নুসরাতের মৃত্যু ও আমাদের মানসিকতা

নুসরাত জাহান
নুসরাত জাহান

নুসরাত জাহান রাফির মৃত্যু আবারও আমাদের মানসিক দৈন্যর বিষয়টি সামনে নিয়ে এল খুবই খোলামেলাভাবে। আমরা যারা নিজেদের সভ্য ভাবি বা সভ্য চিন্তাভাবনা করতে ভালোবাসি, তাদের কাছে বারবার মনে হচ্ছে, এমন একটা নৃশংস ঘটনা ঠিক কীভাবে ঘটতে পারে। এমনকি যখন নুসরাত তাঁর অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন, তখন কীভাবে অধ্যক্ষের পক্ষে মিছিল বের হয়। স্থানীয় থানার দায়িত্বরত কর্মকর্তা নুসরাতকে থানায় ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদের নামে অশালীন কটূক্তি করে সেই ভিডিও আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দিয়েছেন। এরপরও নুসরাত শুধু নিজের ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তায় পরীক্ষা দিতে গিয়েছেন এবং সেখানেও তাঁকে শাসানো হয়েছে।

অবশেষে যখন দেখা গেল, নুসরাত কোনো কিছুতেই পিছপা হচ্ছেন না, তখন তাঁকে সরিয়ে দিয়ে পথের কাঁটা পরিষ্কার করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। অত্যন্ত বীভৎসভাবে সেটা বাস্তবায়নও করা হয়েছে। তারপরও নুসরাত মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে গেছেন যতক্ষণ পেরেছেন। কিন্তু একটা মানুষের শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে গেলে আসলে আর কতখানিই–বা অবশিষ্ট থাকে, যেটা দিয়ে বেঁচে থাকা যায়। তারপরও চিকিৎসকেরা তাঁদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গেছেন। তবে নুসরাতের এই মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে যাওয়াটাই আমাদের মানসিক দৈন্যকে আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। দিনে দিনে বাংলাদেশের সব মানুষ এবং পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশের মানুষ সেটা জানতে পেরেছেন এবং ধিক্কার জানিয়েছেন।

বাংলাদেশে যখন একেকটা ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, তখন অনেকে শুরুতেই মেয়েটার ঠিক কী কী দোষ ছিল, তার চুলচেরা বিশ্লেষণে লেগে যান। এমনকি এই দলে মেয়েদের সংখ্যাও কম নয়। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে তাঁরা সেটা ব্যক্তও করে যাচ্ছেন। শুরুতেই আসে পোশাকের বিষয়টা। তারপর আসে সেই ছেলের সঙ্গে মেয়েটার প্রেম ঠিক কতখানি গভীর ছিল তার রসাল বর্ণনা। আদতে প্রেম ছিল কি না, সেটা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। আর প্রেম থাকলেই তাকে ধর্ষণ করা যায় এমনকি সেই ধর্ষণের ভিডিও ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর যদি মেয়েটা শিশু হয়, তখন অবশ্য তাঁরা চুপ করে যান। কিন্তু তখন শুরু হয় মিডিয়ার ওপর আক্রমণ। মিডিয়ার মেয়েদের কুৎসিত পোশাক–আশাক দেখে উত্তেজিত হয়ে এমন কাজ করেছে মর্মে সাফাই গাওয়া শুরু হয়। শুধু সাফাই গেয়েই শেষ হয় না। তখন মিডিয়ার মেয়েদের পোশাকের বিভিন্ন দিকের রসাল বর্ণনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া যায়। সেখানেও মেয়েদের দেখা যায় বিভিন্ন কটু মন্তব্য করতে। এর ব্যতিক্রম অবশ্য আছে। কোন কোন অভিনেত্রীর গোপন ভিডিও ফাঁস হয়েছে, তার তালিকাও তখন পাওয়া যায়।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এসবের ঠিক কোন কারণটা একজন ধর্ষককে দায়মুক্তি দেয়? এবার আসি একটু বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে। বহির্বিশ্বের মেয়েদের পোশাক আমাদের ভাষায় আসলেই অদ্ভুত ও ভয়ংকর রকমের খাটো। কিন্তু সেসব দেশে ধর্ষণ কেন হয় না? অস্ট্রেলিয়াতে দেখেছি এখানে মানুষ প্রচণ্ড শীতেও অনেক কম কাপড়চোপড় পরে। কারণ, তারা এমন আবহাওয়াতেই ছোটবেলা থেকে বড় হয়। তাই তাদের কাছে ব্যাপারটা গা সওয়া হয়ে যায়। আর পোশাকের ব্যাপারটাতে প্রাধান্য পায় স্বাচ্ছন্দ্য। ফ্যাশনের বিষয়টা তাই দেখা যায়, তাদের পোশাকে বাহুল্য একেবারেই নেই। জিনসের প্যান্টের বিভিন্ন জায়গায় ছেঁড়া। গায়ের পোশাকও অনেক বেশি খাটো। কারণ, বেশি কাপড় পরলে সেটা নিয়ে চলাফেরা করা যেমন অসুবিধা, তেমনি পরিষ্কার করতেও অনেক ঝক্কি। তার মানে এই না, আপনি অনেক বেশি কাপড় পরে চলাফেরা করলে গায়ে পড়ে আপনাকে উপদেশ দিতে আসবে।

