সিনসিনাটি বিমানবন্দর

সংগৃহীত
সংগৃহীত

আগস্ট শেষ হয়ে সেপ্টেম্বর ছুঁয়েছে। অথচ উত্তর আমেরিকায় দিনের আলোয় সূর্যের তাপমাত্রা এখনো প্রবল। সন্ধ্যার শান্তরূপে শীতলতা নেই। হেমন্ত ঋতুতেও প্রখর দহনে দগ্ধ হচ্ছে চারপাশ। সৃষ্টি পর্বের ইতিহাসে নিরন্তর বদল ঘটাচ্ছে পরিবেশ। তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় ভূত্বকের থার্মোসিস্টেমে যন্ত্রণার স্পর্শকাতরতা। বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা প্রকৃতির আচরণে দৃশ্যমান করে তুলছে পরিবর্তনের ঢেউ। একেকটি নতুন অধ্যায়ে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি তাই বাঁক নিচ্ছে নতুন সূচনার দিকে। তার ইতিহাস লিখে রাখছে লুপ্ত ও অর্ধ লুপ্ত জীবের বিয়োগান্ত ঘটনার কথা। তার আচরণ ঘোষণা করছে, জগৎ ধ্বংসের ভয়াবহ পরিণতির খুঁটিনাটি বৃত্তান্তকে।

বিজ্ঞান বহু আগেই জানিয়েছে, মানব শরীরের মতো পৃথিবীর সব রকম জীবদেহেই রয়েছে অন্তর্লীন পরিক্রমার এক চেতনময় ঘড়ি। সহজাত পদ্ধতিতে এই দেহঘড়ি প্রত্যেক জীবদেহে নিঃশব্দে কিন্তু নিশ্চিতভাবে যথাযথভাবে কাজ করে। এই দেহঘড়ির কারণেই বীজ থেকে অঙ্কুরিত হয় গাছ। ফুল ফোটে। ফুল ঝরে। নির্দিষ্ট ঋতুতে সুনির্দিষ্ট সময়ে সৃষ্টির উৎসারণে মেতে ওঠে প্রকৃতি। মানবদেহ শৈশব ছেড়ে যৌবনে, তারপর পা রাখে বার্ধক্যের পথে। জগতের সবখানে সুশৃঙ্খল পথ ধরে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে এভাবেই এগিয়ে চলেছে বিশ্বসৃষ্টির পরিক্রমা। অমোঘ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে তাই মহাসর্বনাশ!

সভ্যতাগর্বী মানুষ এসব সংবাদ রাখেন। কিন্তু তাঁরা যতখানি জানেন, বাস্তব জীবনে নিজের স্বার্থ সংরক্ষণে তাকে উপেক্ষা করেন তত বেশি। পরিবেশবিদেরা তাই বারবার সতর্ক উচ্চারণ করে মানুষের সব রকম দানবীয় কর্মাবলির বিরুদ্ধেই চেঁচিয়ে চলেছেন যুগের পরে যুগ। তাঁরা বলছেন, মানুষের অনাচারে প্রকৃতির নিয়মে যে ব্যত্যয় ঘটছে নিরন্তর তার পরিণতি শুভদায়ক নয় জীব ধাত্রী জগতের জন্য! কারণ জগৎ এমন এক সুপরিকল্পিত পদ্ধতিতে তৈরি যেখানে প্রকৃতির সঙ্গে জীব আর জড়ের সম্পর্ক নিবিড় সুতোয় বাঁধা। অতএব এবার সতর্ক হওয়ার পালা।

কিন্তু কারা হবেন সতর্ক? সব রকম অনাচারের বিরুদ্ধে তাই প্রবল প্রতিবাদ নীরব রোষে নিত্যদিন মুখরিত হচ্ছে প্রকৃতির আচরণে। ভাদ্র বিদায় নিতে চলেছে। কিন্তু হেমন্তের পদচারণ চর্মচক্ষুতে দৃশ্যমান নয়। বসন্তের আগমনে যারা সবুজ সুধায় রূপমুগ্ধদের ভুলিয়েছিল, তাদের কেউই সময়ের নিয়ম মেনে বিদায় বেলার ব্যথার রঙে রেঙে ওঠেনি এখনো। এমনকি শিগগিরই যে তার সম্ভাবনা রয়েছে, তেমন আভাসও পরিস্ফুট নয় অরণ্যভূমির রাজ্যজুড়ে। বিশ্বের সভ্য দেশের নেতারা এই ব্যত্যয়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের ঝলমলে দীপ্ত শপথ ঘোষণা করছেন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে। শক্তিমান উচ্চারণে দূষণহীন জলবায়ু রক্ষার শপথ নিচ্ছেন বারবার। কিন্তু মানবসৃষ্ট অনাচারে কোনো রকমফেরই লক্ষ্যযোগ্য নয় তাতে।

