বাতিঘরের আলোয় একটা দিন

জাফর ইকবালের অটোগ্রাফ নিচ্ছেন লেখক ও তাঁর মেয়ে
জাফর ইকবালের অটোগ্রাফ নিচ্ছেন লেখক ও তাঁর মেয়ে

ঢাকায় থাকাকালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় আমি সাধারণত সর্বসাকল্যে দুই বা তিন দিন যেতাম। বইমেলা শুরু হলে পত্রিকা দেখে বইয়ের একটা তালিকা তৈরি করতাম। তারপর মেলার মাঝামাঝি সেই তালিকা ধরে নির্দিষ্ট স্টলে গিয়ে বই কিনতাম। এমনই একবারের মেলায় বই কেনা শেষ করে বের হয়ে আসছি। সন্ধ্যা সমাগত। হঠাৎ দেখলাম একটা গাছের তলায় বেশ কয়েকজন শিশু–কিশোর জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি সাধারণত যেকোনো ধরনের জটলা দেখলে কেটে পড়ি। কিন্তু সেদিন জটলাটার দিকে এগিয়ে গেলাম। কারণ, জটলাকারী সবাই বয়সে শিশু অথবা কিশোর। জটলার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলাম একজন হাঁটু মুড়ে বসে সেই শিশু–কিশোরদের বইয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। তার পাশে এক কিশোরীও হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটি অটোগ্রাফ দেওয়া শেষ করে যেই মুখটা ওপরের দিকে তুলেছেন, আমার সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। কারণ, আমার হাতভর্তি তাঁরই বই। আমি পিছিয়ে এসে শিশু–কিশোরদের লাইনের পেছনে দাঁড়িয়ে গেলাম।

অপেক্ষার সময়টুকু বিভিন্ন রকমের কল্পনায় অতি দ্রুত কেটে গেল। তারপর একসময় তাঁর কাছাকাছি চলে এলাম। তাঁর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য। আমার দিকে তাকিয়ে তিনি নাম জানতে চাইলেন। আমি তখন ভেতরে–ভেতরে একটা বড় রকমের ধাক্কা খেলাম। এমন পরিষ্কার ও অন্তর্ভেদী দৃষ্টিশক্তির মানুষ জীবনে সেই প্রথম দেখলাম। তাঁর দৃষ্টি দেখেই বুঝলাম উনি আমার মনের ভেতরটাও পড়তে পারছেন। বাতিঘরের আলোয় যেমন সবকিছু দেখা যায় ঠিক তেমনি তাঁর দৃষ্টিতে আমার অন্তরটা তখন সত্যিকারের আলোকিত হলো। অবশ্য এর অনেক আগে থেকে এই আলোকিত হওয়ার প্রক্রিয়াটা আমার মধ্যে শুরু হয়েছিল। কিন্তু সামনাসামনি দেখা হওয়ার অভিজ্ঞতার কোনো তুলনা নেই। তাঁর অটোগ্রাফ নেওয়া শেষ করে পাশে দাঁড়ানো কিশোরীর দিকে অন্য একটা বই এগিয়ে দিলাম। কারণ, তাঁর বই পড়ে তাঁর পরিবারের সবাই আমার চেনা। কিশোরী শুরুতে ইতস্তত করলেও তাঁর পরামর্শে অটোগ্রাফ দিতে রাজি হলো। এই ছিল বাতিঘরের সঙ্গে প্রথম সামনাসামনি দেখা হওয়ার অভিজ্ঞতা।

এখন বেশ কয়েক বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বসবাস করছি। একুশে বইমেলা আসে, চলে যায়। কিন্তু আমার আর বইমেলায় যাওয়া হয় না। সেটার অভাব পূরণ করি বইয়ের অনলাইন দোকানগুলোর মাধ্যমে আর সিডনির বাংলাদেশিদের দোকানগুলো থেকে বই কিনে। দেশ থেকে সাতসমুদ্র তেরো নদীর দূরত্বে থেকেও বাতিঘরের সব বই আমার পড়া হয়ে গেছে। ঠিক সেই একই রকম আবেদন নিয়ে এখনো তাঁর বইগুলো পড়ি। অন্য বই কখনোই একবারে শেষ করতে পারি না। কিন্তু তাঁর বই একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না করে ছাড়ি না।

