শান্ত হ্রদের স্নিগ্ধ শহর রিভা ডেল গার্দা

জিঙ্গেল বেলের সুরে সংগীত দল
জিঙ্গেল বেলের সুরে সংগীত দল

জার্মানির সব শহরেই ছোটবড় রেলস্টেশন ছাড়াও একটা করে কমলাপুর থাকে। সেগুলোকে বলে হপ্ট-বান-হফ। কেন্দ্রীয় রেলস্টেশন। সেদিন ট্রেন ধরেছি মিউনিখের কমলাপুর থেকে। গন্তব্য ইতালির ট্রেন্টো অঞ্চলের রিভা ডেল গার্দা। আলপাইন পাহাড়ঘেরা গার্দা হ্রদের পারের এক শান্ত শহর এই রিভা। ইতালি পৌঁছে রোভেরেতো নামের এক জায়গায় ট্রেন থামলে সেখান থেকে গাড়ি এসে আমাদের রিভা শহরে নিয়ে যাবে। হোটেল বুকিংয়ের সময় গাড়ির ব্যবস্থা করে যাত্রাপথের হাঙ্গামা কমিয়ে ফেলা হয়েছে।

ট্রেনে ছয় আসনের একটা কামরা আমরা ভাড়া নিয়েছি। একদিকে বসেছে মৌরি আপু আর হাদী ভাই। আরেক দিকে আমরা, রুমি আর রিম। মাঝখানে মেঝেতে গড়াগড়ি দিচ্ছে দুই অণু পরিবারের দুজন পারমাণবিক সদস্য। তারা যে যার মতো গলা সপ্তমে চড়িয়ে চেঁচাচ্ছে। চেঁচামেচিতে অতিষ্ঠ হয়ে বড়দের ব্যাগ থেকে কলা, রুটি আর কেক উঁকি দেওয়া শুরু করেছে। রুটি চিবানোর ফাঁকে ফাঁকে হালের মুরাদ টাকলিয় বাংলিশের একনিষ্ঠ ভক্ত হাদী ভাই আনন্দে আত্মহারা ভঙ্গিতে বলছেন, ‘মগা হাবা, মগা হাবা’ (moga haba)। মজা তো হবেই। একঘেয়ে ঘানি টানা প্রবাসজীবনের গোয়াল ফাঁকি দিয়ে দড়ি ছেঁড়া গরুর পাল আজকে বাছুরসমেত পালিয়েছি যে! সামনের কয়েকটা দিন ছাড়া গরুর মতোই মাঠ ঘাট দাপিয়ে বেড়াব। এই না হলে জীবন। মনে মনে আমিও বললাম, ‘জয় বাবা, মগা হাবা!’

জানালার বাইরে দৃশ্যপট একের পর এক বদলে যাচ্ছে। কখনো শহরতলি, কখনো ছবির মতো সাজানো গ্রাম, কখনো বা তুষারে ঢাকা মাঠের পর মাঠ। সবার ভারী জ্যাকেটগুলো ট্রেনের কামরার হুকের সঙ্গে লটপটিয়ে ঝুলছে। কিন্তু আমি বেচারা জ্যাকেট তো খুলিইনি, বরং চেইনটা গলা পর্যন্ত তুলে, ঢাকা কলেজের উল্টো থেকে কেনা নকল কাশ্মীরি শালটা নিশ্ছিদ্রভাবে পেঁচিয়ে জাঁকিয়ে বসেছি। নিজেকে তিব্বত দেশীয় কল্পিত প্রাণী ইয়েতি মনে হচ্ছে। আসল কাহিনি হলো, ঠান্ডা লেগে চাট্টিবাট্টি গোল অবস্থা। ঘাড় নাড়াতে পারছি না। পেরিফেরাল ভিউ বলে কিছু নেই আর। যেদিকে তাকাতে চাই, ঘাড়-ধড় একসঙ্গে ঘুরিয়ে দাঁড়াতে হয়। সামান্য কাশিটা বেড়ে এমন যক্ষ্মামার্কা চেহারা নেবে, ভুলেও ভাবিনি। মনীষীরা বোধ হয় এমন পরিস্থিতির কথা ভেবেই এর নাম দিয়েছেন, ‘মাইনকা চিপা’।

সেদিন ডাক্তারের চেম্বার থেকে প্যাঁচ মেরে বলা হয়েছে, ঠান্ডাটা কোনো ভাইরাল সংক্রমণ হতে পারে আবার ব্যাকটেরিয়াজনিতও হতে পারে। সাত দিনে সারতে পারে, আবার এক সপ্তাহও লাগতে পারে। অধৈর্য আমি মুখ ফসকে জানতে চাইলাম, ‘এত যে কাশছি, হুপিং কফ হয়ে গেল না তো আবার?’ চোরের ওপর বাটপারির মতো ডাক্তারের ওপরও খোদকারি করতে নেই। ডাক্তারের হাসিমুখ দপ করে নিভে গেল, ‘হুপিং কফ আবার কী?’ তাড়াহুড়া করে বললাম, ‘কেন, ওই যে বললে, পারটুসিস হওয়ার ভয় আছে?’ ডাক্তার চোখেমুখে চরম অবিশ্বাস নিয়ে অন্তর্জালে হামলে পড়ে গোকুল (পড়ুন গুগল) দৈত্যের প্রদীপে ঘষা মেরে বসল। এদিকে আমি স্বেচ্ছায় ভুলভাল বকছি, ‘হুপিং কফ তো মনে হয়ে ধনুষ্টষ্কার। বিড়ালের কামড়ে যা হয়, তাই না?’ আমার আমতা কথা উপেক্ষা করে উজ্জ্বল মুখ তুলে ডাক্তার বললেন, ‘আরে না, তুমিই ঠিক। যাহাই পারটুসিস, তাহাই হুপিং কফ।’

গার্দা লেকের সন্ধ্যা
গার্দা লেকের সন্ধ্যা

তো চিরকালের ল্যাটিন নাম চেনা জার্মান ডাক্তার আমার সম্ভাব্য হুপিং কফের কোনো রকম নিদান ছাড়াই বিগলিত হাসিতে বিদায় দিলেন সেদিন। তাঁর ভরসায় না থেকে আমি দেশে আমার ডাক্তার ভাইকে ফোন লাগিয়ে রোগের লক্ষণ জানিয়ে আলমারির দেরাজে খুঁজে পেতে তিন বড়ির একটা অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স শুরু করে দিলাম। আজকে তার প্রথম দিন। তবে অতি স্বাস্থ্যকর ইতালীয় রিভা শহরে গিয়ে একবার পড়লে বায়ু পরিবর্তনের জোরে কাশির গলায় ফাঁসি পড়বেই। আর আমিও সুস্থ হয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচব। সেই আশাতেই ডিসেম্বরের এক বিষণ্ন ম্যাড়মেড়ে শীতের সকাল পেছনে ফেলে টিকিট মিলিয়ে বগি খুঁজে ইতালির ট্রেনে চেপে বসা।

দুই.