বিমানবন্দরে এসি চলছে সারাক্ষণ। চিরবসন্তের মোহনীয় ছোঁয়া লাউঞ্জে বসেও প্রতীক্ষারত যাত্রীরা অনুভব করছেন আবেশে বিবশে। শীত শীত অলস পরশ ছড়িয়ে রয়েছে অনেকের দেহে। শীতকাতুরে যাত্রীরা হালকা গরম পোশাকে আপাদমস্তক ঢেকেছেন। বাড়ি ছাড়ার আগে সুচরিতও বসন্তে ব্যবহৃত একখানা লাইট জ্যাকেট পরে নিয়েছিল। জীবনের প্রত্যেক কর্মক্ষেত্রে নিখুঁতভাবে সতর্ক সে। বহ্নির অবশ্য ছেলেবেলা থেকেই শীতের সঙ্গে সখ্য। গরমের স্পর্শে সে বড় অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে।

তারপরও স্বভাব নিয়মে সুচরিত স্ত্রীকে সতর্ক করেছিল, গায়ে হালকা জ্যাকেট জড়িয়ে নাও বহ্নি। ভোর রাতের হিমে ঠান্ডা লেগে যাবে। বহ্নি কথা বলেনি। তবে মান্য করে একখানা জ্যাকেটও চাপিয়ে আসেনি গায়ে। বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে বসে শীতের পরশ অনুভব করতে করতে এখন তার মনে হলো, একখানা হালকা জ্যাকেট পরে এলেই হতো। সত্যিই বড় ভুল হয়ে গেছে!

ছেলেবেলা থেকেই বহ্নির অদ্ভুত স্বভাব। মনঃসংযোগের দরকার যেখানে সেখানে মন না রেখে প্রয়োজনহীন বিষয়বস্তুকে গভীর কৌতূহলে লক্ষ্য করে সে। বিমানবন্দরের লাউঞ্জে বসে আজও ব্যতিক্রম হলো না। কয়েক হাত দূরে ডান পাশে দৃষ্টি ছুড়তেই তার নজরে পড়েছিল, দুখানা চেয়ারে দুজন ভারী চেহারার মাঝবয়সী নারী গভীর সখ্যে সংসারের বিচিত্র গল্প নিয়ে আলাপচারিতায় মেতেছেন। নারী চরিত্রের আটঘাটের গলি–ঘিঞ্জি যাঁরা চিনেছেন তাঁরা বলেন, জগতে স্ত্রীজাতির আলাপচারিতায় বিষয়ের কখনো অভাব ঘটে না। কী করেই বা ঘটবে? নারী জাতির আলাপের বিষয়বস্তু তো পুরুষের মতো সীমাবদ্ধ নয়। বরং সংসারের যাবতীয় বিষয়ে নানাভাবে রং চড়িয়ে তারা স্বভাবসুলভভাবেই আকর্ষণীয় করে তুলতে জানে। কান পাততেই বাক্যালাপের টুকরো কথা কানে এল, ‘বুঝলে তো বারবারা, আমার স্টুপিড ছেলেটা যাকে ভালোবাসে, আমার তাকে মোটেই পছন্দ নয়! মেয়েটির আচার আচরণ তো বটেই, এমনকি আউটলুকও নয়।’ জবাবে বারবারা সখেদে বললেন, ‘তাতে ওদের কী এসে যায় অ্যানা। ছেলেমেয়েদের পছন্দের ওপর বাপ-মায়ের তো আর কথা বলা চলবে না। এই তো দেখো না, আমার মেয়ে সেরেনাকে কতবার বারণ করেছিলাম, কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেকে বিয়ে না করতে। গত বছর ডিসেম্বরে বিয়ে হলো, তারপর তিন মাস না যেতেই আলাদা হয়ে গেল দুজনে। আবার ছেলেটাও দেখছি এক হাঙরের খপ্পরে পড়েছে। সাংঘাতিক ধুরন্ধর মেয়ে। আমি তাকে হাড়ে হাড়ে চিনেছি। কিন্তু ছেলেকে বলে তো লাভ নেই। আমি তাই ক্রেগের বিষয় নিয়ে এখন আর মাথাই ঘামাই না।’