বাংলাদেশে কেউ একজন একটু অন্য রকমের পোশাক পরলেই কাউকে না কাউকে পাওয়া যাবেই। যে একটা উড়ন্ত মন্তব্য ছুড়ে দেবেই। আর যারা সাহস করে মন্তব্য করে না, তারাও মনে মনে এমন ধারণা পোষণ করে। এর ব্যতিক্রমও আছে। বর্তমানের চল হচ্ছে কোল্ড শোল্ডার পোশাক পরার। যেটাতে দুই কাঁধের ওপরের সামান্য অংশ খোলা থাকে। এই পোশাক পরে আমার ভাগনি একদিন তার ক্যাম্পাস থেকে ফেরার পথে শুনেছে, ‘আপু, ওড়নাটা ঠিক করেন’। শুনে সে অনেক ভয় পেয়েছে। কারণ, আমার দেখা সবচেয়ে সভ্য মেয়েটা হচ্ছে সে। আমরা যখন বিদেশে বসে আরামে আছি এবং দেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কটু মন্তব্য করেছি, তখনো সে দেশে থাকার ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি বললাম, তুমি একটু চেষ্টা করলেই বাইরে আসতে পারো। ভাগনি বলল, কিন্তু এই দেশটা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না মামা। এমনকি এই ঘটনার পরও আমি যখন বললাম, তুমি তাড়াতাড়ি কাগজপত্র তৈরি করো। কিন্তু সে রাজি হয়নি।

আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বিদেশে মেয়েদের খাটো ও কিম্ভুতকিমাকার পোশাক দেখে আপনার মনে হতেই পারে তারা নিশ্চয় অনেক উচ্ছৃঙ্খল ও বেকার। ব্যাপার কিন্তু মোটেও তেমন না। আমি আমার কাজে ও পথেঘাটে অনেক অপরিচিত মানুষের সঙ্গে গায়ে পড়ে আলাপ করি। সেখান থেকেই জানি তাঁরা অনেক বেশি মানবিক মানুষ। আপনি যদি তাঁদের কাছে কোনো একটা সাহায্য চান, তাহলে তাঁরা তাঁদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। এমনকি একেবারেই সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের সঙ্গেও কুশল বিনিময়ের যে চল বিদেশে আছে, সেখানে আপনি একটা মেয়েকে কুশল জিজ্ঞেস করলে সেও আপনাকে কুশল জিজ্ঞেস করবে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সম্বোধনগুলো হয় অনেক মনকাড়া যেমন, হানি বা ডার্লিং। এটা শুনে আপনার এমন মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই যে সে আপনাকে তার বয়ফ্রেন্ড মনে করছে। আসলে এগুলোই এখানকার স্বাভাবিক সম্বোধন। তাই আমি সব সময়ই একটা কথা বলে থাকি সেটা হলো, মেয়েদের পোশাকের ফাঁক দিয়ে না তাকিয়ে তাদের মনের দিকে তাকান। দেখবেন তারা কত ভালো মানুষ। কিন্তু হতাশার বিষয় হচ্ছে অনেক বাংলাদেশিকেই দেখেছি তাদের মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। তাই সামনাসামনি কটু মন্তব্য না করলেও বন্ধুদের আড্ডায় মেয়েদের পোশাক নিয়ে খিস্তিখেউড় করছে।