হোটেলে পৌঁছালাম যখন, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। হোটেল বলা হয়তো ভুল হবে। ভ্যাকেশন অ্যাপার্টমেন্ট বা ভ্রমণ নিবাস বললে বোধ হয় বেশি মানানসই হয়। তিনতলা বাড়ির অনেকগুলো ফ্ল্যাটের একটা। হোটেলের তুলনায় সস্তা। কিন্তু রুম সার্ভিস নেই। চাদর-তোয়ালেও নিত্য নিত্য নিজ থেকে পাল্টে যাবে না। আর ঘরের ধুলা-ময়লা ভ্যাকিউম চেপে নিজেদেরই সাফসুতরো করতে হবে। এ যেন পুরোপুরি বিটিভির ‘এসো নিজে করি’ অনুষ্ঠান। তবে নিজেদের মতো করে এলোমেলো থাকার আর রান্নাঘরে যথেচ্ছ রেঁধেবেড়ে খাওয়ার স্বাধীনতা আছে। সেটাও বা কম কিসের?

কিন্তু ঘরে তো ঢুকতে পারছি না। বাড়ির মালিককে ফোন লাগানো হয়েছে। ভদ্রমহিলার আসার নাম নেই। বোঁচকা-বুঁচকি নিয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। তা–ও মিনিট বিশেক হয়ে গেছে। অবশ্য আমাদের সঙ্গ দেওয়ার জন্য ঘাড়ের ওপর থেকে উঁকি দিচ্ছে আলপসের সুউচ্চ প্রাচীর। জায়গাটার তিন দিক পর্বত প্রাচীরে ঘেরা আর আরেক দিকজুড়ে গার্দা হ্রদের তীর। যেন কোনো যুদ্ধবাজ রাজা সুরক্ষিত এক দুর্গ বানিয়ে শেষে সবচেয়ে জরুরি অভেদ্য ফটকটা লাগাতেই ভুলে গেছেন। ফটকবিহীন দুর্গটায় হু হু করে মাতাল হাওয়া ঢুকে চারপাশে পড়ে থাকা জলপাই গাছের পাতাগুলোকে মর্মর সুরে নাচিয়ে বিচিত্র এক অভ্যর্থনা জানিয়ে গেল অপেক্ষায় থাকা ক্লান্ত আমাদের দলটাকে।

ভারোনের ঝরনা
ভারোনের ঝরনা

আধা ঘণ্টা পর কাঙ্ক্ষিত গৃহ প্রবেশ ঘটল। কিন্তু কোথায় সবাই হাতমুখ ধুয়ে তাজা হওয়ার চেষ্টা করব, তা না করে হাতের ফোন উঁচিয়ে ঘরের কোনা কানচি, চিপা-চুপা সব পরখ করে বেড়ানো শুরু করলাম। উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। ওয়াই-ফাই সংকেত পাকড়াও করা। বাড়িওয়ালি চলে গেছেন, কিন্তু তাঁকে আবার ফোন লাগিয়ে পাসওয়ার্ড যাচাই করা হলো। অক্সিজেন না হলেও চলতে পারে আমাদের, কিন্তু অন্তর্জাল নামের অদৃশ্য মাকড়সার আঠালো জালে নিজেরদের স্বেচ্ছায় বন্দী করে না ফেলা পর্যন্ত কেমন অসহ্য রকমের মুক্ত মুক্ত লাগতে থাকে। অবশেষে সদর দরজার সামনের বড় আয়নাটার কাছে মিলল বহু কামনার মোক্ষ। সদলবলে গর্জে উঠলাম, ‘হুররে...!’ এই আধুনিক মোক্ষের সন্ধানে অশ্বত্থগাছের ছায়ায় গৌতম বুদ্ধের মতো অনন্তকাল বসে থাকতে হয় না। পাসওয়ার্ড টিপ দিলেই সিসিম দুয়ার খুলে যায়। পর্যাপ্ত পরিমাণ চেক ইন আর স্ট্যাটাসের বন্যা বইয়ে দিতে কেউ নীল-সাদা জগৎটা হারালাম। কেউ বা দেশে ফোন লাগিয়ে ‘আম্মা, আমি পৌঁছায় গেসি’ জাতীয় আশ্বাসবাণী শুনিয়ে বাঙালি মায়ের মাঝ তিরিশের চির শিশু সাজলাম। আর সত্যিকারে শিশুগুলো তখন পর্দার কোনা ধরে ঝুলছে কিংবা সোফার হাতল কামড়ে লালা দিয়ে ভিজিয়ে ফেলতে ব্যস্ত। মোক্ষ তো আসলে এরাই লাভ করে বসে আছে।

শেষ বিকেলের রোদটা আমাদের ছেলেমানুষি আর সইতে না পেরে বারান্দায় হানা দিয়ে একেবারে ঘাড় ধরে ঘরের বাইরে ডেকে নিল। বেরিয়ে এসে দেখি পাহাড় মুচকি হাসছে, ‘এতক্ষণে সময় হলো বুঝি?’ আকাশের পড়ন্ত সূর্যঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, আসলেই তো, বেলা যে পড়ে গেল। পাহাড়ের বিশালতার কাছে লজ্জা পেয়ে পা বাড়ালাম মধ্যযুগে গড়ে ওঠা এই শহরটা ঘুরে দেখব বলে। পথের বাঁ পাশে গার্দা হ্রদও আমাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বয়ে চলল। আলপসের গ্লেসিয়াস থেকে সর্বশেষ বরফযুগের একেবারে শেষ প্রহরে এই হ্রদের সৃষ্টি। এর অববাহিকায় রিভা ছাড়াও গড়ে উঠেছিল আরও কতগুলো শহর। সব তো দেখা সম্ভব না। একটাই না হয় প্রাণভরে দেখি এই দুটো দিন।

