বসন্তের দূত চেরি

সাকুরা ফুল। ছবি: মাওদুদুল হাসান
সাকুরা ফুল। ছবি: মাওদুদুল হাসান

স্কুলে পড়াকালে যখন রেডিও শুনতাম, অ্যান্ড্রু কিশোরের গাওয়া একটি গান প্রায়ই শুনতে পেতাম, ‘ওগো বিদেশিনী, তোমার চেরি ফুল দাও, আমার শিউলি নাও, এসো দুজনে প্রেমে হই ঋণী।’ সেই গান শুনে কোনো এক কাল্পনিক বিদেশিনীকে শিউলি ফুল দেওয়ার জন্য কত খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি, যেমনটি পাইনি চেরি ফুলের দেখা। তারপর অনেকগুলো বসন্ত পেরিয়ে ২০১৫ সালে স্কলারশিপ নিয়ে যখন জাপানে এলাম, তখন বসন্তের দূত হিসেবে চেরি বা সাকুরা ফুলের দেখা পেলাম প্রথমবারের মতো। সে ছিল এক অদ্ভুত অনুভূতি।

প্রতিবছরই রুক্ষ-শুষ্ক শীতের শেষলগ্নে মার্চে বসন্ত আসি আসি করলেই হালকা গোলাপি কিংবা দুধসাদা আভায় পত্রহীন সাকুরাগাছগুলোতে সহস্র ফুল ফুটে ওঠে। তখন কেবলই মনে হয়, এ শুধু ফুলের দিন, এ লগন ফুল ফোটাবার।

রাস্তা দিয়ে হাঁটলে দেখা যায় রাস্তার দুধারে সারি সারি সাকুরা ফুলের গাছ আর ডালে ডালে গোলাপি আর সাদা ফুলের বাহার। হালকা লিলুয়া বাতাস বইলেই ঝরা ফুলে ছেয়ে যায় পথ। দৃষ্টির সীমানা পর্যন্ত ফুল ছড়ানো সেই পথে হাঁটলে মনে হয় এ যেন স্বর্গের পথে হাঁটছি, এ পথ যেন শেষ না হয়!

সাকুরা ফুল। ছবি: মাওদুদুল হাসান
সাকুরা ফুল। ছবি: মাওদুদুল হাসান

জাপানিরা এই সময় দল বেঁধে সাকুরা ফুল দেখতে যায়। যা হানামি নামে পরিচিত। হানা অর্থ ফুল, আর মি (মিরু) মানে দর্শন। দুটো শব্দ মিলিয়ে হানামি অর্থাৎ ফুল দর্শন। জাপানিরা ফুল দেখার এই রীতিকে বলেন সাকুরা মাৎসুরি বা চেরি ফেস্টিভ্যাল। পার্ক বা উন্মুক্ত উদ্যানে যেখানে অনেক ফুলসহ সাকুরা গাছের দেখা মেলে, সেখানেই জমায়েত হয় শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সবাই। দিনভর চলে নানা ধরনের কর্মকাণ্ড। গাছের তলার সবুজ ঘাসের ওপর মাদুর পেতে চলে খাওয়াদাওয়া। ফুল ফোটা উপলক্ষে নতুন মদের বোতল খোলা হয়। সঙ্গে ফুলের সঙ্গে বিভিন্ন আঙ্গিকে ছবি তোলা তো চলেই। রাতেও অনেকে এসব জায়গায় অবস্থান করেন। রাতে কোনো কোনো জায়গায় করা হয় অলোকসজ্জা। রাতের রকমারি আলোতে এই ফুলকে আরও অপূর্ব লাগে। রাতের হানামিকে জাপানিরা বলে ইওজাকুরা।

সাকুরা ফুল। ছবি: মাওদুদুল হাসান
সাকুরা ফুল। ছবি: মাওদুদুল হাসান

অনেক দেশের পর্যটক এ সময় জাপানে বেড়াতে আসেন সাকুরা ফুল দেখতে। গত বছর প্রায় ৫০ লাখ লোক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে চেরি ফুল দেখতে জাপানে এসেছিলেন। জাপান ছাড়াও চীন ও দক্ষিণ কোরিয়াতেও বসন্তকালে সাদা ও গোলাপি রঙের অনেক প্রজাতির চেরি ফুল ফোটে। তিন দেশের লোকেরাই এ ফুলের জন্য পাগল। সাকুরা ফুল দেখার উৎসব এখন জাপান ছাড়াও বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে পালিত হয়। আমেরিকাতেও এখন ঘটা করে সাকুরা ফুল দেখার উৎসব করা হয়। শত বছর আগে ১৯১২ সালে শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে জাপানিরা আমেরিকাকে তিন হাজার বিশটি সাকুরাগাছের চারা উপহার দিয়েছিল। ওই গাছগুলো ম্যানহাটানের সাকুরা পার্কে আর ওয়াশিংটন ডিসির ইস্ট পটোম্যাক পার্কের রাস্তার দুপাশে লাগানো হয়েছিল। সাকুরা ফুলের জন্য আমেরিকানরাও মুগ্ধ ছিলেন বলেই হয়তো আমেরিকাতে প্রথম দুটি চেরি ফুলের গাছ রোপণ করেছিলেন সেই সময়ের ফার্স্ট লেডি হেলেন ও আমেরিকাতে জাপানের রাষ্ট্রদূতেরের স্ত্রী চিন্দা। ১৯৬৫ সালে আরও ৩ হাজার ৮০০ চারা উপহার হিসেবে পাঠানো হয় জাপানের পক্ষ থেকে। ফলে সাকুরা এখন নাকি আমেরিকানদের কাছেও বেশ মোহনীয় একটি ফুল। এ বছর ব্রিটেনকে এক হাজার সাকুরাগাছ উপহার দিয়েছে জাপান। শুনেছি, প্রতিবেশী দেশ ভারতের হিমাচল ও জম্মু কাশ্মীরেও উল্লেখযোগ্য চেরি ফুলের গাছ দেখতে পাওয়া যায়।

