নক্ষত্রের রাত

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আশ্বিন মাসের শুরু। গ্রাম–বাংলার প্রকৃতিতে শীতের আবহ শুরু হয়েছে। ভোরবেলা হালকা কুয়াশা পড়া শুরু হয়েছে। অবশ্য বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই কুয়াশা দ্রুতই ফিকে হয়ে যায়। ভোরবেলায় ঘাসের ডগায় কুয়াশার বিন্দুগুলোকে মুক্তোর দানা বলে ভুল হয়। সকাল ও সন্ধ্যায় পাখিদের কলকাকলিতে পুরো এলাকা মুখর হয়ে ওঠে। বিশেষ করে উঠোনের পাশের গাছগুলোতে চড়ুইদের কলকাকলি মনে করিয়ে দেয় ভোর হচ্ছে বা সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। রাতের খাবার পর বেচে যাওয়া ভাতে পানি দিয়ে রাখা হয়েছে। ভোর হওয়ার আগেই সেটা মাটির পাত্রে (কুষ্টিয়া ও পাবনার স্থানীয় ভাষায় ঢুকসা, মালসা বা সানকি বলে) নিয়ে উঠোনের কোনায় লাগানো গাছের কাঁচা মরিচ দিয়ে ডলে খেয়ে কাঁধে লাঙল নিয়ে পুরুষ মানুষেরা বেরিয়ে পড়েন। যাওয়ার আগে গরুকেও চাপকল বা কুয়ো থেকে পানি তুলে এক চাড়ি পানিতে ধানের ভুসি আর চিটাগুড় মিশিয়ে খাইয়ে নেওয়া হয়। কারণ, খেতে পৌঁছেই তাদের লাঙল টানতে হবে। খেতে লাঙল দেওয়ার সময় রাজ্যের পাখি এসে খেতগুলোর কাছে ভিড় করে পোকামাকড় খাওয়ার জন্য। দেখে মনে হয় যেন পাখিদের মেলা বসেছে।

খেতের পাকা ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। বিবাহিত মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি থেকে নাইওরে বাপের বাড়ি আসা শুরু করেছে। জয়তুন বিবির মেয়েরাও আসা শুরু করেছে। সব মিলিয়ে এগারোজন মেয়ের মা তিনি। তাদের মধ্যে অবশ্য বেশ কজন জয়তুন বিবির আগেই পরপারে পারি জমিয়েছে। যারা বেঁচে আছে তারাই প্রতিবছর নিয়ম করে নাইওরে আসে। সেবারও প্রায় সব মেয়েই তাদের একগাদা ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে এসেছে। এই সময়টা জয়তুন বিবির খুব ভালো লাগে। মনে হয় যেন বাড়িতে একটা ছোটখাটো মেলা বসেছে। নাতি–নাতনিরা সারাক্ষণ হুড়োহুড়ি করে সারা বাড়ি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। নিজেদের মধ্যে কাইজ্যা (মারামারি) করছে আবার নিজেরারই সালিসি বৈঠক করে সেই ঝগড়া মিটিয়ে ফেলছে।

জয়তুন বিবি সারা দিন ছেলেমেয়েগুলোকে চোখে চোখে রাখেন। তিনি যেহেতু ছেলেমেয়েদের দিকে খেয়াল রাখেন তাই তাঁর মেয়েরা একটু স্বাধীনতা পেয়ে নিজেদের মতো করে চলাফেরা করে। মেয়েরা শুধু কোলের বাচ্চাটাকে সঙ্গে নিয়ে পাড়ার পুরোনো সখী বা সইদের মধ্যে কে কে এইবার নাইওরে এসেছে, সেই খোঁজ নিতে তারা বেরিয়ে পড়ে। তাদের কাউকে পাওয়া গেলে সেই বাড়িতেই গল্প করে দিন পার করে দিয়ে বাড়িতে ফেরে। রাতে খাওয়ার পর নাতি–নাতনিদের জন্য বাড়ির উঠোনে খেজুরের পাতার ওপর কাঁথা বিছিয়ে বারোয়ারি বিছানা করা হয়। সেই বিছানার এক প্রান্তে জয়তুন বিবি বসে পড়েন। তখন আবার নাতি–নাতনিদের মধ্যে কে নানির কাছাকাছি থাকবে সেটা নিয়ে একটা মারামারি লেগে যায়। তখন জয়তুন বিবিকে হস্তক্ষেপ করে সেটা থামাতে হয়।