জেন গার্ডেন
জেন গার্ডেন

এককালের সাদামাটা রিভা এখন পুরো মাত্রায় খাঁটি পর্যটন শহর। শহরে এখানে ওখানের প্রাচীন দালানকোঠায় ভেনিশিয়ান স্থাপত্যের ছাপ আছে পড়েছি। স্থাপত্যের এই ধারার জন্ম সেই চৌদ্দ শ শতকের প্রাচীন ভেনিসে। এতে মিশেছে তৎকালীন কন্সট্যান্টিনোপলের বাইজানটাইন নকশার কিছুমিছু আর সে যুগের আন্দালুসিয়ার মুরিশ স্থাপত্যের প্রভাব। সঙ্গে ইতালির নিজস্ব গথিক ধারার অনেকটা অংশ তো আছেই। কিন্তু আমরা যে পথে হাঁটছি, সেখানে তেমন কোনো বাহারি দালানগুলো চোখে পড়ছে না তো। ওই তো সব একালের চার কোনা বাক্সগুলো সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো জানালাটা ভারিক্কি কিংবা ফটকটা রাশভারী। বড়জোর আয়েশি ঝুল বারান্দা। ব্যস, এই তো। কিংবা কে জানে হয়তো একটা শিল্পীমনের অভাবে সূক্ষ্ম সৌন্দর্য আমি দেখতে পাই না। বাহারের চাইতে বরং একেকটা বাড়িঘরের একেক রং বেশি চোখে লাগল। বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা—এ যেন রংধনুর শহর! কটকটে লাগছে না মোটেই, বরং একটা মোম রঙা স্নিগ্ধতা আছে। হঠাৎ মাঝে চোখের পড়ল বেমানান এক ধূসর মিনার। মধ্যযুগে গড়ে ওঠা সান মার্কো নামের এই মিনারটা ভেনিশীয় যুগে এসে আবার নতুন করে তৈরি করা হয়েছিল। তারপর ক্ষয়ে ক্ষয়ে এটুকুতে এসে ঠেকেছে। তবু সেটুকু নিয়েই সে কালের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাল্লাবিহীন বিশাল দরজা এখনো তার অতীত দর্প জানিয়ে যায় যে, এককালে সে ছিল শহরের প্রধান প্রবেশদ্বার।

আমাদের দলটা এগিয়ে চলছে। বাতাসে ক্যারামেলে ভাজা অ্যালমন্ড বাদামের মিষ্টি ঘ্রাণ। বড়দিন ঘনিয়ে আসছে। ঈশান কোন থেকে বেহালার সুরে ভেসে আসছে, ‘জিঙ্গেল বেল, জিঙ্গেল বেল...’। ঘের দেওয়া জমকালো পোশাকে ডাইনি বুড়ি সেজেছে জনাকয়েক তরুণী। পোশাকের সর্বাঙ্গে জড়ানো ছোট ছোট রঙিন বাতি। সাঁঝের জোনাকির মতো সেগুলো জ্বলছে আর নিভছে। সঙ্গের ষোলো-সতেরো বছরের সুশ্রী চেহারার দুই কিশোর ড্রাম পেটাচ্ছে তালে তালে। তাদের ছোট দলটা মূর্ছনার রেশ তুলে হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালা হয়ে শহরের অলিগলি ধরে হাঁটতে থাকল। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধ ইঁদুরের দলের মতো তাদের পিছু নিলাম। ডাইনিরা আবার আমাদের গার্দা হ্রদের পাড়ে না নিয়ে গেলে হয়। অল্প সাঁতার জানা আমাদের সলিল সমাধি তখন আর ঠেকানো যাবে না।

একটু এগোতেই আরেক বাজনার দল পাওয়া গেল। বয়সে এরা প্রবীণ। কিন্তু তারুণ্য যে সাদা চুল আর চামড়ার ভাঁজেও অনায়াসে থাকতে পারে, সেটা বোঝা গেল যখন দলটা তাদের অদ্ভুত চেহারার কিম্ভূত একেকটা বাদ্যযন্ত্র বেদমভাবে বাজানো শুরু করল। একেবারে সুরের তুমুল কালবৈশাখী বয়ে গেল। আবার বাজনার মাঝপথে থেমে তারা হঠাৎ হঠাৎ হুংকার ছাড়ছে, ‘গাবালু হেহ্ হেহ, গাবালু হোহ্ হোহ...’। গাবালু যে কী বস্তু, ক্যোঁৎ করে গিলে খায়, নাকি চপচপে করে তেলের মতো মাথায় দেয়, কিছুই বুঝতে পারছি না। শুধু অভিভূতের মতো দেখছি এই বুড়ো যুবকদের তেলেসমাতি কাণ্ড। বাচ্চারাও সুযোগ পেয়ে তালে তাল মিলিয়ে ক্ষ্যাপা নাচ জুড়ে দিয়েছে।

মন্টে বাল্ডোর চূড়া
মন্টে বাল্ডোর চূড়া

এদিকে বাচ্চাদের বাবারা কফি আর স্ন্যাক্সের খোঁজে লাপাত্তা হয়ে গিয়েছে সে অনেকক্ষণ হলো। মৌরি আপু আর আমি আর না পেরে কুটিল রমণীর মতো লাপাত্তা বাবাদের নামে একে অন্যের কাছে নালিশ করছি। হাদী ভাই নাকি মৌরি আপুর সোনার জীবন তামা তামা করে দিয়েছে। শুনে প্রবল আবেগে আমিও যোগ করলাম, ছেলের বাবাও কীভাবে আমার কচি পাতার মতো সবুজ কলিজাটা একদম তেজপাতা করে ছেড়েছে। এরা সব দুষ্ট লোক। বলতে না বলতেই দুষ্ট লোকেরা কফি আর স্যান্ডউইচ হাতে উদয় হলো। আর আমরা দুই ঘষেটি বেগম, আমাদের তামা জীবন আর তেজপাতা কলিজার দুঃখ ভুলে ছোঁ মেরে খাবারগুলো বাগিয়ে নিলাম। হাত বাড়িয়ে ছানাগুলোকেও ডেকে নিলাম। এখন আর লোকগুলোকে অতটা দুষ্ট লাগছে না।

