড়ির উঠোনে স্তূপ করা হচ্ছে। বেশির ভাগই বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। আসলে হাটে নিয়ে বিক্রি করতে পারার মতো সময় নেই কারও হাতে। সবাই নিজেদের বাড়িঘর নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

বো বোয়িং ক্রিক
বো বোয়িং ক্রিক

পরিজান বিবিও তাঁর বড় ছেলেকে নিয়ে গিয়ে একটা জায়গা ঠিক করে এসেছেন। বাড়িঘর একটা একটা করে সরিয়ে নিতে হবে। একটা করে ঘর উঠবে নতুন জায়গায় আর একে একে বাড়ির মানুষজন সরে যাবে। পরিজান বিবির মনটা খারাপ হচ্ছে অনেক। যদিও তিনি এক জীবনে নদীভাঙন বহুবার দেখেছেন। কারণ, চর এলাকায় প্রতিবছর ভাদ্র মাসের পরপরই ভাঙন শুরু হয়। বড় ঘরটা ইতিমধ্যেই নতুন জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পরিজান বিবি তাঁর বড় ছেলের স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে গোছগাছ শুরু করবেন। তারপর পুরুষ মানুষেরা একে একে সেখানে যাবে। প্রতিদিনই তিনি নদীর ভাঙন দেখতে আসেন। কিন্তু সেদিনের পর আর এই নদীর পাড় দেখতে পাবেন না ভেবেই মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ছোট নাতিটার বয়স এক বছর। সে কোলের মধ্যে বসে আছে। আর বড়টার বয়স চার বছর। সে তাঁর শাড়ির আঁচল ধরে পিছে পিছে হাঁটছে আর হাজারো প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে। বড় নাতিটা হয়েছে পরিজান বিবির নেওটা। না হয়েই বা যাবে কোথায়। বড় বউমা এত বড় একটা সংসারের সব কাজ এক হাতে সামলাতে গিয়ে ছেলে দুটোর দিকে আর নজর দিতে পারে না।

বো বোয়িং ক্রিকের সেতু দিয়ে চলছে ট্রেন
বো বোয়িং ক্রিকের সেতু দিয়ে চলছে ট্রেন

নতুন বাড়িতে থিতু হওয়ার পর পরিজান বিবির মাথায় নতুন ভাবনা শুরু হলো। তিনি তাঁর এই জীবনে একাধিকবার নদীভাঙন দেখেছেন। প্রতিবারই তল্পিতল্পা গুটিয়ে আবারও নতুন করে জীবন শুরু করতে হয়। তাই একটা স্থায়ী আবাসের ব্যবস্থা করা দরকার। যাতে করে ভবিষ্যতে নাতি–নাতনিরা একটা মাথা গোঁজার ঠায় পায়। তিনি ভাবনাটা তাঁর বাবা আব্বাস আলী মণ্ডলের সঙ্গেও শেয়ার করলেন। তাঁর বাবাও বললেন, ঠিকই তো এভাবে আর কতবার নদীভাঙনের কবলে পড়ে নতুন করে জীবন শুরু করা যাবে। আর নদী যেভাবে দিনে দিনে ভাঙতে শুরু করেছে একসময় বর্তমানের আবাসস্থলও হয়তো নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।

এ কাহিনি পদ্মা নদীসংলগ্ন এলাকার। একসময় পদ্মা নদী এমনটা ছিল। সারা বছরই অনেক খরস্রোতে নদীতে পানি প্রবাহিত হতো। তাই নদীর পাড় ভাঙার প্রকোপ কম ছিল। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধ দেওয়ার পর থেকে নদীর পানিপ্রবাহ দিনে দিনে কমে আসছে। গ্রীষ্মকালে তো পানির প্রবাহ থাকে না বললেই চলে। এর ফলে নদীর তলদেশ প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। বর্ষাকালে যখন ফারাক্কা বাঁধ খুলে দেওয়া হয় তখন দেখা দেয় বড় বন্যা। একে দেশেই অনেক বৃষ্টিপাত হয়, তা নদীতে গিয়ে পড়ে। অন্যদিকে উজানের পানি এসে প্রবাহ বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু নাব্যতা কমে যাওয়ায় দুই পাড় প্লাবিত করে পানি স্থলভাগের দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করে। টানা প্রায় কয়েক মাস চর এলাকাগুলো প্লাবিত হয়ে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। তখন বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের প্রকোপে অনেক মানুষ অকালে প্রাণ হারায়। আর যোগাযোগটাও অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। একমাত্র নদীপথেই তখন বিভিন্ন স্থানে যাওয়া যায়। কিন্তু নৌকা ডুবে দুর্ঘটনার সুযোগ থেকে যায়।