জগতের সবখানে শাশুড়ি-পুত্রবধূদের সম্পর্ক সিংহভাগ ক্ষেত্রেই সাপে-নেউলের। সেকালের মতো একালেও এই অভিমত নিয়ে দ্বিমত নেই। বিশেষত এ দেশের ব্যক্তিকেন্দ্রিক আত্মনির্ভর সমাজে শাশুড়ি আর পুত্রবধূরা একই ছাদের তলায় বসবাস করতে পর্যন্ত উৎসাহী নন। সোহাগভরে কেউ উৎসাহী হলে কদিনের মধ্যেই সংসারে কুরুপাণ্ডবের ইতিহাস রচিত হয়ে যাবে। স্টুপিড ছেলের জননী অ্যানা উত্তরে তাই কয়েকবার মাথা নেড়ে বললেন, ‘আমিও আর ভাবব না বারবারা। ভেবে লাভ কী! বরং প্রার্থনা করো, বিয়ের পরই যেন আমার স্টুপিড ছেলের ডিভোর্সটা হয়ে যায়। তা নইলে ওই দজ্জাল মেয়েটা ছেলেটাকে মোটেই ভিড়তে দেবে না আমাদের কাছে।’

লাউঞ্জে এত সময় যাত্রীদের ভিড় ছিল না। এখন সবগুলো চেয়ারই পূর্ণ হয়েছে। বহ্নির বাঁ পাশের ফাঁকা দুটি চেয়ারে একটু আগে মিলিটারি ম্যান চেহারার দুজন তরুণ বসেছেন দুখানা ল্যাপটপ খুলে। একটু পরেই কোলের ওপর রেখে গভীর মনোযোগে দুজনই ডুবে গেলেন কাজের গভীরে। সামনে অ্যাটাচড টেবিলের ওপর ধূমায়িত কফির দুটি পেপার গ্লাস। তাঁদের খোলা মুখ দিয়ে সার বেঁধে ধোঁয়া উড়ে চলেছে ভাঙা ভাঙা কুণ্ডলী পাকিয়ে। ব্রেকফাস্ট হিসেবে কফির সঙ্গে সম্ভবত এই বিমানবন্দর থেকেই কেনা হয়েছে মাখনে ডোবানো সুস্বাদু ডোনাট। তাঁদের পুষ্ট শরীর বেয়ে ঝলমলে পেলবতা গড়িয়ে পড়ছে লোভনীয় গন্ধ ছড়িয়ে। বোধ করি এয়ারফোর্সের কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নিতে চলেছেন তরুণ দুজন। তাঁদের পরিচ্ছদের পরিচিত বৈশিষ্ট্য অন্তত সে রকম ধারণাই তৈরি করছে যাত্রীদের মনে।

নর্দান কেনটাকি সিনসিনাটি এয়ারপোর্টের ডেপারচার গেট। সংগৃহীত
নর্দান কেনটাকি সিনসিনাটি এয়ারপোর্টের ডেপারচার গেট। সংগৃহীত