বারোয়ারি বিছানায় সবগুলো নাতি–নাতনি শুয়ে পড়ার পর শুরু হয় গল্পের আসর। অবশ্য সেখানে শুধুই গল্প স্থান পায় না বরং কখনো ধাঁধা আবার কখনো শ্লোকও বলা হয়। এই গল্প বলার ব্যাপারটাকে কুষ্টিয়া–পাবনার ভাষায় বলা হয় কিসসা। ধাঁধা বা শ্লোক যাই বলা হোক না কেন বাচ্চারা আবদার করতে থাকে কিসসা শোনার জন্য। তাই অবশেষে জয়তুন বিবিকে কিসসা বলা শুরু করতে হয়। বিছানায় শুয়ে কিসসা শুনতে শুনতে আকাশের দিকে তাকালে মনে হয় উঠোনের মতো সেখানেও তারার মেলা বসেছে। পক্ষ অনুযায়ী সেখানে চাঁদকেও দেখা যায়। চাঁদ থাকলে চারপাশে জ্যোৎস্নালোকিত হয়ে যায়। জ্যোৎস্নার আলো সবচেয়ে বেশি ফুটে ওঠে গ্রাম বাংলার মাটির উঠোনে বা বাড়ির মাটির দেয়ালগুলোতে। মাটির মেটে রঙের সঙ্গে জ্যোৎস্নার আলো মিশে এক অতিপ্রাকৃত পরিবেশ তৈরি করে। আর অমাবস্যার সময় আকাশে ছড়ানো থাকে অযুত-নিযুত তারা। তাদের দিকে তাকালে মনে হয় তারা যেন পৃথিবীর মানুষদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।

এই অযুত নিযুত তারা নিয়ে একটা ধাঁধাও খুবই প্রচলিত। সেটা হচ্ছে, এক ধামা (ধান বা চাল রাখার বেতের তৈরি পাত্র) সুপারি গুনতে পারে কোনো ব্যাপারী। এ ছাড়া শিশুদের চিনিয়ে দেওয়া হয় কোনটা কোন তারা। ওই যে তোরা দেখছিস বড়শির মতো সাতটা তারা, তাদের একসঙ্গে বলে সপ্তর্ষি মণ্ডল। আর প্রত্যেকটা তারার আবার আলাদা আলাদা নামও আছে। আর ওই যে উত্তর আকাশে সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটা ওটা হলো শুকতারা। রাতের বেলা এই তারা দেখে দিক ঠিক রেখে মানুষ পথ চলে।

কখনো কখনো বাড়ির কোণার বাঁশঝাড় থেকে ভেসে আসে প্যাঁচার ডাক। তখন আবার বাচ্চাদের একগাদা প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় জয়তুন বিবিকে। কোন পাখি ডাকল, কেন ডাকল, এখন কেন ডাকল ইত্যাদি। তখন বুঝিয়ে দিতে হয় প্যাঁচা আছে দুই রকম। তার মধ্যে লক্ষ্মী প্যাঁচা সৌভাগ্যের প্রতীক। তার নামের সঙ্গে মিল রেখে ট্যারা চোখের মানুষকে লক্ষ্মী ট্যারা বলে ডাকা হয়।

আর গল্প শুরু হলে কখনো তারা আরব্য রজনীর আলাদিনের মাদুরে ভাসতে ভাসতে আরব দেশে যেতে যেতে ঘুমিয়ে পড়ে। আবার কখনো রামের সঙ্গে রাবণের যুদ্ধের সাক্ষী হতে হয়। ভিমের গদার স্বপ্ন দেখতে দেখতে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। গল্প চলতে চলতে যদি কখনো হঠাৎ হঠাৎ একটা তারা খসে পরতে দেখা যায় তখন সেটা নিয়ে শুরু হয় আবারও প্রশ্নের বান। তখন তাদের বুঝিয়ে দিতে হয় রাম রাবণকে তির ছুড়ল, সেটার মাথায় আগুন তাই সেটাকে তারা বলে ভ্রম হয়।