সন্ধ্যাটা বাদুড় ডানায় ভর করে কখন যে নিঃশব্দে নেমে এসেছে, খেয়ালই করিনি। গার্দার নিস্তরঙ্গ জলে পাহাড়ি বাতাসের তোড়ে মৃদুমন্দ কৃত্রিম ঢেউ খেলছে। কেন যেন মনে হচ্ছে এই বুঝি বা ঢেউ মাথায় রহস্যময় কোনো জলদানব ভেসে উঠবে। কিন্তু না, উপকথার কোনো লকনেস দানবের দেখা মিলল না। অগত্যা পা বাড়ালাম ভালো কোনো রেস্তোরাঁর খোঁজে। ক্লান্ত শ্রান্ত শরীর কফি-স্যান্ডউইচ নিমেষে হজম করে নিয়ে বুভুক্ষুর মতো আরও চাইছে।

তিন.

সারাটা রাত খকর খকর কেশে মহল্লার সব ইতালিয়ান চোরদের ভাত মেরে ভোরের দিকে চোখ বুজে এল। কিন্তু সে সুখ বেশিক্ষণ সইল না। বাকিরা উঠে পড়েছে। আমি একা মটকা মেরে অলস পড়ে থাকলে কেমন দেখায়। অগত্যা অনিচ্ছার আড়মোড়া ভাঙতে হলো। মৌরি আপুও সকালের প্রথম চায়ের জোগাড়ে ব্যস্ত। স্বাস্থ্যসচেতন হাদী ভাই ছয়টায় বেরিয়ে গেছেন দৌড়াতে। ঘরের ভেতরটা সোনারঙা রোদে সয়লাব। ঘুম ঘুম রেশটা কেটে গেল। রোদের এমনই ক্ষমতা। আজকের বেড়ানো ঝরনাকেন্দ্রিক। খুব চমৎকার একটা ঝরনা আছে কাছেপিঠে, সেখানে যাওয়া হবে খানিক বাদে। মনটা চনমনিয়ে উঠল। কাঁধে ঝোলা নিয়ে বেরোবার জন্য তর সইছে না।

একে একে সবাই তৈরি হয়ে নিলাম। ঘাপলাটা বাঁধিয়ে দিল দলের সবচেয়ে ধবধবে সদস্য রুমি। সে মিনিট চল্লিশেক লাগিয়ে গোসল করছে তো করছেই। ইস্রাফিলের শিঙা ফোঁকার আগ পর্যন্ত মনে হয় চলবে এই প্রাতঃস্নানের ঘটা। মৌরি আপু তো আর না পেরে দরজায় দড়াম দড়াম কিল মেরে এল। অভিযোগের সুরে জানালাম, এই গোসলের নাম বিউটি গোসল। হাদী ভাই যেমন স্বাস্থ্যসচেতন তার ছোট ভাই তেমন রূপসচেতন। ঘরে তো প্রতিদিন এই অত্যাচার চলে। এখানে এসেও সে ধারাবাহিকতার হেরফের হয়নি। শুনে আপু কী বলল ঠিক বোঝা গেল না। শুধু দাঁত কিড়মিড়টা স্পষ্ট শোনা গেল। যা হোক, সবার চুলে পাক ধরে যাওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে বিস্ময়কর বিউটি গোসলের জনক শ্রীযুক্ত রুমি তার গোলাপি কানের লতি নিয়ে লাজুক হাসি হেসে বেরিয়ে এল। গোলাপি লতি আমাদের মুগ্ধ করতে পারল না। তাকে আমরা প্রায় চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে গজগজ করতে করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।

স্কালিজার দুর্গ
স্কালিজার দুর্গ

রিভা শহর থেকে বাসে করে মিনিট বিশেকের পথ। গন্তব্যের পুরো নাম পার্কো গ্রোত্তা কাস্কাটা ভারোনে। বলতে গিয়ে জিব পেঁচিয়ে আসছে। তার চেয়ে ব্যবচ্ছেদ করে বলি। জায়গাটার আকর্ষণ দুটি। এক. কাস্কাটা ডেল ভারোনে। মানে কাস্কাটার ঝরনাধারা। আরেকটা হলো পার্কো গ্রোত্তা বা গুহাবাগান। বাগান অবশ্যই গুহার ভেতরে নয়। বরং গুহার আশপাশ দিয়ে উঠে-নেমে গিয়েছে নাকি। খুব সহজ বাসযাত্রা আমরা কৃতিত্বের সঙ্গে গুবলেট করে ফেললাম। ভুল বাসে চড়ার মাশুল হিসেবে এক স্টেশনে বসে ঠিক বাসের জন্য অপেক্ষায় কেটে গেল ঘণ্টাখানেক। ভোগান্তি পর্ব দুই পর্যন্ত গড়াত যদি না হাদী ভাই তার স্বল্প ইতালীয় বিদ্যার জোরে আধবোজা চোখে ঝিমোতে থাকা বাসচালকদের মারফত বাসের নম্বরটা জেনে না আসত। অল্প বিদ্যা এখানে ভয়ংকর হয়নি। বরং তাক লেগে গেল এটা দেখে যে, একটা ভাষার শুধু সংখ্যাজ্ঞান থাকলেই ছোটখাটো বিপদ-আপদ এড়ানো যায় কত সহজেই।