ঘড়িতে ভোর পাঁচটা বেজে পঁয়ত্রিশ পূর্ণ হয়েছে। নর্দান কেনটাকি সিনসিনাটি এয়ারপোর্টের গেট নম্বর বি-৮-এ, অপেক্ষারত যাত্রীরা। আমেরিকান এয়ারলাইনসের ৪৩৮১ ফ্লাইটের বোর্ডিং আধঘণ্টার মধ্যেই শুরু হবে। ছয়টা পঁয়ত্রিশ মিনিটে ফ্লাইট উড়াল দেবে শিকাগোর ওহারে বিমানবন্দরের উদ্দেশে। অনেকের যাত্রা শেষ হবে এখানেই। নতুন যাত্রী যোগ দেবেন অন্য গন্তব্যে যেতে। সুচরিতরা ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসে শিকাগো থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট হয়ে দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দরে পৌঁছাবে পরদিন বিকেলে। তারপর ডোমেস্টিক ফ্লাইটে ভুবনেশ্বরের বিজু পাটনায়েক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। ভুবনেশ্বরই তাদের বিমান যাত্রার শেষ গন্তব্য স্থল। এরপর দেড় সপ্তাহ ধরে ওডিশার ট্যুরিস্ট স্থানগুলো পরিদর্শন করাই হবে একমাত্র কাজ। এই দর্শনের তালিকায় রয়েছে—চিলিকা হ্রদ, কোনার্ক সূর্যমন্দির, পুরির জগন্নাথ ধাম, বুড্ডিস্ট সাইটস, আদিবাসী অধ্যুষিত নির্জন গ্রাম, খ্যাত অখ্যাত কুটিরশিল্পীদের শিল্পকর্ম, ওডিশার প্রাচীন দুর্গ, গোল্ডেন বিচ ইত্যাদি ইত্যাদি। মহাকালের বিবর্তনধারায় প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে আজও ওডিশার আনাচকানাচে ছড়িয়ে রয়েছে দুর্দান্ত সব ঘটনার স্রোত। বিচিত্র পুরাকীর্তির দুর্ধর্ষ ইতিহাস। যেখানে অজস্র রোমান্স রহস্য আগের মতোই স্তরে স্তরে জমাট বেঁধে স্থির।

যাত্রীদের পিলে চমকে গেল হঠাৎ কালান্তক যমের মতো দুই সিকিউরিটি পুলিশের উপস্থিতিতে। সবার প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি আর্তি নিয়ে ছুটল তাদের দিকে। ইউরোপে জঙ্গিবাদের শতাব্দীকালের ইতিহাস রয়েছে। জাতীয়তাবাদী, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কর্মকাণ্ড উত্তাল করে দিয়েছে বছরব্যাপী। সম্প্রতি ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বব্যাপী চলছে জিহাদিদের জঙ্গিবাদের দুর্দান্ত প্রচণ্ডতা। তাদের কর্মকাণ্ডের বিশৃঙ্খলা পৃথিবীর নানা প্রান্তকে প্রবলভাবে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। মার্কিন নিরাপত্তার পরিকল্পনা এখন তাই নিরন্তর ছুটোছুটিতে বিভিন্ন দিকে অস্থির। পুলিশ অফিসারদের একজন যাত্রীদের দিকে পলকহীন তাকিয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় কোণের দিকে ফেলে রাখা একটি হ্যান্ডব্যাগের দিকে নির্দেশ করে সুগম্ভীর প্রশ্ন করলেন, ‘হুম ডাজ দিস লাগেজ বিলং টু?’ উত্তর না পেয়ে আবার একইভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কার ব্যাগ?’ যাত্রীরা তখনো নিরুত্তর। সবার চোখেমুখে আতঙ্কের পরিপুষ্ট আভাস। কে বলতে পারে কোনো গোপন সন্ত্রাসী লুকিয়ে রয়েছে কিনা প্লেন যাত্রীদের ভিড়ে? এই তো গত সপ্তাহেই ধরা পড়ল, টেক্সাস থেকে কানাডা যাওয়ার পথে প্লেন আকাশে উড়তে গিয়েও শেষ অবধি নামিয়ে নিয়েছে ডানা। তিন তরুণের দেহ তল্লাশিতে সেবার ধরা পড়েছিল অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু অস্ত্র।