বাড়ির পেছনে শিয়াল ডেকে উঠলে আবারও শুরু হয়ে যায় প্রশ্নবাণ। তখন জয়তুন বিবিকে শিয়ালের ডাকের ব্যাখ্যা দিতে হয়। শোন তোরা, শিয়াল কিন্তু শুরুতে পৃথিবীতে ছিল না। তারা স্বর্গে সুখে–শান্তিতে ছিল। কিন্তু শিয়ালেরা অনেক লোভী। তারা আকাশ থেকে দেখল পৃথিবীর মাটিতে অনেক চিনি ছড়ানো। তাই তারা আল্লাহর কাছে বলল, আমাদের পৃথিবীতে পাঠিয়ে দাও। আল্লাহ তো সবই জানেন তাই তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি নিশ্চিত পৃথিবীতে যাওয়ার ব্যাপারে। তখন শিয়ালেরা বলল, হ্যাঁ আমরা নিশ্চিত। আল্লাহ তখন তাদের পৃথিবীর মাটিতে নামিয়ে দিলেন। পৃথিবীর মাটিতে নামার পর তারা দেখল যেগুলোকে তারা চিনি ভেবে পৃথিবীতে নেমে এসেছিল সেগুলো আসলে উলুর ফুল। শরৎকালে পৃথিবীর বুকে কাশফুলের সঙ্গে সঙ্গে উলুর ফুলও ফোটে। উলু একটা ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ। বিরানভূমিতে সাধারণত এগুলো জন্মায়। শরৎকালে উলুর ফুলগুলোকে দূর দেখলে সাদা বিছানা বলে ভুল হয়। শিয়ালের দল এই উলুর ফুলকেই চিনির স্তর ভেবে ভুল করেছিল। ভুল বুঝতে পারার পর তারা আল্লাহকে আবার তাদের স্বর্গে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বলল। কিন্তু আল্লাহ আর রাজি হলেন না। তখন থেকেই শিয়ালের দল আকাশের দিকে মুখ করে ডেকে ডেকে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানিয়ে যাচ্ছে।

যদি কখনো আকাশ দিয়ে একটা আলোর বিন্দুকে ধীরলয়ে চলমান অবস্থায় জ্বলতে নিভতে দেখা যায় তখন সবাই মিলে জয়তুন বিবিকে প্রশ্ন করে, সেই আলোটা কিসের। তখন জয়তুন বিবি বলেন, সেটা প্লেনের আলো। রাতের বেলায় যাতে রাস্তা ভুল না হয়ে যায় তাই আলো জ্বালাতে জ্বালাতে যাচ্ছে। আর তোরা জানিস প্লেনে করে কি নিয়ে যায়? এক দেশ থেকে অন্য দেশে মানুষ নিয়ে যায়। তখন শিশুদের দল আবারও প্রশ্ন করে এতটুকু একটা জিনিসের মধ্যে মানুষ ঢুকে কীভাবে? তখন জয়তুন বিবি বলেন, প্লেনটা অনেক দূর দিয়ে যাচ্ছে বলেই এত ছোট মনে হচ্ছে কিন্তু আসলে অনেক বড় এবং প্লেনের পেটের মধ্যে একসঙ্গে অনেক মানুষ বসতে পারে। শিশুদের দল কোনোভাবেই বুঝতে পারে না তবুও তারা এমন ভাব করতে থাকে যেন সব বুঝে ফেলেছে। কারণ কেউ বোঝেনি সেটা বলে ফেললে অন্যরা তাকে খেপাতে শুরু করবে তখনই।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আবার যদি আকাশে কখনো একটা আলোর বিন্দুকে যদি অনবরত জ্বলন্ত অবস্থায় ধীরলয়ে চলমান দেখা যায় তখন জয়তুন বিবিকে বুঝিয়ে বলতে হয় সেটা হচ্ছে রকেট। রকেটে করেও মানুষ চলাচল করে। শিশুদের দল তখন ভেবে পায় না প্লেন আর রকেটের মধ্যে তফাৎটা কী। কিন্তু তবুও তারা আর সেটা জিজ্ঞেস করে না। জয়তুন বিবি বলে চলেন। ওই যে তোদের চাঁদের বুড়ির গল্প বলেছি না, অনবরত চরকা কেটে যাচ্ছে। তখন বাচ্চাদের মনে পড়ে যায় সেই গল্পের কথা এবং তারা চাঁদের দিকে তাকিয়ে বুড়িকে খোঁজার চেষ্টা করে। আসলেই তখন চাঁদের পিঠে একজন মানুষের বসে বসে চরকা কাটার ছবি শিশুদের মনে ভেসে উঠে। জয়তুন বিবি বলে যান, এই রকেট দিয়েই তো মানুষ চাঁদে গেছে জানিস। এই সব গল্পই তাদের কাছে কেমন জানি গোলমেলে লাগে। তবুও তারা ঘুমের ঘোরে স্বপ্নের মধ্যে কেউ প্লেনে চড়ে অন্য দেশে পাড়ি দেয় আবার কেউ চাঁদে গিয়ে চাঁদের বুড়ির সঙ্গে ভাব জমায়। সে এক অপূর্ব সুন্দর সময়ের গল্প। এই শিশুদের কেউই তখনো জানে না যে পৃথিবীতে বিদ্যুৎ বলে একটা ব্যাপার আছে। যার সাহায্যে আবার টেলিভিশন নামক একটা যন্ত্র চলে। তার মধ্যে ছোট ছোট মানুষ হেঁটে বেড়ায়, খেলাধুলাসহ আরও কত কী করে। তাদের দৌড় তখন পর্যন্ত রেডিওর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই তারা যে যার মতো করে প্লেন আর রকেট কল্পনা করে নেয় আর দিনের বেলায় নিজেদের মধ্যে গল্পের সময় কে আগের রাতে স্বপ্নে কী করেছে সেটাই অন্যদের বলে বেড়ায়।