অবশেষে পৌঁছালাম। টিকিটের সঙ্গে সঙ্গে স্যুভেনির শপ-কাম-ক্যাফে থেকে দুপুরের খাবার হিসেবে কয়েক টুকরা পিৎজা কিনে নিলাম। সুকান্তের কাছে ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় লাগলেও আমাদের কাছে খালি পেটে কাস্কাটা ডেল ভারোনের অনিন্দ্যসুন্দর ঝরনাধারা আবার ফুটো হয়ে যাওয়া ওয়াসার পাইপের পানির তোড়ের মতো লাগতে পারে। তাই পেটপূজার এই আগাম ব্যবস্থা। পা বাড়িয়েছি আর চোখে পড়ল, দোকানের সামনে বর্ষাতি সাজিয়ে রাখা। ঝরনার কাছে গেলে পানির ঝাপটায় ভেজার হাত থেকে বাঁচার জন্য। এই জিনিস পাই পাই গুনে পয়সা খরচ করা জার্মানরা কেউ কিনবে না। জার্মান মুলুকে থেকে আর তাদের স্বভাবের বাতাস গায়ে লেগে হাতখরুচে বাঙাল আমরাও কিপটে হয়ে গেছি। তাই বর্ষাতিগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সামনে এগোতে বাঁধল না।

ঝরনার পথটা বাগানের ভেতর দিয়ে চলে গেছে। বোটানিক্যাল গার্ডেন একটা। সব গাছের নামধাম, গোত্র-বংশ গাছের গায়ে সাঁটা রয়েছে। বাগানটা একই সঙ্গে একটা zen garden-ও বটে। জেন গার্ডেন আসলে প্রকৃতির আদল ধরতে চেয়ে বাগান করার একটা জাপানি বুদ্ধি বলা যেতে পারে। zen বা জেন কথাটা নাকি চায়নিজ শব্দ থেকে এসেছে। আর সেই চায়নিজ শব্দ আবার এসেছে সংস্কৃত ‘ধ্যান’ থেকে। খেয়াল করে দেখলাম কথা সত্য। কেমন শান্তি শান্তি ভাব ছড়িয়ে আছে চারপাশটায়। দুপাশে সুশৃঙ্খলভাবে সাজিয়ে রাখা পাথরগুলো পাহাড়-পর্বতের প্রতীক। মাঝের নুড়িপাথরের পথটুকু যেন বয়ে চলা খরস্রোতা নদী। আর সারি সারি গাছগাছালি যেন প্রকৃতির রক্ষাকবচ হয়ে অতন্দ্রপ্রহরীর মতো সটান দাঁড়ানো জওয়ানের দল। জেন বাগানের এই প্রতীকী রহস্যের কথা আমার নিরেট মাথায় খেলার কথার না। তথ্যগুলো পথ চলতে চলতে মারাত্মক বই পড়ুয়া হাদী ভাই পেশাদার ট্যুরিস্ট গাইডের মতো করে বলছিলেন দেখে জানলাম। নইলে আলাদা করে এর সৌন্দর্য সাদা চোখে ধরা পড়ত না। কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝলাম না। বাগানের ধ্যানমগ্ন আবেশ ভেঙে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা স্পিকার থেকে এলভিস প্রিসলির গান ভেসে আসছে। এমন গুরুগম্ভীর পরিবেশে টুংটাং পুংপাং জেন সংগীত মানে ধ্যান সংগীত আশা করছিলাম। তবে, এলভিসের হার্টব্রেক হোটেল লাগছে মন্দ না। পুংপাংয়ের চেয়ে উত্তম।

সান্তা বারবারা চ্যাপেল থেকে রিভা শহর
সান্তা বারবারা চ্যাপেল থেকে রিভা শহর

প্রচণ্ড ঝমঝম ঝংকারে বুঝলাম ঝরনার কাছে চলে এসেছি। এই ঝরনা এসেছে গার্দা হ্রদ থেকে নয়, বরং আরেকটা হ্রদ, নাম যার, লাগো ডি টেনো বা Lake of Tenno-সেখান থেকে। পানির ঝাপটা উপেক্ষা করে সবাই যত দূর কাছে যাওয়া যায় গেল। শুধু আমি দূর থেকে ঝরনা দেখলাম। সৌন্দর্য কাছ থেকে দেখার চেয়ে সামান্য তফাতে থেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতেই ভালো লাগে কারও কারও। খুব কায়দা করে নিচ থেকে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। উজ্জ্বল নীল আলোয় নেমে আসা ঝরনাটাকে বুনো ময়ূরের ময়ূরকণ্ঠী নীল পেখম বলে ভুল হচ্ছে। তার চেয়েও চমৎকার লাগল, শত বর্ষের অবিরাম ধারা কীভাবে পাষাণের নিশ্ছিদ্র হৃদয় গলে আপন সুড়ঙ্গ খুঁড়ে বয়ে গেছে। সাধনা থাকলে অসাধ্যও মুঠোয় এসে ধরা দেয় একদিন। রবার্ট ব্রুসের মাকড়সার কথা মনে পড়ে গেল। সাতবারের বার সে বেচারা কার্নিশের এক ঝুল থেকে আরেক ঝুলে যেতে পেরেছিল। ঠিক করলাম, ভারোনের এই ঝরনা কিংবা ব্রুস সাহেবের মাকড়সা-জীবনে এ দুটোর একটা হতে হবে। হতাশাগুলো এক ফুঁ দিয়ে না পারি, সাত ফুঁয়ে ধুলোর মতো উড়িয়ে দিতে হবে। তাতেও কাজ না হলে আজীবন হতাশার গায়ে শকুনে ঠোকর মেরে যাব। টেনো লেকের ঝরনার মতো।

পায়ে-পায়ে ফিরে এলাম ফিরতি পথে। বাসে ওঠার আগে ঢুকে পড়লাম ছিমছাম একটা ক্যাফেতে। ভেতরটা তত ছিমছাম লাগল না। দরজায় প্রমাণ সাইজ মদের পিপে আমাদের অভ্যর্থনা জানাল। দেয়ালের ঢাল-তলোয়ার তাদের শান শওকতের ঝিলিকে চোখ ধাঁধিয়ে দিল। এই জলদস্যুর জাহাজের খোলের ভেতর কফি খাব কী করে ভাবছি। হাতের কবজিতে ভয়ংকর উলকি আঁকা অথচ ভীষণ বিনয়ী সুদর্শন ওয়েটার জানতে চাইল কী খাব। ইতস্তত করে কেউ হট চকলেট, কেউ কেক-কফির জন্য বলে এসে বসেছি ফায়ার প্লেসের আড়াআড়ি রাখা মখমলের গদি আটা পুরু সোফাটায়। অভিজাত ইতালিয়ান বিলাস আর কাকে বলে। এমন মজার জায়গা পেয়ে সঙ্গের শিশুরা মেঝেতে গড়াগড়ি শুরু করেছে। গড়াগড়ির চোটে কাঠের তকতকে মেঝে আরও আয়নার মতো মসৃণ হয়ে উঠছে। তাদের বাধা না দিয়ে প্রায় গলে পড়া চকলেট কেকের টুকরোয় লোলুপ চামচ বসালাম।

চার.