বো বোয়িং ক্রিকের পানিতে লেখকের ছেলে
বো বোয়িং ক্রিকের পানিতে লেখকের ছেলে

যা হোক, চিন্তাভাবনা করতে করতেই পরিজান বিবির মনে পড়ে তাঁর দেবরের কথা। তারা থাকে কুষ্টিয়া শহরের। অবশেষে দেবরের সঙ্গে যোগাযোগ করে শহরতলির বারাদীতে সামান্য পরিমাণ জমিও কিনে ফেললেন। জমি কেনার পর সেখানে কে থাকতে যাবে, সেটা নিয়ে দেখা দিল বিভ্রান্তি। তাঁর মেজো ছেলে ও ছোট ছেলের তখনো বিয়ে হয়নি। তাই বড় ছেলে আশরাফ আলী ও তাঁর স্ত্রী হাসিনা খাতুন এবং তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। অবশেষে একদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে একটা নৌকায় করে তাঁরা রওনা দিলেন।

সেই সময়টাও ছিল বর্ষাকাল। তখন নদীতে পানি বেশি থাকে। নৌকা চালাতে সুবিধা হয়। না হলে বারবার নদীর ডুবোচরে নৌকা আটকে যায়। নৌকাটার আকার বেশ বড়। পালের নৌকা। তখন পর্যন্ত ইঞ্জিনের নৌকার চল তেমন শুরু হয়নি। নৌকাতে একটা চার চালা ছনের ঘরের জন্য প্রয়োজনীয় সব সাজসরঞ্জাম আর বাড়ির পোষা কুকুর। নৌকার মাঝির সঙ্গে আরও দুজন লোক নিয়ে নিয়েছে। যখন বাতাস থাকবে না বা স্রোতের বিপরীতে যেতে হবে তখন যেন তারা দাঁড় টেনে নৌকাটাকে নিয়ে যেতে পারে। পদ্মা নদী পার হতে তেমন সমস্যা হলো না। সমস্যা শুরু হলো পদ্মা নদী থেকে এর শাখা নদী গড়াইয়ে ঢোকার মুখে। বেশ কিছুটা উজানে দাঁড় বেয়ে যেতে হয়। রাজশাহীর দিক থেকে পদ্মা নদী এসে ভেড়ামারার তালবাড়িয়ার কাছে একটা শাখা গড়াই নামে কুষ্টিয়া শহরের কোল ঘেঁষে দক্ষিণে বয়ে গেছে। কুষ্টিয়া শহরের সঙ্গে গড়াই নদীর সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

দাঁড়িরা দাঁড় বেয়ে গড়াই নদীর মুখের কাছে নৌকাটা নিয়ে আসতেই আশরাফ আলী বুঝে ফেললেন মাঝি নৌকার গতিনিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। কারণ, নদীর পানিপ্রবাহ ওখানে ভাগ হয়ে যাওয়ার সময় বিশাল এক ঘূর্ণি তৈরি করেছে। নৌকার হালটা ঠিকমতো ধরতে না জানলে যেকোনো মুহূর্তে নৌকা উল্টে যেতে পারে। তাই তিনি মাঝির সঙ্গে মিলে শক্ত করে হাল ধরে রাখলেন। আর সবাই একসঙ্গে আল্লাহ–রাসুলের নাম নেওয়া শুরু করল। আশরাফ আলীর স্ত্রী হাসিনা খাতুন দুই ছেলেকে নিজের বুকের সঙ্গে এমনভাবে চেপে ধরলেন যাতে করে তারা যেন নদীর প্রলয়ংকরী মূর্তি দেখতে না পারে। মেজো ছেলেটাকে আগলে রাখা সম্ভব হলেও বড়টাকে ঠিক নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছিল না। সে বারবার উঁকি দিয়ে দেখছিল তার বাবা কী করছে। এভাবে একসময় নৌকাটা গড়াই নদীতে এসে পড়ল।

গড়াই নদীতে আসার পর কাজটা সহজ। নৌকাটা নদীর স্রোতের টানেই ভাটিতে এগিয়ে চলল। এই ফাঁকে আশরাফ আলী মাঝি ও দাঁড়িদের খেয়ে নিতে বললেন। কারণ, নৌকা ঘাটে পৌঁছার পর আবার মালপত্র নামিয়ে ভ্যানে করে বা গরুর গাড়িতে করে নতুন জায়গা পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। অবশেষে সন্ধ্যাবেলায় কুষ্টিয়ার রেনুউইক ঘাটে এসে নৌকা ভিড়ল।