পথের দুধারে সাকুরাগাছ। ছবি: মাওদুদুল হাসান
পথের দুধারে সাকুরাগাছ। ছবি: মাওদুদুল হাসান

সে যা হোক, আমার মনে হয়, জাপানিরা অন্য অনেকের চেয়ে সাকুরা নিয়ে একটু বেশিই মাতামাতি করে। এমনিতেই জাপানের জাতীয় গাছ ও ফুল হচ্ছে সাকুরা। কোনো জাপানিকে যদি প্রশ্ন করেন চেরি ফুল কেন পছন্দ করেন, একবাক্যে বলবে ‘সাকুরা উৎকুশিই কারা’ (কারণ সাকুরা অপরূপ)। সহস্র বছর আগে থেকে শুরু করে আজও লেখা হচ্ছে এই ফুল নিয়ে অসংখ্য হাইকু, কবিতা, গান—কত কী! জাপানের প্রতিষ্ঠান, অর্থ, শিল্পকলা, সাহিত্য, ফ্যাশন, খাবারদাবার, সংস্কৃতি, ধ্যানধারণায় দেহমনের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে এই ফুল। দেখবেন জাপানের দেওয়া ভিসায় চেরি ফুলের ছাপ রয়েছে। এখানে ১০০ ইয়েনের মুদ্রাতেও ছাপ আছে এই ফুলের। জাপানের প্রথাগত পোশাক কিমানোতে প্রায় অবধারিতভাবেই থাকে চেরি ফুলের ছাপ। জাপানিরা আন্তর্জাতিক কোনো স্টেজে কালচারাল গান গাইলে প্রায় অবধারিতভাবেই বিখ্যাত সাকুরা সাকুরা ফোক গানটি গেয়ে থাকে। আর অনেক ধরনের খাবার পাওয়া যায়, এমনকি সাকুরার ফ্লেভার দিয়ে বিখ্যাত ম্যাকডোনাল্ড বার্গার, কিট-ক্যাট চকলেট, কোকা-কোলা, বিয়ার ও স্টারবাকসের কফিও পাওয়া যায় এখানে। হরেক রকম কসমেটিক ছাড়াও কলম খাতা, জুতা এমনকি টিস্যুও পাবেন সাকুরা নামে। কোথায় নেই সে! গত বছর সাকুরা নিয়ে ব্যবসা হয়েছে প্রায় ২৭০ কোটি ডলারের।

অনেক ধরনের খাবার পাওয়া যায় সাকুরার ফ্লেভার দিয়ে। এ ছাড়া জুতাসহ বিভিন্ন সামগ্রীতে থাকে সাকুরা ফুলের ছবি। ছবি: মাওদুদুল হাসান
অনেক ধরনের খাবার পাওয়া যায় সাকুরার ফ্লেভার দিয়ে। এ ছাড়া জুতাসহ বিভিন্ন সামগ্রীতে থাকে সাকুরা ফুলের ছবি। ছবি: মাওদুদুল হাসান

তাই তো সাকুরা নিয়ে এমন উন্মাদনার দেশে বাংলাদেশিরাও কী বসে থাকতে পারে! ছুটির দিনে প্রিয়জনদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সাকুরা দেখতে। ছবি তো অনেক তুলেছি, কিন্তু বাস্তবের সুন্দর ক্যামেরার লেন্সে এসেছে কমই। সে যা হোক, কিন্তু কী জানেন এই ফুলের রূপ আছে কিন্তু একটুও ঘ্রাণ নেই। শুভ্রতা আছে কিন্তু মাদকতা নেই শরতের শিউলি, বকুল কিংবা বর্ষার কদম, কামিনীর মতো। আমাদের দেশে সাকুরার মতো আমরাও শিউলি উৎসব বা কৃষ্ণচূড়া উৎসব করতে পারি। ফুলের সৌন্দর্য যেমন উপভোগ করা যাবে এই উপলক্ষে নানান সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা যাবে। আসছে গ্রীষ্মে ‘কৃষ্ণচূড়া উৎসব’ দিয়েই শুরু করা যাক না তাহলে!
...

খায়রুল বাসার: পিএইচডি গবেষক, সাগা ইউনিভার্সিটি, জাপান।

সাকুরাগাছের নিচে লেখক ও অন্যরা। ছবি: মাওদুদুল হাসান
সাকুরাগাছের নিচে লেখক ও অন্যরা। ছবি: মাওদুদুল হাসান