আজকে যাব মালচাসিনে। শুনেছি গার্দা হ্রদের পুব পাড়ের মালচাসিনে এককালে ছিল ঘটনাবিহীন ঘুম ঘুম নিরুপদ্রব জেলেপল্লি। কালের পরিক্রমায় সাধারণ জেলে পাড়া থেকে তার প্রমোশন হয়েছে। কারণ আর কিছুই না-পর্যটন। গার্দা হ্রদের সবচেয়ে উঁচু চূড়া মন্টে বাল্ডোর রাজত্ব সেখানে। মন্টে বাল্ডো মানে দাঁড়ায় টেকো পর্বত। চূড়ার মাথায় নাকি মুকুট হয়ে বসে আছে প্রাচীন এক দুর্গ। তো, এই টেকো রাজার মুকুট দর্শন আজকের দিনের প্রধান আকর্ষণ।

সোনালি সকালে গার্দা হ্রদ
সোনালি সকালে গার্দা হ্রদ

বাসের জন্য সবাই অপেক্ষায় আছি। বাসের দেখা নেই। ব্রিটিশ এক বুড়োবুড়ি অনেকক্ষণ প্রতীক্ষায় থেকে রণে ভঙ্গ দিয়ে ফিরে গেলেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটলেও আমরা হাল ছাড়লাম না। বরং স্কটিশ সেনাপতি রবার্ট ব্রুসের মাকড়সা হয়ে স্টপেজের পাশের পাঁচিলের ধারে ঝিমোতে থাকলাম। এই বাসটা এল না তো কী হয়েছে? পরেরটা নিশ্চয়ই আসবে। সময় কাটানোর জন্য হাদী ভাই নানান ফন্দি-ফিকিরে ব্যস্ত। আমাদের জনে জনে জিজ্ঞেস করছেন, ‘বড় হয়ে কী হতে চাই?’ দলের দুই শিশু সদস্য বাদে বাকিরা যে সব বড় হতে হতে প্রায় বুড়ো হওয়ার পথে, তাদেরই কিনা এই প্রশ্ন! তবে যেমন প্রশ্ন, তেমনই উত্তর। দারুণ সুরেলা কণ্ঠের মৌরি আপু বলল, সে গায়িকা হতে চায়। হতে চাওয়ার আবার কি আছে আমরা ঠিক বুঝলাম না। কারণ, এত চমৎকার রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারা লোক তো ইতিমধ্যেই গায়িকা হয়ে বসে আছেন। ওনার বলা উচিত, ‘নায়িকা হতে চাই। বাংলা সিনেমার চাকভুম চাকভুম নায়িকা।’ আর এদিকে আমি উদাস ভঙ্গিতে বললাম, ‘তিন বাচ্চার মা হতে চাই’। একটা তো আছেই। আরও গোটা দুই থাকলে জমত বেশ। মায়ের আরেক কাঠি সরেস দুই ফুটি ছেলে পাশ থেকে যোগ করে বসল, সে ভাইয়া হতে চায়। তার মুখে দুষ্টু হাসি। এহেন বে-আক্কেল চাওয়া-পাওয়ার বহর দেখে ছেলের বাপের আক্কেলগুড়ুম। আরও কতগুলো নতুন লোকের স্থান সংকুলানের জন্য উচ্চ ভাড়ার একটা ভালোবাসার দুশ্চিন্তায় স্ত্রী-পুত্রের প্রতি ভালোবাসা উবে গিয়ে শরৎ চন্দ্রের স্কেপিস্ট নায়কদের মতো ‘তাহার মুখ দপ করিয়া জ্বলিয়া উঠিয়াই যেন নিমেষে ছাই হইয়া নিভিয়া গেল।’ রুমির আমচু চেহারা দেখে আমরা হেসে লুটিয়ে পড়লাম।

বাস আসছে না। চিন্তার ব্যাপার। কিন্তু তার থেকেও চিন্তার বিষয়, খিদে পাওয়া শুরু হয়েছে। তার প্রমাণ-বড় হয়ে কী হতে চাই থেকে প্রসঙ্গ পাল্টে আলোচনাটা খাদ্যবিষয়ক হয়ে গেছে এক ফাঁকে। খাদ্যের নাম ডিমের বিরিয়ানি। এক ডজন সেদ্ধ ডিম, এক কেজি চাল, গোটা দুই নধর আলু, গরম মসলা আর আধা লিটার দুধ হলেই হবে। সঙ্গে প্রচুর বেরেস্তা করা পেঁয়াজ। হাত নেড়ে, মাথা দুলিয়ে এমনভাবে রেসিপি বলছি যেন এখনই জলপাই গাছের পাতা কুড়িয়ে পথের ধারে লাকড়ির চুলা পেতে ডিমের বিরিয়ানি রাঁধতে বসে যাব। সবাই যখন কাল্পনিক ডিমের বিরিয়ানির অস্তিত্ব মেনে নিয়ে তার মৌ মৌ ঘ্রাণের হ্যালুসিনেশনে ভাসছি, ঠিক তখনই আমাদের ভেতর বাস্তববাদী একজনের মাথায় দারুণ বুদ্ধি খেলে গেল। বাসের অপেক্ষায় আর হাঁ করে না থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে নেই না কেন। ঘুরতে এসে এত হ্যাপা সয় না। কল্পনার বুদ্‌বুদ সুচের খোঁচায় নাই করে দিয়ে সবাই তাতে সায় দিলাম।