তারপর শুরু হলো আশরাফ আলীর বারাদীতে জীবনযাপন। শহরে কাজের সন্ধান করতে গিয়ে তাঁর দিশেহারা অবস্থা। তিনি সারা জীবন হালচাষের সঙ্গেই জড়িত ছিলেন। অন্য কাজ পারেন না। আর কয়েকবার তিনি ব্যবসার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ক্ষতি ছাড়া লাভের মুখ দেখেননি। এ অবস্থায় একদিন সকালবেলা বারাদীর বাড়িতে তালা লাগিয়ে তিনি তাঁর পুরো পরিবার নিয়ে চর ভবানীপুর রওনা হলেন। এরপর পাঁচ বছর তাঁরা সেখানেই থাকলেন। যত দিন পর্যন্ত না বড় ছেলেটা পঞ্চম শ্রেণি পাস করে। তাঁর পরিকল্পনা ছিল ছেলে মাধ্যমিকে ভর্তির আগে আবার বারাদীতে ফিরে আসবেন।

১৯৮৮ সালে বন্যা শুরু হয়েছে। নদীর পানি প্রথমে নিচু জায়গাগুলো দিয়ে ঢুকে তারপর ধীরে ধীরে সমস্ত স্থলভাগ গ্রাস করে নিয়েছে। বেশির ভাগ মানুষেরই বাড়িঘর ডুবে গেল। তখন তারা নৌকায় বা কলার ভেলায় চড়ে ভাসমান অবস্থায় দিনাতিপাত করা শুরু করল। মাঝেমধ্যে ইঞ্জিনের নৌকাতে করে ত্রাণ আসে। কিন্তু সেগুলো প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। মানুষ একে অপরের সঙ্গে খাবার ভাগাভাগি করে কোনোমতে একবেলা আধবেলা খেয়ে দিন পার করছে। সবচেয়ে সংকট দেখা দিয়েছে খাওয়ার পানির। যাদের নলকূপটা একটু উঁচু জায়গায় বসানো তাদের বাড়িতে সবাই ধরনা দিচ্ছে পানির জন্য। চরভবানীপুরে পরিজান বিবির বাড়িটা মোটামুটি উঁচু জায়গায়। পানি উঠেছে কিন্তু একেবারে ভেসে যায়নি। গরু–ছাগলগুলোকে রাস্তার ওপর রাখা হয়েছে। অবশ্য বালুর রাস্তাও বেশির ভাগই পানির স্রোতে ভেসে গেছে। রাস্তার সামান্য কিছু কিছু জায়গা জেগে আছে। সেখানেই সবাই ভাগাভাগি করে গরু–ছাগল বেঁধে রেখেছে। এভাবে কত দিন চলেছিল তার হিসাব কেউ রাখেনি। তারপর একসময় পানি নেমে যায়। আবারও শুরু হয়ে যায় মানুষের স্বাভাবিক জীবনযুদ্ধের প্রস্তুতি।

বো বোয়িং ক্রিকের পাড়ে মাঠে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে লেখকের ছেলেমেয়ে
বো বোয়িং ক্রিকের পাড়ে মাঠে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে লেখকের ছেলেমেয়ে

এর ঠিক ৩০ বছর পর পরিজান বিবির নাতি ইয়াকুব মানে আমি এখন অস্ট্রেলিয়ার সিডনির উপকণ্ঠে মিন্টোতে বসবাস করি। প্রথম দিকে অস্ট্রেলিয়ার কোনো সৌন্দর্যই আমাকে টানত না সেভাবে। একটা নদী খুঁজে ফিরতাম। যার কাছে গিয়ে সকাল–বিকেল দাঁড়াতে পারব আর মনে মনে সব কথা বলতে পারব। যে নদী আমার সব কথা বোঝে। আমার শৈশবের দিনগুলোতে পদ্মার প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। তাই নদীর প্রতি আমার এই দুর্বলতা। পরে মিন্টো স্টেশনের অদূরেই একটা নদী খুঁজে বের করি আমি আর আমার আট বছরের মেয়ে তাহিয়া। অবশ্য এটাকে অস্ট্রেলিয়ায় বলে ক্রিক। বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাশনের জন্য এগুলো বানানো হয়েছে। এর তলাটা কংক্রিট দিয়ে বাঁধানো। যাতে করে প্রবল স্রোতেও নদীর তলদেশ ক্ষয় হয়ে যায় না। আমি মেয়ে তাহিয়া ও ছেলে রায়ানকে নিয়ে সময়ে অসময়ে ওই নদীর পাড়ে যাই। সপ্তাহান্তে একবার তো যেতেই হবে। আর বৃষ্টি হলে সাপ্তাহিক কর্মদিবসগুলোও বাদ পড়ে না। কারণ, তখন ক্রিকটা আসলে নদীর চেহারা পায়। গর্জন করে খরস্রোতে পানি প্রবাহিত হতে থাকে। পানির স্রোত আর ঢেউ দেখলেই মনটা শান্ত হয়ে যায়। আমার ছেলেমেয়ে দুজনেরও এই জায়গাটা অনেক পছন্দের। তারা এসেই নদীর পানিতে লাফিয়ে পড়ে। তখন তাদের নিরস্ত্র করতে আমার যথেষ্ট বেগ পেতে হয়।