এর মধ্যেই হঠাৎ একদিন বাতিঘরের ওপর হামলার খবর পেলাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তারপর শুরু হলো সীমাহীন উৎকণ্ঠা। মনে হচ্ছিল একেকটা দিন যেন একেকটা বছর। ক্যাম্পাসের এক জুনিয়র সঞ্জীব সূর্যের মাধ্যমে তাঁর সার্বিক অবস্থার আপডেট নিচ্ছিলাম ঘণ্টায় ঘণ্টায়। যত দিন তিনি হাসপাতালে ছিলেন প্রতিটা দিন ছিল ভয়ংকর রকমের মন খারাপ করা। তারপর তিনি একসময় হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে চলে গিয়েছিলেন তাঁর প্রাণপ্রিয় ক্যাম্পাসে। সেখানে তিনি ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে যে বক্তব্য দিলেন সেটা সরাসরি দেখলাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে। সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসা একজন মানুষ কীভাবে অবলীলায় এমন কথা বলতে পারেন, সেটা ভেবেই অবাক হচ্ছিলাম আর নিজের অজান্তেই দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তী প্রজন্মকে একাই আলোকিত করে গেছেন স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি তাদের তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুঝিয়েছেন। বুঝিয়েছেন কেন মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। আবার তিনি এটাও বলছেন, আমাদের প্রজন্ম চাইলেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী হতে পারবেন কিন্তু কখনোই একজন মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবেন না। তাই মনের মধ্যে কিছুটা আফসোসও কাজ করে সব সময়। পাশাপাশি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন বাংলাদেশের শিক্ষার মান, শিক্ষানীতি ও বিভিন্ন প্রকারের অলিম্পিয়াড নিয়ে। আসলে তাঁর ঠিক কোন কাজটা ছেড়ে কোন কাজটার কথা বলব। কারণ, তালিকাটা আসলেই অনেক দীর্ঘ।

সিডনিতে শিশু-কিশোরদের সঙ্গে জাফর ইকবাল
সিডনিতে শিশু-কিশোরদের সঙ্গে জাফর ইকবাল

বাতিঘরের সঙ্গে আমার পরিচয় আমার ছাত্রীদের মাধ্যমে। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে সবাই যখন ঢাকা চলে গেল আমি তখন সংগত কারণেই কুষ্টিয়া থেকে গেলাম। হাবিব ভাই বললেন, আমি একটা টিউশনি ঠিক করে দিচ্ছি। ছাত্রী তোমার এক ব্যাচ জুনিয়র। ওকে পড়ালে তোমার ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিও একই সঙ্গে নেওয়া হয়ে যাবে। ছাত্রীরা তিন বোন। তাদের বাবা-মা দুজনেই কলেজের শিক্ষক। মা শিরিন ম্যাডাম ছিলেন কুষ্টিয়া সরকারি গার্লস কলেজের জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক। একটু কড়া টাইপের ভাব ধরে থাকেন। কিন্তু ভেতরে–ভেতরে একজন চঞ্চল কিশোরীর মন তাঁর। আর বাবা আমার দেখা অন্যতম ভালো মানুষদের একজন। আমি পড়াতে গেলেই তিনি কিছু না কিছু একটা বানিয়ে এনে আমাকে খেতে দিতেন। আমরা ছিলাম তিন ভাই। তাই বোনদের জগৎ কেমন হয় সে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। তিন বোন স্বাতী, শুক্তি ও তৃণা সারাক্ষণই কোনো না কোনো অছিলায় চিৎকার–চেঁচামেচি করে সারা বাড়ি মাথায় তুলে রাখত। স্বাতী ও শুক্তি পিঠাপিঠি তবে তৃণা ওদের তুলনায় বেশ ছোট কিন্তু দুষ্টুমিতে সবার সেরা। সারা বাড়ি তিন কন্যা মিলে সারাক্ষণ দাপিয়ে বেড়াত। এমনও অনেক দিন হয়েছে আমার ছাত্রী স্বাতী পড়ার মাঝখানে উঠে গিয়ে অন্য দুজনকে কিল দিয়ে এসেছে।

