নববর্ষ ও বর্ষপঞ্জি নিয়ে আলোচনা

পাঠশালার আসরে আলোচনা করছেন জামিল চৌধুরী
পাঠশালার আসরে আলোচনা করছেন জামিল চৌধুরী

কানাডার টরন্টোর বাংলাদেশি শিল্প-সাহিত্য অনুরাগীদের প্ল্যাটফর্ম পাঠশালার এবারের আসর অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলা নববর্ষ নিয়ে। আসরে ‘নববর্ষ ও বর্ষপঞ্জি’ নিয়ে আলোচনা করেন গ্রেগরিয়ান ও বাংলা ক্যালেন্ডারের সমন্বয়ক জামিল চৌধুরী। তিনি দুই ক্যালেন্ডারেরই বিবর্তনের ইতিহাস বিস্তৃতভাবে তুলে ধরেন। আলোচনা সঞ্চালনা করেন ফারহানা আজিম শিউলী। উল্লেখ্য, পাঠশালার এবারের আসর ছিল দ্বাদশ আসর।

১৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার এগলিন্টন স্কয়ারের টরন্টো পাবলিক লাইব্রেরিতে এ আসর আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতেই ‘এসো হে বৈশাখ’ গেয়ে বাংলা নতুন বছরকে আবাহন করা হয়।

আলোচনায় জামিল চৌধুরী বলেন, মানুষ সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে জীবনযাপন শুরু করার আগ থেকেই, গুহামানবদেরও একধরনের বর্ষপঞ্জি ছিল। কারণ সবারই আগাম ঋতু পরিবর্তন অর্থাৎ কখন বর্ষাকাল, কখন শীতকাল, কখন বীজ বপন, কখন ফসল তোলা, এসব জানা দরকার ছিল।

আসর সঞ্চালনা করেন ফারহানা আজিম শিউলী
আসর সঞ্চালনা করেন ফারহানা আজিম শিউলী

তিনি বলেন, রোমের শাসক পম্পেরিয়াস খ্রিষ্টপূর্ব ৬৭৩ সালে প্রথম ৩৫৫ দিনের বারো মাসি ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেন। এর সঙ্গে অনিয়মিতভাবে দুই বছর পরপর ত্রয়োদশ মাস (২২ থেকে ২৩ দিন) যোগ করা হতো। তখন মার্চ ছিল বছরের প্রথম মাস ও ফেব্রুয়ারি ছিল বছরের শেষ মাস। সব মাস ছিল ২৯ দিনের। তৃতীয় (মে) ও পঞ্চম (জুলাই) মাস ছিল ৩১ দিনের এবং দ্বাদশ (ফেব্রুয়ারি) মাস ছিল ২৮ দিনের। তখন মাসের নাম ছিল না।

জামিল চৌধুরীর আলোচনা থেকে জানতে পারি, রোম সম্রাট জুলিয়াস সিজারের মিসর জয়কালে, মিসরীয় জ্যোতির্বিদ সোসিজেন তাঁকে পরামর্শ দেন, ৩৬৫ দিনে বছর এবং চার বছর পরপর এক দিন বাড়িয়ে অধিবর্ষ বা লিপ ইয়ার করার। সম্রাটের উপদেষ্টারা বলেন, মকরসংক্রান্তির দিন অর্থাৎ দশম মাসের (ডিসেম্বর) ২৫ তারিখ থেকে নতুন বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করা হোক। জুলিয়াস সিজার তা-ই করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দেখেন, একাদশ মাসের (জানুয়ারি) প্রথম দিন অমাবস্যা পড়ছে। তখন অমাবস্যাকে সৌভাগ্যের লক্ষণ বলে মনে করা হতো। কাজেই তখন তিনি একাদশ মাসের প্রথম দিন থেকে নতুন বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। প্রবর্তকের নামে ক্যালেন্ডারকে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার বলা হতো তখন থেকেই। তাঁর সম্মানে পরিবর্তিত বর্ষপঞ্জির সপ্তম মাস জুলাই নামে এবং পরে সম্রাট অগাস্টাসের নামে অষ্টম মাসকে অগাস্ট নামে অভিহিত করা হয়। জুলিয়ান ক্যালেন্ডারটাই আমরা এখনো ব্যবহার করছি। পরে রোম সম্রাট গ্রেগরির নামানুসারে ক্যালেন্ডারের নাম হয় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার।