৩০ বছর পরে সেই শিশুদের একজন হাসান যার নাম আসলে জয়তুন বিবি রেখেছিলেন হাসানুজ্জামান। অস্ট্রেলিয়ার সিডনির শহরতলির মিন্টোতে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বাসার বাইরের ছোট ড্রপ ওয়ালটার ওপর শুয়ে আছে। অস্ট্রেলিয়ার পঞ্জিকা অনুযায়ী এখন কোন কাল, সেটা তার জানা নেই। তাই একদিন তার ৯ বছর বয়সী মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল এখন অস্ট্রেলিয়াতে অটাম মানে শরৎকাল চলছে। অস্ট্রেলিয়ায় মোট চারটা ঋতু—গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত আর বসন্ত। এখানে আলাদাভাবে হেমন্তকাল নেই। কিন্তু হাসান প্রকৃতির আর আবহাওয়া দেখে বুঝতে পারে এখন হেমন্তকাল চলছে। তাকে অনেক ভোরে উঠে কাজে যেতে হয়।

হাসান হঠাৎ একদিন খেয়াল করল কুয়াশা পড়েছে। কিন্তু ট্রেনে করে অফিসে যাওয়ার পথে দেখল কুয়াশা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। আর আবহাওয়াটা না গরম না ঠান্ডা। ইচ্ছে করে খালি গা হয়ে বাতাসটা গায়ে মাখতে। সকালবেলা ঘাসের ডগায় শিশিরের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। তাদের বাসার পাশের ঘাসগুলো গত দুই মাস না কাটার ফলে বড় হয়ে অনেকটা ধানখেতের আকৃতি পেয়েছে। দৃষ্টি সীমার সীমান্তের পাহাড়ের গায়ে কুয়াশার চাদর দেখা যায় সকালবেলায়। সন্ধ্যার সময়ও হঠাৎ একদিন কুয়াশা দেখে হাসান তার মেয়ের কাছে জানতে চাইল, কোথায় আগুন লেগেছে কিনা শুনে তার মেয়ে বলল, বাবা ওগুলো তো কুয়াশা। সাদা সাদা আস্তরণের কুয়াশা বাতাসে ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। তার মেয়ের স্কুল ছুটি হয়ে গেছে দুই সপ্তাহের জন্য। অনেক দিন পর তার গিন্নিও একটা লম্বা ছুটি পেয়েছে। তাই বাসায় খুশির আমেজ। যখন যা ইচ্ছে তাই করছে সবাই। রাতের বেলায় হাসানের মেয়ে বায়না ধরে বাংলা নাটক দেখার। তখন হাসান হুমায়ূন আহমেদের নক্ষত্রের রাত নাটকটা ছেড়ে দেয়।