ওরা তিন বোনই ছিল বইয়ের পোকা। ওদের কাছ থেকে সন্ধান পেলাম বাতিঘরের। যার বই আমার চিন্তার জগৎ আমূল পরিবর্তন করে দিল। তাঁর বই পড়েই প্রথম বুঝতে পারলাম দেশপ্রেম কোনো উদ্বায়ী পদার্থ নয়। এটা একটা অনুভূতি আর সেটাকে কাজে পরিণত করাটাই হচ্ছে জীবনের লক্ষ্য। দেশের এত এত সমস্যার মধ্যেও দেশটাকে নিয়ে ঠিক কীভাবে গর্ব করতে হয় সেটাও জানতে পারলাম। তিন বোনের কাছ থেকে ধার নিয়ে বাতিঘরের তখন পর্যন্ত প্রকাশিত সব বই পড়ে ফেললাম পাশাপাশি অন্য বইও ধার নিতাম। আমি একবার ওদের কোনো এক বোনের জন্মদিনে স্যারের একটা বই উপহার দিয়েছিলাম। বাতিঘরের লেখা প্রিয় গগন এবং অন্যান্য। বইটা পেয়ে ওরা বলল, স্যার, এটা তো তাঁর নিয়মিত বই না। এটা হচ্ছে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা তাঁর কলামের সংকলন।

বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পর আউট বই পড়ার অভ্যাস একেবারে পূর্ণতা পেল। বিভিন্ন বন্ধুর কাছ থেকে ধার নিয়ে, হলের লাইব্রেরি থেকে ধার নিয়ে আর ছাত্রছাত্রীদের বাসা থেকে ধার নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বই পড়া শুরু করলাম। সেখানেও অগ্রগামী ভূমিকা রাখল আমার ছাত্রীরা। তিথিরাও তিন বোন তিথি, তপা আর টুম্পা। ওরাও বাতিঘরের ভীষণ ভক্ত। ওদের কাছ থেকে ধার নিয়ে আবারও তাঁর বই পড়া শুরু করলাম। বুয়েটে আমার বালিশের তলায় সব সয়ই কোনো না কোনো গল্পের বই থাকত। ঘুমাতে যাওয়ার আগে গল্পের বইয়ের পাতা ওলটানো অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেল একসময়। সেই অভ্যাস এখনো ধরে রাখার চেষ্টায় আছি, যদিও ফেসবুক সেখানে ভাগ বসিয়েছে।

ইয়াসমীন হকের দেওয়া অটোগ্রাফ
ইয়াসমীন হকের দেওয়া অটোগ্রাফ

আগেই বলেছি, তাঁর লেখা থেকে তাঁর পরিবারের সব সদস্যের পরিচয়ও আমার জানা। তাঁর স্ত্রীও তাই চেনা। তাঁদের পরিচয় বিবাহ সব বিষয়ের কথাই জানা হয়ে গেছে তাঁর বই পড়ে। আমি বলি আসলে তাঁদের পুরো পরিবারটাই বাঙালি জাতির জন্য একটা বাতিঘর। যার শুরুটা হয়েছিল তাঁর বাবা–মায়ের হাত ধরে। তারপর বড় ভাইও ছিলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। আর ছোট ভাইও দেশের সেরা কার্টুনিস্ট, যাহোক তাঁর স্ত্রীও একসময় একটা বই লিখে ফেললেন, তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মময় জীবনের ঘটনাবলি নিয়ে। যার নাম সাস্টে ২২ বছর। আমি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সেটাও জোগাড় করে পড়ে ফেললাম। এরপর জীবন তার নিয়মেই চলে যাচ্ছে।

হঠাৎ একদিন খবর পেলাম তিনি ও তাঁর স্ত্রী আসছেন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবাসী প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের পুনর্মিলনীতে যোগদান করতে। তাই সাজ্জাদ ভাইকে বলে রাখলাম আমাকে যেন দুটো টিকিট দেওয়া হয়। আমি আর আমার মেয়ে তাহিয়া যাব। সাজ্জাদ ভাই বললেন, সমস্যা নেই। তাঁদের নিয়মিত অনুষ্ঠানের বাইরেও তাঁরা একটা অনুষ্ঠান করবেন সাধারণ মানুষের জন্য। আমি বললাম তাহলে তো খুবই ভালো হয়। তাহিয়া এখানে যেহেতু ইংরেজিতে পড়াশোনা করে তাই ওর জন্য স্যারের ইংরেজি অনুবাদ করা বই দেশ থেকে আনিয়েছিলাম মোনা ভাবিকে দিয়ে। বইটার নাম, রাশেদ মাই ফ্রেন্ড। অনুবাদ করেছেন তাঁর মেয়ে ইয়েশিম ইকবাল। বইটা পড়তে গিয়ে তাহিয়া মাঝেমধ্যেই খিলখিল করে হেসে উঠত। ঠিক যেমন ছোট বয়সে আমি তাঁর বই পড়তে গিয়ে হো হো করে হাসতাম। আর মা সন্দেহের দৃষ্টিতে জানতে চাইতেন হাসির কারণ কী? বইটা পড়া শেষ করে তাহিয়া বলল এটা অনেক ভালো বই। ওকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য আমি বললাম, তুমিও বড় হয়ে আমার প্রকাশিত বইগুলোর ইংরেজি অনুবাদ করবে ইয়েশিমের মতো। তাই তোমাকে বাংলা ভাষাটা ভালোমতো শিখতে হবে। কারণ, আমার লেখালেখির সবই বাংলাতে। সে সমঝদারের মতো মাথা নাড়ল। অবশ্য সে প্রতি রোববার ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুলে যায় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির শিক্ষা ও চর্চার জন্য।

