নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সংস্কৃতি

অনেক দিন পর আমার সাড়ে তিন বছর বয়সী শিশুকন্যা লামিহাকে নিয়ে সপরিবারে সুইমিং পুলে গিয়েছিলাম। লামিহা মনের আনন্দে পুলে শিশুদের জন্য নির্ধারিত স্থানে জলকেলি করে বেড়াচ্ছে, সেই সঙ্গে চলছে স্লাইডিং। আমরা মা-বাবা দুজনই পুলের পাশে বেঞ্চে বসে। ওদিকে মেয়ে স্লাইডিং করছে আর বলছে, মা দেখো! খুশিতে সে আত্মহারা।

বেঞ্চে বসে বসে আমরা বিশ্রাম ও মেয়েকে সুইমিংয়ে উৎসাহ জোগানো, দুইই করে যাচ্ছি। অলস সপ্তাহান্তের দিনটি বেশ ভালোই যাচ্ছিল। হঠাৎ পাশের ল্যাপ পুলে চোখ পড়তেই ভড়কে গেলাম! এক লোক মাথা নিচু করে পানিতে ডুবে যাচ্ছে। কিছু বোঝার আগেই মুহূর্তে এক লাইফগার্ড ঝাঁপিয়ে পড়লেন পুলের পানিতে। দ্রুতগতিতে সাঁতরে চলে গেলেন ডুবন্ত লোকটির কাছে। আর বেশ কায়দা করে পাড়ে নিয়ে এলেন তাকে।

অন্যদিকে, আরেক গার্ড স্ট্রেচার নিয়ে পাড়ের পাশে পানিতে অপেক্ষা করছেন। ডুবন্ত লোকটি পাড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে এলেন। আর অমনি লোকটিও উঠে দাঁড়াল হাসিমুখে! আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ভয় আর উত্তেজনায় আমার শ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়! সময়টাও স্থির হয়ে গিয়েছিল ডুবতে যাওয়া ওই ভদ্রলোককে দেখে। এখন তার হাসিমুখ দেখে বিস্ময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বস্তি ও সংবিৎ ফিরে পেলাম!

সপরিবারে লেখক
সপরিবারে লেখক

কিছু সময় পরেই আমার ভুল ভাঙল। হ্যাঁ, একটু আগে ঘটে যাওয়া বিস্ময় নিয়ে যা দেখছিলাম, তা ছিল ‘সিমুলেশন’। নিরাপত্তা ও সুরক্ষা বিজ্ঞানে যাকে বলে সেফটি ড্রিল। বাস্তব দুর্ঘটনায় আমরা স্বভাবজাতভাবেই বিশৃঙ্খল ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি। কতটা দ্রুততার সঙ্গে আর সঠিক নিয়মে দুর্ঘটনাকবলিত ব্যক্তিদের উদ্ধার করা যায়, তারই এক মহড়া এই সেফটি ড্রিল। এই অনুশীলনের গুরুত্ব কতটা জরুরি, তা আমরা টের পাই দুর্ঘটনা–পরবর্তী অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে পদদলিত কিংবা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে মৃত্যুর লোমহর্ষক কাহিনি পড়ে।

নিরাপত্তা ও সুরক্ষা একটি সংস্কৃতি। একটি কালচার। একটি অভ্যাস। একে প্রতিনিয়ত লালন–পালন করে গড়ে তুলতে হয়। ধারণ করতে হয়। অনেকটা টেস্ট ম্যাচের মতো দীর্ঘ সময় পরে ফলাফল আসে। টি–টোয়েন্টির মতো দিনে দিনে সাফল্য বা ফলাফল এই ক্ষেত্রে দুষ্প্রাপ্য। নিরাপত্তা ও সুরক্ষার সংস্কৃতির বিপরীতে আমাদের অবস্থানটা একটু দেখা যাক।

১. আমাদের প্রাথমিক থেকে উচ্চবিদ্যালয় পর্যায়ে মৌলিক নিরাপত্তাবিষয়ক পাঠক্রম নেই বললেই চলে। আমাদের শিশুরা ঠিক কত বয়সে (ক্লাসে) নিরাপত্তাবিষয়ক সরঞ্জাম, যেমন: অগ্নিনির্বাপক গাড়ি, অগ্নিনির্বাপক কর্মী, অ্যাম্বুলেন্স ও সাইরেনের সঙ্গে পরিচিত হয়, তার ঠিক কোনো নির্দেশনা আছে বলে আমার জানা নেই। তা ছাড়া বিভিন্ন দেশের বিগত বেশ কয়েক বছরের উপাত্ত থেকে দেখা যায়, এই প্রাণচঞ্চল শিশুদের স্কুলগুলো সন্ত্রাসীদের হামলার একটি লক্ষ্যবস্তু। আমরা কি আমাদের শিশুদের এমন জরুরি অবস্থায় করণীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে অবহিত করছি? (এমন ঘটনা যেন কোথাও না ঘটে, সে আশা আর দোয়াই করি। এই ধরনের ঘটনা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে)।