ট্যাক্সি মিলল। পাহাড়ি উঁচু নিচু ঢালু পথে দুর্ধর্ষ ইতালিয়ান চালক তার পঙ্খিরাজটা ফর্মুলা ওয়ানের মাইকেল শুমাখারের মতো উড়িয়ে দশ মিনিটের মাথায় আমাদের মন্টে বাল্ডোতে নিয়ে এল। মাথার ওপর মাঝদুপুরের অবারিত আকাশ। তাতে টুকরো টুকরো সাদা মেঘ নিরুদ্দেশের ভেলা ভাসিয়েছে। নীল আকাশের নিচে আমরাও বেরিয়েছি আজকে নিরুদ্দেশ হব বলে। এখান থেকে পায়ে হেঁটে অনেকখানি উঠলে পরে পাহাড়চূড়ায় দেখা মিলবে স্কালিজার দুর্গের। ইতালিয়ান উচ্চারণে কাস্তেলো স্কালিজিরো (Castello Scaligero)। দুর্গের ভেতরে আছে গার্দা লেকের ন্যাচারাল হিস্ট্রি জাদুঘরটা। দেখার খুব শখ। অনেক পুরোনো জিনিসের বিশাল সংগ্রহ। এক ঢিলে দুই পাখি হয়ে যাবে।

সিঁড়ি কাটা পাথুরে পথ। বাচ্চারা লাফিয়ে লাফিয়ে ডিঙ্গোচ্ছে। সবাই এগিয়ে যাচ্ছে। আমি কাশি বিরতি নিয়ে খাবি খেতে খেতে আধ মাতালের মতো টালমাটাল গতিতে দলটার পিছু পিছু চলছি। দুই পাশে নাম না জানা বুনো ফল থোক বেঁধে ঝুলছে। রঙিন ফলের হাতছানিতে নিষিদ্ধ মাদকতা।

অবশেষে পায়ে হাঁটার ক্লান্তি ভুলিয়ে পাহাড়চূড়ায় শ্বেতপাথরে গড়া মধ্যযুগীয় স্কালিজার দুর্গ উঁকি দিল। তেরো শ শতকের গরিমা তার ম্লান তো হয়ইনি, বরং প্রাচীন আভিজাত্য ঠিকরে পড়ছে সূর্যের প্রখর আলোয়। তেরো আর চৌদ্দ শতকে ডেল্লা স্কালা পরিবার শাসন করেছে ভারোনে অঞ্চলটা। তাদেরই নামে নাম এই স্কালিজার দুর্গ প্রাসাদের। আস্তে আস্তে এগোলাম প্রবেশদ্বার বরাবর। টিকিট কাটতে হবে। দুর্গের একটা একত্রিশ মিটার উঁচু মিনার আছে। সেখান থেকে নিচে তাকালে কী যে অসাধারণ লাগবে, ভাবতেই শিহরণ জাগছে।

কিন্তু কপালের নাম গোপাল প্রমাণ করে দিয়ে টিকিট বাক্সের লোক জানাল আজকে চব্বিশে ডিসেম্বর বেলা দুইটার পর থেকে দুর্গের ঝাঁপি বন্ধ দর্শনার্থীদের জন্য। হাতঘড়িতে বাজে এখন দুপুর দেড়টা। ভেতরে আর ঢোকা যাবে না এত দেরিতে। কিন্তু যদি চাই, এই আধা ঘণ্টায় দুর্গের সামনের উঠোনে ঘুরে আসতে পারি। কী আর করা! অগত্যা নাই মামার বদলে কানা মামাকেই মামা ডাকলাম। উঠানের মাঠে গিয়ে দেখি, এই বা কম কোথায়। এই চূড়া থেকে পুরো মালচাসিনে দেখা যাচ্ছে। ছোট ছোট বাড়িঘর পাহাড়ের পায়ের কাছে মাদুর বিছিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ঠিক যেন ছিঁড়ে যাওয়া পুঁতির মালার মতো। স্কালিজারের ভেতরটা ঘুরে দেখতে না পাওয়ার আফসোস কমে এল। প্রকৃতির অপরূপ দম্ভের কাছে মানুষের জোড়া দেওয়া পাথুরে স্তম্ভের আস্ফালন চিরকালই তুচ্ছ ঠেকে।

গার্দা লেক
গার্দা লেক

ফিরতি পথে টিকিটের লোকটা জানতে চাইল, আমরা একা একা অচেনা পথে নামতে পারব তো? আগের পথে গেলে গাড়ি মিলবে না, তাই। চাইলে সে আমাদের সঙ্গে যেতে পারে। তারও গন্তব্য একই দিকে। আমরা রাজি হয়ে গেলাম। ছানাপোনা হাতে ঝুলিয়ে চললাম জাতে আলজেরীয় লোকটার দেখানো পথ ধরে। কত সহজেই না অন্ধবিশ্বাস‌‌ে ভিনদেশের অচেনা লোকের পিছু নিলাম। পৃথিবীর পথে একবার বেরিয়ে পড়লে বোধ হয় মানুষের ওপর বিশ্বাস জন্মানোটা খুব সহজাত একটা ব্যাপারে দাঁড়ায়। ফুলেল বুনো পথ মাড়িয়ে নিরুদ্দেশ থেকে উদ্দেশের হদিসে চলতে লাগলাম নিশ্চিন্তে।

পাঁচ.

স্কালিজার প্রাসাদ যেমন দেখা হলো না, তেমনি অদেখা রয়ে গেল ডি আনুজ্জিওর জাদুঘর ভিত্তোরিয়ালে। ইতালির ইতিহাসের বিচিত্র চরিত্র গ্যাব্রিয়েল ডি আনুজ্জিও। বিখ্যাত এই কবি একসময়ে ঋণের ভারে ফ্রান্সে পাড়ি দেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসে বটে। কিন্তু এসেই কবিতার খাতা হেলায় ফেলে বিমান উড়িয়ে যুদ্ধে নেমে পড়ে। মাত্র তিন শ যোদ্ধা নিয়ে ফিউমে অঞ্চল (বর্তমানের ক্রোয়েশিয়ায় পড়েছে) এক বছর অবরোধ করে রীতিমতো স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বসে আনুজ্জিও। সেখানেও খ্যাপামির পরিচয় মেলে। সৈনিক কবির একনায়ক রাষ্ট্রে সংবিধানের মূলনীতি ছিল সংগীত! কিন্তু দখল নেওয়ার এই মানসিকতা দেখে ফ্যাসিজমের বীজ ঢুকে যায় মুসোলিনি আর হিটলারের মাথায়। তারপর দুনিয়াজুড়ে শুরু হয় ফ্যাসিবাদের ফ্যাসাদ। যা হোক, যুদ্ধে এক চোখ খুইয়ে ফিরে এসে জীবনের শেষ সতেরো বছর গার্দা লেকের পাড়েই কেটেছে আনুজ্জিওর। আলোয়-কালোয় মেশানো খামখেয়ালি লোকটার বিচিত্র সংগ্রহে ঠাসা বাড়িটাই এখন জাদুঘর। আবার সুযোগ হলে যাওয়াটা অবশ্যকর্তব্যের ভেতর পড়ে।

