ঝলসে যাওয়া এই শহরে...

ছবি: খালেদ সরকার
ছবি: খালেদ সরকার

আগুনের লেলিহান শিখায় আকাশ আজ রক্তাক্ত। বাতাসেও পোড়া লাশের গন্ধ। চারপাশে স্বজনহারাদের বুক ফাটা আর্তনাদ। বীভৎস এই হৃদয়বিদারক দৃশ্যটা নির্বাক পাথুরে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে দেখছে প্রিয়ন্তী। দূর থেকেও আগুনে আটকে পড়া আত্মাদের চিৎকার প্রিয়ন্তীর তিন তলার বারান্দাকে বিষণ্ন করে তুলছে। বনানীর এফ আর টাওয়ার যেন আজ মৃত্যুপুরী। চারদিকে আগুনে দগ্ধ দুঃসহ শোকগাথা।

বাবার বাড়ি পুরান ঢাকায় বলে প্রিয়ন্তীর শ্বশুর শাশুড়ি কখনো তার বাবার বাড়িতে নিমন্ত্রণে যাননি। পুরান ঢাকায় মানুষ থাকে? অলিগলি, ঘিঞ্জি, অশিক্ষিত লোকের বাস। এমন হাজারো অশ্রাব্য স্নেহের বুলিতে নিত্য প্রিয়ন্তীর কান ঝালাপালা করেন তাঁরা। অথচ এই পুরান ঢাকার মেয়েটিই প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর করেছে। আবীরের সঙ্গে পরিণয়ের সুতোয় না বাঁধলে প্রিয়ন্তীর জানাই হতো না পুরান ঢাকা নিয়ে অভিজাত শ্রেণির কিছু মানুষের এমন ভয়াবহ ধারণা! তবে সহপাঠী আবীরের সঙ্গে কথা বলে কখনোই প্রিয়ন্তীর মনে হয়নি পুরান ঢাকার প্রতি ওর কোনো নিম্নমানের ধারণা আছে। দুর্দান্ত মেধাবী এই ছেলেটির ব্যক্তিত্বে সবাই আকৃষ্ট হতো। মেধার প্রতিযোগিতায় প্রিয়ন্তীও পিছিয়ে ছিল না। মেধা-মনন-সৃজনশীলতায় একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয় প্রথম বর্ষ থেকে। সম্পর্কের সুতোয় বাঁধা পড়ে তখন থেকেই। কিন্তু পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে যখন আবীর প্রিয়ন্তীকে জীবনসঙ্গী করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়, তখন বেঁকে বসে আবীরের পরিবার। পুরান ঢাকার মেয়ে! বনানীর মতো অভিজাত এলাকায় বেড়ে ওঠা আবীর কিনা বিয়ে করবে পুরান ঢাকার মেয়েকে? নোংরা, অলিগলি পেরিয়ে ছেলে যাবে শ্বশুরবাড়ি? ফ্যামিলি স্ট্যাটাস ধুলোর সঙ্গে মিশে যাবে। কিন্তু ভালোবাসা কোনো বাঁধ মানে না। ছেলের আবদারের কাছে শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতেই হয় মা-বাবাকে। বিয়ে হয়ে যায় দুই প্রান্তের দুজন মানুষের।

প্রিয়ন্তীর সংসার জীবনের বয়স তিন বছর। এই তিন বছরে প্রিয়ন্তী প্রতিদিন একটু একটু করে আবিষ্কার করেছে বদলে যাওয়া আবীরকে। পুরান ঢাকার মেয়েটিকে উঠতে বসতে করা অপমানগুলো যেন অন্ধ আর বধিরের মতো হজম করত আবীর। কোনো দিন স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করত না। প্রিয়ন্তীর সহস্র রাত কাটত অসহ্য বেদনার নীল রঙে বুঁদ হয়ে। সহানুভূতি দেওয়ার জন্য কেউ ছিল না।