জামিল চৌধুরী বলেন, ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে ত্রয়োদশ পোপ গ্রেগরি লক্ষ করেন, গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি প্রতি ১০০ বছরে তিন দিন করে মোট ১০ দিন পিছিয়ে গেছে। এই ভ্রম সংশোধনের জন্য তিনি গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি থেকে ১০ দিন কেটে নিয়ে, ১৫৮২ সালের ৫ অক্টোবরকে ১৫ অক্টোবর ঘোষণা করেন। তখন থেকে নিয়ম হয় কোনো সাল চার দিয়ে বিভাজ্য হলে তবেই অধিবর্ষ বা লিপ ইয়ার হবে। তবে কোনো সালের শেষ দুটি সংখ্যা যদি শূন্য হয়, সে ক্ষেত্রে কেবল ৪০০ দিয়ে বিভাজ্য হলে অধিবর্ষ হবে। এই নিয়মে ২০০০ সাল অধিবর্ষ কিন্তু ২১০০ সাল নয়।

আসরে উপস্থিতির একাংশ
আসরে উপস্থিতির একাংশ

বাংলা ক্যালেন্ডারের বিবর্তনের ইতিবৃত্ত বলতে গিয়ে তিনি বলেন, সম্রাট আকবরের শাসনকালে হিজরি সন অনুসরণ করা হতো। কিন্তু ঋতুচক্রের সঙ্গে হিজরি সালের কোনো সামঞ্জস্য না থাকায় ভূমিকর আদায়ের সুবিধার্থে তিনি ৯৬৩ হিজরি অব্দকে সৌর অব্দে পরিণত করেন। সেটিই বঙ্গদেশ অর্থাৎ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে বাংলা বর্ষপঞ্জি বলে পরিগণিত।

জামিল চৌধুরীর আলোচনায় আমরা আরও জানতে পারি, এই ক্যালেন্ডারে কখনো ১৪ এপ্রিল আবার কখনো ১৫ এপ্রিল নববর্ষ হিসেবে গণ্য করা হতো। গত শতাব্দীর নয়ের দশকে বাংলা একাডেমি প্রচলিত বঙ্গাব্দের সামান্য পরিবর্তন করে ১৪ এপ্রিলকে বাংলা বছরের প্রথম দিন স্থির করে। এর ফলে দুটো বিষয় ঘটে। আমাদের জাতীয় জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ দিন ২১ ফেব্রুয়ারি ও ১৬ ডিসেম্বর। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল ৮ ফাল্গুন এবং ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর ছিল পয়লা পৌষ। বাংলা একাডেমির এই পরিবর্তনের ফলে ২১ ফেব্রুয়ারির প্রতিসঙ্গী অর্থাৎ বাংলা তারিখ হয়ে যায় ৯ ফাল্গুন আর ১৬ ডিসেম্বরের প্রতিসঙ্গী তারিখ হয়ে যায় ২ পৌষ। এই তারিখগুলো ফিরিয়ে আনার জন্য বাংলা একাডেমি ২০১৬ সালে প্রস্তাব করে-আশ্বিন মাস ৩০ দিনের পরিবর্তে ৩১ দিন ও ফাল্গুন মাস ৩০ দিনের পরিবর্তে ২৯ দিন (এবং অধিবর্ষে ৩০ দিন) করা হলে ২১ ফেব্রুয়ারি ও ১৬ ডিসেম্বর আবার যথাক্রমে ৮ ফাল্গুন ও ১ পৌষে ফিরে আসবে। ২০১৮ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশ সরকার এই প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং ২০১৯ অর্থাৎ এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এটি প্রবর্তন করা হয়।

মূল আলোচনা শেষে এক প্রাণবন্ত ও তথ্যবহুল প্রশ্নোত্তর পর্বে মিলিত হন জামিল চৌধুরী। বর্ষপঞ্জি সমন্বয়ক, বাংলা অভিধান প্রণেতা ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম মহাপরিচালক জামিল চৌধুরীর বর্ষপঞ্জি–বিষয়ক অতি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা গভীর মনোযোগে শ্রবণ করেন পাঠশালার অংশগ্রহণকারীরা।