সব শুরুরই শেষ থাকে। সেই নিয়ম মেনে আজকে বাড়ি ফিরে যাব। দুপুরের ট্রেনে চেপে। কিন্তু সকালটাকেই বা বিকিয়ে দিই কী বলে? তাই গুটি গুটি পায়ে সবাই এসে দাঁড়িয়েছি গার্দার তীরে। সোনারঙা রোদের ঝিলিকে খোলামকুচির মতো পড়ে থাকা নুড়িপাথরগুলো মণি মুক্তা বলে বিভ্রম হয়। আর কূল ভাসানো গহিন নীল জল দেখে মন ভাবতে চায় এ যেন সাগর পাড়। কিন্তু ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ার তাড়া নেই। অলস রাজহাঁস জলকেলির খুনসুটিতে ব্যস্ত। দূরে পটে আঁকা ছবির মতো এক–দুইটা নৌকার আনাগোনা। জলে ভাসা এক নন্দনকানন। কে বলবে আমরা সমুদ্রের পিঠ থেকে ৬৫ মিটার উঁচুতে বসে আছি?

বড় বড় পাথুরে চাঁইয়ে বসে ভাবছি, আমরা নিজেরাই তো একেকজন হ্রদের মতো। কোথাকার বঙ্গোপসাগরের জল গড়িয়ে গড়িয়ে ভাগ্যের খুঁড়ে দেওয়া পথ বেয়ে ভিনদেশের বদ্ধ জলাশয়ে আটকে গেছি। সাগরের মতো মহাসাগরের সঙ্গে আর যোগ নেই। তাই জোয়ার ভাটায় বয়ে চলার স্বাধীনতাও নেই।

গাঢ় ভাবনাটাকে জোর করে সরিয়ে দিলাম। তিন দিকে পাহাড়ের প্রহরী সবুজের হাতছানিতে ডাকছে। পাহাড়ের গায়ে সান্তা বারবারা নামের ছোট একটা চ্যাপেল আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে গড়া। জলবিদ্যুতের স্থাপনা বানাতে গিয়ে ধর্ম ভীরু খনি শ্রমিকেরা নিজেরাই হাত লাগিয়ে চ্যাপেলটা বানিয়েছিল। সেটা দেখার আর সময় হলো না এবার। তাকে এমনি এমনি দেখা যায় না। জয় করে দেখতে হয়। হেঁটে কী দৌড়ে পেশিতে টান ধরিয়ে তবেই তাকে জয় করা যায়। অসাধারণ হাইকিং ট্রেইল আছে ওপরে ওঠার। হাদী ভাই এক দৌড়ে দেখে এসেছিল। আমি সে চেষ্টা করতে গেলে দেখা যেত ফুসফুসটা পাঁজর ফুঁড়ে বেরিয়ে চার হাতে পায়ে দুড়দাড় করে পালাচ্ছে। অগত্যা নিচ থেকে সান্তা বারবারাকে শ্বেত পায়রার মতো চুপ করে আলপসের কোলে আদুরে ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে দুধের সাধ ঘোলে মিটাতে হলো।

লেখিকা ও তাঁর সঙ্গীরা
লেখিকা ও তাঁর সঙ্গীরা

মোটের ওপর এই ভ্রমণে আমরা ছেলে–বুড়ো বারো আনার ওপরে ষোলো আনা খুশি। আনা-আধুলির কথা বলতে গিয়ে আরেক আনার কথা মনে পড়ছে। জার্মান বান্ধবী আনা। সে প্রায়ই খোঁচা মেরে জিজ্ঞেস করে, ‘শনি-রবি কি করলে?’ কী করে বলি যে চাক্ চাক্ করে আলু কেটে চায়নিজ দোকানের কই মাছ ঝোল করে রেঁধেছি কিংবা তুর্কি দোকানের হালাল মুরগি টমেটো দিয়ে ভুনা করেছি? যেখানে আনার সপ্তাহান্ত কাটে অস্ট্রিয়ার বরফে স্কি করে কিংবা আলপসের কোথাও হাইকিংয়ে, সেখানে ছুটির দিনগুলোতে আমি মাছ-মুরগির সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে কাটিয়ে দিই। দুর্দশা দেখে ছুরির নিচে আলু-টমেটোরাও মুখ টিপে হাসে। কী বিচিত্র জটিল বাঙালি জীবন! তবে এই কটা দিনের ঘুরে বেড়ানো সেই দুঃখ খানিকটা ভুলিয়ে দিয়েছে। যাক, এবার ফিরে গিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে এমন গপ্প করব যে জার্মান বান্ধবীর চোখ ট্যাঁ হয়ে যাবে।

ঘড়ির কাঁটা বেরসিকের মতো সময়ের চাবুক মারল পিঠে। ফিরে যেতে হবে ফেলে আসা কুয়াশায় ঢাকা শীতের শহরে। আমাদের ইবনে বতুতাগিরির এখানেই সমাপ্তি। তবে আনন্দের রেশ রয়ে যাবে অনেক দিন। দিন শেষে স্মৃতিটুকুই অমূল্য। আর বাকি সব জাগতিক বস্তুর মামুলি হিসাব কষা দর আছে। তাই শেষবারের মতো শান্ত হ্রদের স্নিগ্ধ শহরের স্মৃতি যতটুকু পারি হাতের আঁজলায় তুলে নিলাম। যাযাবর মনের মুকুরে যোগ হলো আরেকটা পোস্টকার্ড।
...

ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: গবেষক ইনস্টিটিউট অব প্যাথোলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি।

ছবি কৃতজ্ঞতা: হাদী ভাই।