সময় পেরোচ্ছে দুর্ধর্ষ মুহূর্তের ডানায় চড়ে। বাক্যহীন নির্জনতায় স্তব্ধ পরিবেশ। উদ্বিগ্নতার অস্বস্তিতে মুহূর্তগুলো জমাট বেঁধে স্থির। অফিসার উত্তরের প্রতীক্ষায় ভেতরে-ভেতরে আগ্নেয়গিরি হচ্ছেন। কিন্তু কে দেবে উত্তর? অসীম সাহসে ভর করে ব্যাগটি তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন অফিসার। যাত্রীরা নিশ্চিত, এই লাগেজ বৃত্তান্তের সুরাহা না হলে প্লেন আজ উড়বে না আকাশে। যাত্রীদেরও কয়েক প্রস্থ ফের নিরাপত্তাবেষ্টনীতে পড়তে হবে। সহসা দক্ষিণ এশীয় চেহারার এক তরুণ শ্লথ ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ স্বরে কথা বলল, ‘ওটা আমার স্যার!’ জনতার ভয়ার্ত দৃষ্টি ক্ষুব্ধতায় তার মুখে মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ল সাগরসৈকতে আছড়ে পড়া উত্তাল ঢেউ হয়ে। কিন্তু অফিসার সংযত হয়েই জানতে চাইলেন, ‘নিজের কাছে না রেখে কেন এটাকে অত দূরে কোণের দিকে সরিয়ে রেখেছিলে?’ ‘কাছে রাখতে ভুলে গিয়েছিলাম।’ ‘সত্যি? তোমার সঙ্গে আরও লাগেজ আছে?’ ‘না স্যার।’ ‘আমার সঙ্গে চলো।’ পুলিশ অফিসার চলে যাওয়ার পরে বহু যাত্রীর মনেই যে প্রশ্নটা উঁকি মেরে ঠিকরে পড়ল বারবার, সেটা হলো, এই ছেলে কি সন্ত্রাসীদের চর? নাকি নিজেই যুক্ত সন্ত্রাসী ঘটনার সঙ্গে?

কিন্তু জনতার ক্ষুব্ধতা কোলাহল তোলার বদলে নিঃশব্দেই চাপা পড়ে রইল সবার বুকের আড়ালে। পশ্চিমের বিরুদ্ধে প্রাচ্যের অভিযোগ অনেক। তবে এই সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। ভদ্রতা ও বাস্তবতা মেনে চলার সহবত শিক্ষা এখানকার সিংহভাগ জনতার রপ্ত। নিজের অধিকারের সীমানা ক্রিটিক্যাল মুহূর্তেও এরা সংযত করতে জানেন। মানব অধিকারের সব দরজা–জানালা উন্মুক্ত থাকা সত্ত্বেও নাগরিক অধিকার ভোগ ও কর্তব্যপালনের সীমারেখাগুলো সর্বত্রই তাই সংরক্ষিত সুশৃঙ্খলভাবে। তাই যে রহস্যের সত্যতা উদ্ধার করায় বিমানবন্দর সিকিউরিটি অফিসারের দায়িত্ব শতভাগ, অনধিকারের প্রশ্ন থাকায় যাত্রীদের উত্তাল হওয়ার বিন্দুমাত্র অধিকার সেখানে নেই।

এই ঘটনার পরে সামনের ঝুলন্ত টিভি স্ক্রিনে ডেপারচারের ফ্লাইট স্ট্যাটাসগুলোতে সবাই সজাগ দৃষ্টি ছুঁয়েছেন। সবারই মনে সংশয়, যথাসময়ে বিমান উড়বে তো? শিকাগো পৌঁছে কানেকটিং ফ্লাইট ধরা সম্ভব হবে? এখনো অবশ্য বারবার টিভির পর্দায় ভেসে উঠছে পুরোনো সংবাদটাই ‘আমেরিকান এয়ারলাইনস ফ্লাইট নম্বর ৪৩৮১ , ওহারে বিমানবন্দরের উদ্দেশে ছেড়ে যাচ্ছে সকাল ছয়টা পঁয়ত্রিশ মিনিটে’।

বোর্ডিং শুরু হয়ে গেল। ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় ছয়টা দশ। সাতসকালেও দীর্ঘ লাইন পড়েছে ফ্লাইটের জন্য। যাত্রীরা একে একে দীর্ঘ প্যাসেজ পেরিয়ে প্রবেশ করছেন বিশাল বিমানের অভ্যন্তরে। কোথাও কোনো অনিয়ম নেই। বোর্ডিং থেকে আরম্ভ করে প্লেনের ওভারহেড কম্পার্টমেন্টে লাগেজ রাখার কাজও দশ মিনিটেই সম্পন্ন হলো সুচারুভাবে। চাকায় ভর করে বোয়িং এবার ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে রানওয়েতে। প্লেন ছেড়ে যাচ্ছে যথাসময়ে। অর্থাৎ সকাল ছয়টা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিটে। পাইলট ও কো-পাইলটের ককপিট থেকে ঘোষিত হচ্ছে স্থানীয় আবহাওয়ার সংক্ষিপ্ত সংবাদ। তারিখটা ২০০৬। ৪ সেপ্টেম্বর।