২. এবার দেখা যাক আমাদের জ্ঞানচর্চার সূতিকাগারগুলোর দিকে। বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও কারিগরি বিদ্যার একটা বড় অংশ হচ্ছে গবেষণাগারে ব্যবহারিক শিক্ষা। যেমন: রসায়ন, উদ্ভিদ ও প্রাণিবিদ্যা, ম্যানুফ্যাকচারিং, ওয়েল্ডিং, ধাতব কৌশল, কাস্টিং, তড়িৎ কৌশল ইত্যাদি গবেষণাগার। এই গবেষণাগারগুলোতেও আমাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার সংস্কৃতি হেলাফেলার। শিশুকাল থেকে যে সংস্কৃতির গোড়ায় দুর্বল, হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে রাতারাতি নতুন কিছু আশা করাটা বাড়াবাড়ি!

আন্ডারগ্র্যাজুয়েটের সময় আমার ওয়েল্ডিং ব্যবহারিক একটা পার্ট ছিল। মূলত আর্ক, টিগ ও মিগ ওয়েল্ডিং ছিল এর বিষয়বস্তু। যার মধ্যে আর্ক ওয়েল্ডিং বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা সচরাচর যে ওয়েল্ডিং দেখি, সেটা বেশির ভাগই আর্ক ওয়েল্ডিং। যার তীব্র শিখা চোখের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ক্লাসের মাঝে হঠাৎ দেখি, আমাদের এক বন্ধু ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করছে। সে চোখে কিছু দেখতে পারছে না! ওয়েল্ডিংয়ের তীব্র শিখা তার চোখে এসে লাগে! তাকে পাশের রুমের ট্যাপের পানিতে চোখ ধুইয়ে পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেওয়া হলো। বড় কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই সে সুস্থ হয়ে ওঠে কিছুদিনের মধ্যে। এমন একটা ঝুঁকিপূর্ণ ল্যাবে নিকটবর্তী স্থানে নির্দেশনাসহ চোখে দেওয়ার মতো পানির ফোয়ারা থাকা অত্যাবশ্যক।

আমাদের যে ভবনটিতে তত্ত্বীয় পাট হতো, তা ছিল ছয় তলাবিশিষ্ট। এর দুটি জরুরি প্রস্থান (ফায়ার এক্সিট) গেট ছিল, যা ওয়েল্ডিং করে স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া ছিল। ভাবা যায়!

আরেকটি ব্যবহারিক পার্ট ছিল, যেখানে নিরাপত্তা ও সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে আগুন প্রতিরোধক ভেস্ট, নিরাপত্তা চশমা আর লৌহবর্মের জুতা পরতে হতো। আমাদের বেশ কিছু সহপাঠীকে প্রায়ই এই ব্যবহারিক পার্টে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি সঠিক নিরাপত্তা সরঞ্জাম না থাকার জন্য, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় নিরাপত্তা ও সুরক্ষার সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় ছিল।

লেখক
লেখক

৩. আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় একসঙ্গে অনেক তাজা প্রাণের অকালমৃত্যু একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক যুগের কঠিন ও দুরারোগ্য ব্যাধিকে পাশ কাটিয়ে সড়ক দুর্ঘটনাই হয়ে উঠেছে এক মূর্তমান আতঙ্ক। এ যেন রূপকথার মৃত্যুপুরীর বাস্তব মৃত্যুকূপ। প্রবাস জীবনের (যুক্তরাষ্ট্র) একটা সাধারণ দৈনন্দিন কাজ হলো ড্রাইভিং। যুক্তরাষ্ট্রেও দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুতে ড্রাইভিং প্রথমস্থান দখলকারী। তার মধ্যে বরফ আচ্ছাদিত রাস্তা, বেপরোয়া ড্রাইভিং, আন্ডার ইনফ্লুয়েন্স ড্রাইভিং ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য নিয়ামক। কোনো এক অদ্ভুত কারণে আমাদের প্রবাসীদের বেপরোয়া ড্রাইভিং নিয়ে বেশ একটা গর্ব ভাব আছে (সবার জন্য প্রযোজ্য নয়), যা নিরাপত্তা ও সুরক্ষার সংস্কৃতির সম্পূর্ণ বিপরীত। এ ক্ষেত্রে বাংলায় দুটি প্রবাদ খুব গুরুত্বপূর্ণ—‘সাবধানের মাইর নাই’, ‘সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অধিক’।