হাসান খবরে পড়েছে এবারের পূর্ণিমার চাঁদটাকে বলা হচ্ছে পিংক মুন বা গোলাপি চাঁদ। এমন ঘটনা নাকি সচরাচর ঘটে না। গ্রহ নক্ষত্রগুলো কে যেন কার পথ মাড়িয়েছে তাই চাঁদকে এমন দেখাবে। সে নক্ষত্রের রাত নাটকটা ছেড়ে দিয়ে এসে বাইরে ড্রপওয়ালের ওপর শুয়ে পড়েছে চাঁদের দিকে তাকিয়ে। চাঁদের আলোর তীব্রতায় আকাশের বিশাল নক্ষত্ররাজিকে আজ ফিকে দেখাচ্ছে। সে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ মনে হলো চাঁদের বুড়ি যেন তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ঠিক যেমন করে হাসত তার নানি জয়তুন বিবি। বেটে মানুষটার সঙ্গে তার স্মৃতি খুব সামান্যই মনে আছে। অনেকক্ষণ এভাবে শুয়ে থাকার পর একসময় তার মেয়ে এসে তাকে ভেতরে যাওয়ার তাগাদা দেয়। তার মা নাকি তার তিন বছরের ভাইটাকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

আসলে প্রবাসী জীবনে সবাই একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো পরিবারে বসবাস করে। যেখানে ছেলেমেয়েদের জন্য বাবা-মাই একমাত্র অবলম্বন। বাবা-মাকেই পরিস্থিতি বুঝে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রোল প্লে করতে হয়। তারাই তাদের ছেলেমেয়েদের বাবা-মা আবার কখনো বা দাদা-দাদি, নানা-নানি। আবার তারাই হচ্ছে প্রাণের বন্ধু।

হাসানেরও এই প্রবাসে দুই সন্তানকে দুজন বন্ধুই মনে হয়। যাদের সঙ্গে সবকিছু সে শেয়ার করতে পারে। দেশে বাবা মাকে ফেলে এসেছে তাই সে তার ছেলেমেয়েকেই মা আর আব্বা ডাকে। এটা যেন অনেকটা নিজেকে ভুলিয়ে রাখা। হাসানের লাই পেয়ে পেয়ে বাচ্চা দুটো পুরোপুরি উচ্ছন্নে গেছে। মেয়েটার পড়াশোনা ছাড়া সবকিছুতেই মনোযোগ আর ছেলেটার সব আবদার সে মুখে বলার আগেই হাসান পূরণ করে দেয়। তাই ছেলেটার বয়স তিন অতিক্রম করলেও এখনো তার মধ্যে কথা বলার তেমন কোনো তাড়া নেই। হাসানের গিন্নি বলে এর জন্য নাকি হাসানই দায়ী। আর তারা কোনো দুষ্টুমি করে হাসানের কোলে এসে মুখ লুকায় যেমন হাসান ছোটবেলায় কোনো দুষ্টুমি করে তার নানি বা দাদির কোলে গিয়ে মুখ লুকাত। আবার হাসান আর তার মেয়ে বা কখনো তার মেয়ে আর গিন্নি অথবা কখনো হাসান আর তার গিন্নি মিলে একে অপরকে চমক দেওয়ার জন্য অনেক ফন্দি আটে।