এটার নাম বো বোয়িং ক্রিক। আমার কাছে নদীর মতোই মনে হয়। জানি না এর উৎস কোথায় আর শেষই বা হয়েছে কোথায় গিয়ে। কিন্তু তার সর্পিল গতিপথটা আমাকে বারবার পদ্মা আর গড়াই নদীর কাছে নিয়ে যায়। ইতিমধ্যে এই নদীতীরেই আমার প্রায় চার বছর সময় কেটে গেছে। প্রথম যখন এই নদীর পাড়ে আসতাম তখন শুধু তাহিয়া সঙ্গে আসত। এখন রায়ানও পিছু নেয়। এই নদীকে ঘিরেই তাহিয়া ও রায়ানের বয়স বেড়ে চলেছে। তাহিয়া কখনো কখনো কাগজের নৌকা বানিয়ে এখানে এনে ছেড়ে দেয়। আবার কখনো নদীর পানিতে পা ভিজিয়ে হাঁটে। রায়ান আরও এক ডিগ্রি ওপরে। সে এখানে এসেই নদীর পাড়ে বসে পড়ে। তারপর আশপাশে তাকিয়ে ঠিক পানির মধ্যে নেমে পড়ে ভাটির দিকে শুরু করে দৌড়। তখন তাকে থামানোই মুশকিল হয়ে যায়। একবার সে তার পায়ের জুতা খুলে পানিতে ছেড়ে দিয়েছে। আমি কিছুক্ষণের জন্য তার দিক থেকে মনযোগ সরিয়েছিলাম। এর মধ্যেই সে এই কাণ্ড ঘটিয়েছে।

বো বোয়িং ক্রিকের ওপর আছে দুটো সেতু। একটা দিয়ে একটু পর পর দুই দিক থেকেই ট্রেন চলাচল করে আর অন্যটা পরিত্যক্ত। আমার ছেলেমেয়ে দুজনই সেই পরিত্যক্ত সেতুর ওপর উঠে এ মাথা থেকে ও মাথায় চলে যায়। আর শুকনার সময়তো তো ক্রিকের মধ্যেকার কংক্রিটের পাটাতনের ওপর দিয়েই পার হয়ে যাওয়া যায়। ক্রিকের দুই পাড়েই বিশাল দুটো মাঠ। রায়ান আর তাহিয়া মাঝেমধ্যেই বল নিয়ে এসে সেখানে খেলা করে। একবার প্রতিবেশী ফাহিমারাও ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। অন্য একবার রুপা বৌদি, ওনার মেয়ে এলভিরা ও ছেলে রেনোরও ওদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ঘুড়ি উড়িয়েছিল।

নদী যেমন উৎস থেকে শুরু করে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে একসময় মোহনায় গিয়ে মেলে। ঠিক তেমনি আমার জীবনও সেই চরভবানীপুরে শুরু হয়ে জীবনের নানা ঘাট পার করে আজ সিডনি এসে থিতু হয়েছে। কিন্তু আমার মনের মধ্যে বয়ে চলেছে একটা নদী নিরবধি। আমি আমার জীবনকে নদীর জীবনের সঙ্গে তুলনা করি। সিডনির সব চাকচিক্যময় আয়োজনের মধ্যেও তাই খুঁজে বের করেছি বো বোয়িং ক্রিককে। যেটা এখন আমার আর ছেলেমেয়ের সকাল–বিকেলের সঙ্গী। যখন আমি বো বোয়িং ক্রিকের পাড়ে মেয়ে তাহিয়া আর রায়ানকে নিয়ে হাঁটি তখন শৈশবের সবচেয়ে পুরোনো স্মৃতিটা আমার মনের কোণে ভিড় করে। মনে হয় দাদি পরিজান বিবি আমাকে ও আমার মেজো ভাইটাকে নিয়ে পদ্মা নদীর পাড়ে হেঁটে বেড়াচ্ছেন আর নদীর ভাঙন দেখাচ্ছেন। পরিজান বিবি আজ আর এই পৃথিবীতে নেই। কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর স্মৃতি। আর তাঁর স্মৃতিবিজড়িত পদ্মা নদী। হয়তো বা আমিও একসময় এই পৃথিবীতে থাকব না। কিন্তু আমার স্মৃতি আর স্মৃতিবিজড়িত বো বোয়িং ক্রিক রয়ে যাবে তাহিয়া আর রায়ানের মনে।

...

লেখকের ই–মেইল: <[email protected]>