পাশাপাশি ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুলে বাতিঘরকে আনার ব্যাপারে আশফাক ভাইও সাজ্জাদ ভাইয়ের সঙ্গে কথা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অবশেষে তাঁদের বাংলা স্কুলে আসার ব্যাপারটা নিশ্চিত হয় আগের দিন রাতে। তখন থেকেই মনের মধ্যে আবারও একধরনের অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করা শুরু করল। সেই কবে বইমেলাতে তাঁকে দেখেছিলাম এবার আবারও কাছ থেকে তাঁদের দেখতে পাব ভেবেই শিহরিত বোধ করছিলাম। অবশেষে ২৮ এপ্রিল তাঁরা বাংলা স্কুলে এলেন। আসার সময় সঙ্গে করে এনেছিলেন বাংলা স্কুলের সোনামণিদের জন্য এক গাদা বই। তাঁরা বললেন, তাঁদের জন্য নির্ধারিত ওজনের মধ্যে যতগুলো পেরেছেন বই নিয়ে এসেছেন। বাংলা স্কুলের খুদে সোনামণিদের উদ্দেশে তাঁরা কিছু কথা বললেন। আমি ব্যস্ততার কারণে তাঁদের দুজনের কারও কথা পুরোপুরি শুনতে পারিনি বলে মন খারাপ হচ্ছিল। পরে আমার মেয়ে তাহিয়ার কাছ থেকে শুনলাম তাঁরা ঠিক কী বলেছিলেন।

তাহিয়াকে রাতে জিজ্ঞেস করাতে সে বলল, বাবা, ম্যাডাম বলেছেন, তোমরা খুবই ভাগ্যবান। প্রবাসে বেড়ে উঠেও বাংলা ভাষা তোমরা শিক্ষা করতে পারছ। আমি কিন্তু পারিনি। আমার বাবার পোস্টিং ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানে আমার স্কুলে কোনো বাঙালি মেয়ে ছিল না। আমিই ছিলাম একমাত্র বাঙালি মেয়ে। তাই আমি না চাইলেও আমাকে উর্দু শিখতে হয়েছিল। আমার বাবা অনেক চেষ্টা করেও আমাদের বাংলা শেখানোর ব্যবস্থা করতে পারেননি। সেদিক দিয়ে তোমরা খুবই ভাগ্যবান কারণ বাংলা স্কুলের মতো প্রতিষ্ঠান তোমরা পেয়েছে বাংলা ভাষা শিক্ষা করার জন্য। আসলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। এরপর আমাদের ছেলেমেয়েরা যখন আমেরিকাতে জন্ম নিয়েছিল তখনো আমরা একটা বাংলা ভাষা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব অনুভব করেছিলাম। পরে অবশ্য দেশে ফিরে আসার পর আর সমস্যা হয়নি।