৪. কর্মক্ষেত্রে নির্দিষ্ট স্থান ও কর্ম বিভাগভিত্তিক নিরাপত্তাপ্রহরী (ওয়ার্ডেন) অত্যাবশ্যক। যিনি কিনা জরুরি সময়ে তাঁর নির্দিষ্ট গণ্ডির লোকদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছতে সাহায্য করবেন। নিরাপত্তাপ্রহরী সাধারণত স্বেচ্ছাসেবা ও পালাক্রমিক হয়ে থাকে, যা একটি প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সংস্কৃতি গড়ে উঠতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে। প্রাণচঞ্চল শিশুদের স্কুলগুলোতে এই ‘নিরাপত্তাপ্রহরী’ ব্যবস্থা কার্যকর করা গেলে নিরাপত্তা ও সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি শিশুদের দায়িত্ব ও নেতৃত্ববোধের ও বিকাশ ঘটবে।

৫. প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সংস্কৃতির বড় অন্তরায় হলো পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপকদের বদ্ধমূল ধারণা নিরাপত্তাজনিত ব্যয় প্রতিষ্ঠানের মুনাফা কমিয়ে দেয়। এই ধারণা দীর্ঘ মেয়াদে সম্পূর্ণ ভুল ও বিপরীত! কর্মী, পরিবেশ ও সম্পদের ওপর সঠিক দায়বদ্ধতা, সাধারণ সচেতনতা বৃদ্ধি ও আইনের ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে নিরাপত্তাজনিত ব্যয়ের ওপর ব্যবস্থাপকদের এই ভুল ধারণা সম্পূর্ণ শুধরানো সম্ভব। সর্বোপরি একটি মানুষের জীবন ব্যয় ও মুনাফার অনেক অনেক ঊর্ধ্বে।

নিরাপত্তা ও জরুরি কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ, সরঞ্জামাদির আধুনিকায়ন আর প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার সন্দেহাতীতভাবে দুর্ঘটনা মোকাবিলার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক ও উপকরণ। এগুলো তখনই পরিপূর্ণরূপে কার্যকর হয়, যখন নিরাপত্তা ও সুরক্ষা কোনো জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। যেকোনো সংস্কৃতি যেমন এক দিনে গড়ে ওঠে না, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সংস্কৃতিও তেমনই, দীর্ঘ সময় ও শ্রমের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। উচ্চপদের কর্মকর্তা, প্রকৌশলী বা ব্যবস্থাপকদের মিষ্টি ও চটকদার কথায় এর সহজ কোনো সমাধান নেই। আমরা কেউই চাই না আমাদের প্রিয় লোকজনের পোড়া গন্ধ কিংবা সড়কে পিষ্ট হওয়া আত্মীয়ের দুর্বিষহ ছবি নিয়ে নিজের পরিণতির জন্য দিন গুনতে। দুর্ঘটনা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে সচেতন হওয়ার এখনই সর্বোচ্চ সময়। ‘ম্যাট্রিকস’ মুভির নায়ক নিওর মতো প্রথমে বিশ্বাস রাখতে হবে। এটা বিশ্বাস রাখতে হবে যে সব ধরনের দুর্ঘটনা সমূলে শতভাগ নির্মূল সম্ভব! হ্যাঁ, শতভাগ নির্মূল সম্ভব, যদি আমরা নিরাপত্তা ও সুরক্ষার সংস্কৃতি অনুশীলন ও ধারণ করি। সবাই সুস্থ, সচেতন ও নিরাপদে থাকুন।

শাহ মো. লিমন: পিএইচডি, সহকারী গবেষক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিং, নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি, ফার্গো, নর্থ ডাকোটা, যুক্তরাষ্ট্র। ফিল্ড হেলথ, সেফটি এবং পরিবেশ স্পেশালিস্ট শেভরন বাংলাদেশ (২০১০-১১)।

ই–মেইল: <[email protected]>