আরেকটা বিষয় অনেক বাংলাদেশি মেয়েদের ধর্ষণের কারণ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। সেটা হচ্ছে তাঁদের কর্মঘণ্টা। কেন মেয়েরা রাতে কাজে যান বা আসেন। দিনের বেলায় কাজ করলেই তো আর এমন ঘটনা ঘটবে না বলে কিছু মানুষ গলাবাজি করেন। এখানে বলে রাখা ভালো, কর্মঘণ্টা হিসাব করা হয় ছেলে বা মেয়ের হিসাবে নয়, বরং পেশার প্রকার হিসেবে। বাংলাদেশে থাকাকালে আমার গিন্নিকে তার কর্মক্ষেত্র টাঙ্গাইলে যাওয়া–আসা করতে হতো এবং দেখা যেত অনেক সময়ই রাত হয়ে যাচ্ছে। আমি বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে যেতাম। সত্যি কথা বলতে, মনে একটা অজানা আশঙ্কা কাজ করত। আসলে ডাক্তারি পেশাটাই এমন। আর বাংলাদেশের মানুষদের সব রাগ ডাক্তারদের ওপর। তাদের কাছে ব্যাপারটা এমন, ডাক্তারই চিকিৎসাব্যবস্থার সব অব্যবস্থাপনার মূল কারণ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তাঁদের আসলেই খুব বেশি কিছু করার নেই। তবু তাঁরা তাঁদের সর্বোচ্চ দিয়ে একজন রোগীর সেবা করেন। এরপরও পান থেকে চুন খসলে ডাক্তারদের গায়ে হাত তোলা বাংলাদেশে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। আর পরিবারে একজন ডাক্তার থাকলে বোঝা যায়, আসলে একজন ডাক্তারের জীবন কতটা কঠিন অন্য একজন মানুষের তুলনায়। তাই আমি আমার ছেলেমেয়েকে বলে দিয়েছি, তোমরা ডাক্তারি ছাড়া পৃথিবীর যেকোনো পেশা পছন্দ করতে পারো।

বিদেশে একটা মেয়ে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে যেকোনো শিফটেই কাজ করতে পারে। রাতবিরাতে কর্মস্থলে যাওয়া–আসা কোনো আলাদা ঘটনা নয়। আমি আমার কর্মস্থলে যাওয়া–আসার জন্য পাবলিক পরিবহন বাস ও ট্রেন ব্যবহার করি। সেখান থেকেই এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। মধ্যরাতেও বাস–ট্রেনে মেয়ে সহযাত্রী পেয়েছি। তারা নির্ভয়ে কোনো প্রকার দ্বিধা ছাড়াই চলাফেরা করছে। এমনকি হেঁটে বাস বা ট্রেন স্টেশনেও যাচ্ছে। সেখানেও অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে। আসলে আমার কাছে মনে হয়েছে, এসব দেশে একজন মানুষ বড়ই হয় শুধু একজন মানুষ হিসেবে। তারপর সে মেয়ে অথবা ছেলে। আমাদের কর্মস্থলে আমরা যখন আড্ডা দেই, তখন বিষয়ের কোনো সীমারেখা থাকে না। ছেলেমেয়ে সব সহকর্মীই সমান অংশগ্রহণ করেন। এমনকি অফিসের বিভিন্ন পার্টিতেও মেয়েদের আলাদা করে দেখা হয় না। আসলে আপনি যখন একজন মানুষকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান বা মর্যাদা দেবেন, তাঁকে আবার মেয়ে হিসেবে আলাদা করে সম্মান দেওয়ার দরকার পড়ে না।

অনেক ভালো জিনিসের মধ্যে সামান্য খারাপ জিনিসও আলাদাভাবে চোখে পড়ে। বাংলাদেশের মেয়েরা বিভিন্নভাবে এগিয়ে যাচ্ছে এবং এই অগ্রযাত্রা দিন দিন বেগবান হচ্ছে। পাশাপাশি কিছু কিছু ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, কোন জায়গাগুলোতে আমাদের নজর দিতে হবে। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব–১৯ ফুটবল দলের মেয়েরা বিভিন্ন টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেই চলেছে। পাশাপাশি তারা যখন লোকাল বাসে চড়ে বাড়ি ফিরছিল, তখন কিছু উচ্ছৃঙ্খল যাত্রী তাদের নিয়ে কটু মন্তব্য করেছিল। আবার এই বাংলাদেশেরই একজন মেয়ে নিজেকে অশ্বারোহী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে অনেক কম বয়সেই। আমি নিশ্চিত, সেখানেও কিছু মানুষ তাকে নিয়ে কটু মন্তব্য করতে ছাড়েনি। আমার মূল বক্তব্য হচ্ছে, যারা এই খারাপ কাজগুলো করছে বা করে বা করবে, তারা সংখ্যায় আসলেই অনেক কম। তাহলে বাকি যাঁরা ভালো মানুষ, তাঁরা কেন সেগুলোর দায়ভার নেবেন। সমস্যা হচ্ছে যারা খারাপ, তারা অনেক বেশি উচ্চকিত ক্ষমতায় বা টাকার অঙ্কে। তবু তারা মনের দিক দিয়ে অনেক বেশি ভঙ্গুর। সময় হয়েছে ভালো মানুষদের নিজেদের মানসিক দৈন্য ভাঙার। প্রতিবাদ প্রতিরোধে উচ্চকিত হওয়ার। কারণ, পরের ভুক্তভোগী যে আপনার পরিবারের একজন হবে না, তারই–বা নিশ্চয়তা কে দেবে?
...

মো. ইয়াকুব আলী। ই–মেইল: <[email protected]>