আর স্যার বলেছেন, আমি আমার বক্তব্য মোটেও দীর্ঘ করব না। কারণ, আমি তোমাদের মনের কথা বুঝতে পারি। আমি জানি দীর্ঘ সময় ধরে বক্তৃতা শুনতে তোমাদের মোটেও ভালো লাগে না। তার চেয়ে তোমাদের বেশি ভালো লাগে খেলাধুলা করতে। তোমরা জানো আমাদের ভাষাটা অনেক সুন্দর ও শক্তিশালী একটা ভাষা। যেমন ধরো আই লাভ ইউ মানে কী? তখন আমরা উত্তর দিয়েছি আমি তোমাকে ভালোবাসি। তখন তিনি বললেন, আমি তোমাকে ভালোবাসি এখানে মোট তিনটা শব্দ। যেগুলোকে মোট ছয়ভাবে সাজানো যায়। যেমন আমি ভালোবাসি তোমাকে, তোমাকে আমি ভালোবাসি, ভালোবাসি তোমাকে আমি। তুমি যেভাবেই শব্দগুলোকে বলো না কেন সেগুলো তোমার মনের ভাব প্রকাশ করতে সক্ষম। কিন্তু ইংরেজিটাকে যদি তুমি সামান্য একটু ওলটপালট করে বলো তাহলে কিন্তু কোনো অর্থই প্রকাশ করে না। যেমন আই ইউ লাভ বা ধরো ইউ আই লাভ। তাই তোমরা তোমাদের স্কুলের ইংরেজি ভাষাভাষী সহপাঠীদের বলতে পারো, শোন ভাই, তোমাদের ইংরেজি ভাষাটা বেশ দুর্বল, সেটা শক্তিশালী করার জন্য কিছু একটা করো। বলেই তিনি হাসি দিয়েছেন, সঙ্গে আমরা অনেক হেসেছি। আমি তখন মনে মনে ভেবে দেখলাম আসলেই তো তা–ই। আর আমরাই মনে হয় বিশ্বের বুকে একমাত্র জাতি যারা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেকেই স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনা করেছিলাম।

আমি এবার আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম স্যার আর ম্যাডামের কাছ থেকে অটোগ্রাফ নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো কিছু করব না। বরং যতটুকু পারি তাদের দেখব, তাদের কথা শুনব। তাদের চলাফেরা অবলোকন করব। কারণ, স্যার তাঁর অবিশ্বাস্য সুন্দর জীবন বইতে লিখেছেন—‘আজকাল স্মার্টফোন নাম একটা বিচিত্র যন্ত্র বের হয়েছে, যখন মানুষের কোনো কিছু করার থাকে না তখন বেশির ভাগ মানুষ এই স্মার্টফোনের ছোট স্ক্রিনে নিজেকে গুটিয়ে ফেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট করে। কিন্তু তারা যদি একবার চোখ খুলে চারপাশে তাকাত, তাহলে তারা দেখত চারপাশের জগৎটা কত জীবন্ত, কত চমকপ্রদ, কত চিত্তাকর্ষক।’ তবুও স্যারের কাছ থেকে অটোগ্রাফ নেওয়ার সময় মোনা ভাবি সেটা তার স্মার্টফোনের ক্যামেরায় ছবি তুলে রাখলেন। আমি ম্যাডামের কাছ থেকে তাঁর লেখা সাস্টে ২২ বছর বইটাতে আমার গিন্নির জন্য অটোগ্রাফ নিয়ে নিলাম। আমি বাতিঘরের কাছ থেকে অবিশ্বাস্য সুন্দর পৃথিবী বইটাতে নাজমুল ভাই আর সন্ধ্যা ভাবির জন্য অটোগ্রাফ নিয়ে নিলাম। তাহিয়া রাশেদ মাই ফ্রেন্ড বইটাতে বাতিঘরের অটোগ্রাফ নিয়ে নিল। এভাবে আমাদের সকালের পর্ব শেষ হলো।

বাসায় ফিরে বিকেলে তাঁদের নাগরিক সন্ধ্যায় যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম। অবশেষে বিকেলে ব্যাংকসটাউনের ব্রায়ান থিয়েটারে পৌঁছে গেলাম। সেখানে শুরুতেই ম্যাডাম কথা বললেন। ম্যাডামের বলা প্রায় সব কথায় তাঁর লেখা সাস্টে ২২ বছর বইটাতে আছে। কিন্তু তবুও সামনাসামনি সেই কথাগুলো শুনতে খুবই ভালো লাগছিল। তখন আমি আবারও নতুন করে বাতিঘরের বলা কথাটার মর্মার্থ বুঝতে পারলাম। আসলেই আমাদের চারপাশের জীবনটা কত জীবন্ত, কত চমকপ্রদ, কত চিত্তাকর্ষক। কারণ, একজন মানুষ যখন সামনাসামনি কথা বলেন তখন তাঁর অভিব্যক্তি দেখতে পাওয়া যায়, তাঁর হাসি শুনতে পাওয়া যায়, কথা বলার সময় তিনি কীভাবে হাত–পা নেড়ে কথা বলছেন সেটাও দেখা যায়।