হাসান তার নিজের শৈশবের কথা মনে রেখেই তার ছেলেমেয়েকে ঘুম পাড়ায় ঘুম পাড়ানি ছড়া পড়ে অথবা কখনো উপেন্দ্রকিশোরের গল্প বা ঠাকুরমার ঝুলি পড়িয়ে। নক্ষত্রের রাত নাটকটা শেষ করতে তাদের প্রায় তিন রাত লেগে গেল। প্রতি রাতেই সে বাইরে এসে ড্রপওয়ালের ওপর শুয়ে ছিল। চাঁদটা ক্রমশই দেরিতে উঠতে শুরু করল সেই সঙ্গে তার আলোর তেজও কিছুটা কমে গেলে হাসান দেখল, পশ্চিম আকাশে সেই সাত নক্ষত্র মিলে বড়শির আকৃতি নিয়েছে। তার আশপাশেই অনেক তারা মিটমিট করে জ্বলছে। খালি চোখে চেয়ে থাকলে হাসান কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে যায়। বারবার তার শৈশবের নানিবাড়ির উঠোনে বারোয়ারি বিছানাতে শুয়ে নানির কাছে শোনা কিসসা, শ্লোক বা ধাঁধার কথা মনে পড়ে যায়। নানি এখন আর এই পৃথিবীতে বেঁচে নেই। কিন্তু সামান্য হলেও হাসানের মনে রয়ে গেছে নানি আর নানিবাড়ির স্মৃতি। নানি হয়তো বা আকাশের এই নক্ষত্রগুলোর কোনো একটা হয়ে হাসানের দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছেন। হাসান আর কল্পনা করতে পারে না। তার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে। সে বাসার ভেতরে চলে আসে। নক্ষত্রের রাতের শেষ পর্ব চলছে।

আগের পর্বে ওসমান পরিবারের প্রধান কর্তা ব্যক্তি ওসমান সাহেব মারা গেছেন। শেষ পর্বে এসে দেখানো হচ্ছে এরপরও পরিবারটির জীবনযাপন থেমে থাকেনি বরং জীবন তার নিজের নিয়মেই এগিয়ে চলেছে। কাকতালীয়ভাবে নক্ষত্রের রাতের মূল চরিত্রের নামও হাসান। যে একজন সামান্য পথের মানুষ হিসেবে পরিবারটিতে ঠাঁই নিয়েছিল। পরে তার কর্মকাণ্ড দিয়ে সে সবার মনে তার নিজের জন্য একটা জায়গা করে নেয়। যার রয়েছে একটি নিজস্ব জীবন দর্শন। যে জীবনটাকে দেখে ভিন্ন চোখে। জীবনটাকে সে কখনোই চোখ বাঁধা কোনো রুটিন অনুযায়ী পরিচালিত করতে চায় না। জীবনে তার একটাই উদ্দেশ্য মানুষ সম্পর্কে জানা। সৃষ্টির সবকিছু অন্তর দিয়ে অনুভব ও উপভোগ করা। তিনি সারারাত উঠোনে শুয়ে কখনো নক্ষত্র আবার কখনো জ্যোৎস্না দেখেন। জীবনে হাজারো দুঃখের ভিড়েও সে এগিয়ে চলার বাণী শোনায়। কিন্তু কারও মায়ার বাঁধনে বাধা পড়তে চায় না। তার কাছে একেকজন মানুষ একেকটি নক্ষত্রের মতো এবং তাদের মৃত্যু একটি নক্ষত্রের পতন। তাই যখন পরিবারটির সবাই যখন ওসমান সাহেবের শোক কাটিয়ে আবার পথচলা শুরু করেছে তখন আবার সে রাস্তায় নেমে আসে। গন্তব্য তার অজানা।

বাস্তবের হাসানের জীবনের লক্ষ্যও হুবহু নক্ষত্রের রাত নাটকের হাসানের সঙ্গে মিলে যায়। জীবনের কোনো প্রতিকূলতায় তার মুখের এক চিলতে হাসিকে মলিন করে দেয় না। যেকোনো সমস্যার মধ্যেই সে নতুন কোনো সম্ভাবনা খুঁজে পায়। জীবনের অর্জন বলতে সে মানুষের ভালোবাসা পাওয়াটাকেই বোঝে। তার একটাই যুক্তি জীবনে অনেক খারাপ পরিস্থিতিই আসবে তাই বলে জীবনকে থামিয়ে রাখা যাবে না। বরং হাসিমুখে সেটাকে মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হবে। আর সমস্যাগুলো সমাধানযোগ্য নয় সেগুলো মাথা থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেলতে হবে। প্রত্যেক মানুষের জীবনেরই শেষ আছে। তাই জীবনের সুখময় মুহূর্তগুলোকে উপভোগ করার মাধ্যমে হয়ে উঠতে হবে একেকটি নক্ষত্র। হাসানের নানিও যেমন হাসানের মনে একটি নক্ষত্র হিসেবে আজও হাসানের মনে জীবন্ত, যদিও তার অনেক আগেই পতন হয়েছে।