বাতিঘরের বলা প্রায় সব কথায় বাতিঘরের লেখা কোনো না কোনো বইয়ে পড়েছিলাম। তবুও একদৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। শৈশবে তাঁর বিভিন্ন স্কুলে পড়ার কাহিনি পড়েছিলাম আধ ডজন স্কুল বইয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অভিজ্ঞতাও পড়েছিলাম অন্য কোনো একটা বইয়ে। তবে নতুন যে কথাগুলো শুনলাম সেগুলো তিনি বলেছিলেন প্রশ্নোত্তর পর্বে। তার মধ্যে একটা হলো ভবিষ্যৎ পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি যেমন গুগল বা ফেসবুক। কারণ তাদের তথ্যভান্ডার অনেক সমৃদ্ধ। তাই দেখা যাবে হঠাৎ করে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। তাই আমাদের বেশি বেশি করে মানবিক শিক্ষার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। মানবিক কাজগুলোর গুরুত্ব কখনোই কমবে না। তাই এই শিক্ষাগুলো একদিকে যেমন আত্মার খোরাক জোগাবে অন্যদিকে জীবিকারও সংস্থান করবে। আর একটা কথা বলেছিলেন, সেটা হলো প্রবাসীরা অনেক সময় মনঃকষ্টে ভোগেন দেশের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অবশেষে প্রবাসে পাড়ি জমানোর কারণে। তিনি বললেন, এতে মনঃকষ্টে ভোগার দরকার নেই। কারণ, বর্তমান পৃথিবী অনেক ছোট হয়ে গেছে। আর প্রবাসে পাড়ি জমালেই যে দেশের সঙ্গে সব বাঁধন ছিন্ন হয়ে যায় এমন না। বরং বিদেশে থেকেও দেশের জন্য অনেক কাজ করা যায়। তিনি আরও বলেন, তোমরা বিদেশে এসে বাংলাদেশের রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি না করে বরং সেখানকার রাজনীতি করা শুরু করো। সে দেশের এমপি হও, মন্ত্রী হও তাতেই দেশের নাম উজ্জ্বল হবে বিদেশের মাটিতে। বাতিঘরের আলোয় এভাবেই কেটে গেল সাদামাটা একটা দিন। কিন্তু মনের মধ্যে ছড়িয়ে গেল হাজারো রং, যার প্রভাব থাকবে আমরণ।

বাতিঘরের কথা দিয়েই লেখাটা শেষ করতে চাই। অবিশ্বাস্য সুন্দর পৃথিবী বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখা আছে—‘আমি স্ট্রেচারে শুয়ে আকাশের দিয়ে তাকিয়েছি। আকাশে ভরা একটা চাঁদ ঠিক মাথার ওপরে আমার দিকে স্নেহভরে তাকিয়ে আছে। নির্মেঘ আকাশে বিশাল একটা চাঁদ, জ্যোৎস্নার আলোতে চারপাশ থইথই করছে, কী আশ্চর্য একটি দৃশ্য। আমি বুভুক্ষুর মতো তাকিয়ে রইলাম। আমার মনে হলো, কী অবিশ্বাস্য সুন্দর এই পৃথিবী! এই অপূর্ব সৌন্দর্য আমি দেখতে পাব? সৃষ্টিকর্তা এই অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য দেখার জন্য আমাকে এই পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখবেন?’ এটা ছিল তাঁর ওপর হামলা করার কিছু মুহূর্ত পরের ভাবনা। যখন তাঁকে নিয়ে জমে মানুষে টানাটানি শুরু হয়েছে। আমাদের প্রজন্ম সত্যিই ভাগ্যবান যে আমরা বাতিঘরের লেখা পড়ে বড় হয়েছি। তাঁকে সামনাসামনি দেখতে পেরেছি। আমি আশাবাদী তাঁর লেখা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও পথ দেখাবে। তাই মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি যেন আরও বহু বছর তিনি আমাদের মধ্যে সুস্থভাবে বেঁচে থাকবেন, আমাদের বাতিঘর মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
...

মো. ইয়াকুব আলী: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ই–মেইল: <[email protected]>