চকবাজার ট্র্যাজেডির পর প্রিয়ন্তীর সংসারে যেন আবারও নতুন করে আগুন লাগা শুরু হলো। সকালের নাশতার টেবিল থেকে শুরু হতো পুরোনো ঢাকা নিয়ে প্রিয়ন্তীকে চরমভাবে অপমানজনক কথার মধ্য দিয়ে। এমন অলিগলি, এত এত দালানকোঠা, রাসায়নিক দ্রব্যের কারখানা সব পুরান ঢাকায়। অশিক্ষিত লোকগুলো অর্থের লোভে বিবেকশূন্য হয়ে বাণিজ্য করছে। প্রিয়ন্তীর দুই চোখ ছলছল করত। পুরান ঢাকা মানেই কি অশিক্ষিত লোকের বাস? প্রিয়ন্তীর পরিবারের সবাই শিক্ষিত। একটা দুর্ঘটনা দিয়ে সবাইকে দোষের পাল্লায় ফেলা অযৌক্তিক। পুরান ঢাকার হাজারো সমস্যার সমাধানে কেউ কি কখনো সত্যিকারভাবে এগিয়ে এসেছিল? ভোটের সময় করা প্রতিশ্রুতিগুলো হাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে গিয়েছে ভোটের পরই। দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা কেউ কখনো নেয়নি। প্রিয়ন্তীর মেয়ের বয়স দুই মাস। জন্মের পর অনুমতি মেলেনি নানা বাড়িতে যাওয়ার! পুরান ঢাকার দূষিত আলো-বাতাস লেগে যদি কোনো ক্ষতি হয়, তাই প্রথম সন্তানসহ বাবার বাড়িতে যাওয়ার একটু সুযোগ মেলেনি প্রিয়ন্তীর। এদিক থেকে বেশ ভালো আছে দেবরের স্ত্রী জারা। বাবার বাড়ি ধানমন্ডি। সেখানে যাওয়ার নেই কোনো নিষেধাজ্ঞা। অভিজাত এলাকায় সবকিছু আধুনিক। দুর্ঘটনা ঘটার প্রশ্নই আসে না!

আজ বনানীর মতো অভিজাত এলাকার আকাশছোঁয়া সম্ভ্রান্ত ভবনটি জ্বলছে আগুনের হিংস্র থাবায়। প্রিয়ন্তীর দেবরের অফিস এফ আর টাওয়ারের নবম তলায়। আগুন লাগার পর প্রতীক একবার ফোনে জানিয়েছিল, ভেতরে অনেকের সঙ্গে সেও আটকা পড়েছে। এরপর আর কোনো খোঁজ নেই। ফায়ার সার্ভিসের এতগুলো ইউনিট প্রাণপণে চেষ্টা করছে আগুন নেভানোর। শাশুড়ি বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। পরিবারের সবাই পাগলপ্রায়। পুরান ঢাকা নিয়ে কটূক্তি করা মানুষগুলো এখন আর প্রিয়ন্তীর চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। আত্মীয়স্বজনে বাড়িটা ভরে গেছে। যেন মৃত্যুসংবাদ পৌঁছানোর পূর্বেই সবাই শবযাত্রায় অংশগ্রহণের জন্য অধীর হয়ে বসে আছে। প্রিয়ন্তী শাশুড়ির কাছেই বসে ছিল। আবীর গিয়েছে ভাইয়ের খোঁজে। কিন্তু পুরান ঢাকার অপরাধী মেয়েটিকে বেশিক্ষণ আর তাঁদের কাছে ঘেঁষতে দিল না। প্রিয়ন্তীর মেয়েকে সামলানোর কথা বলে সরিয়ে দিল অনুতাপে দগ্ধ আত্ম অহংকারী মানুষগুলো।

প্রিয়ন্তীর মেয়ে অবন্তী নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। পৃথিবীর কূটকৌশল বোঝার বয়স তার হয়নি। প্রিয়ন্তী দাঁড়িয়ে আছে নিঃসঙ্গ বারান্দায়। বুকের ভেতরে ভারী অভিমানের বাষ্প। পুরান ঢাকায় আগুন লাগা স্বাভাবিক, কারণ কোনো কিছুই পরিকল্পিত নয়। কিন্তু বনানীর মতো অভিজাত এলাকা যেখানে উচ্চশিক্ষার আলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে, সেখানে কেন আগুন জ্বলবে? একটি বহুতল ভবনে কেন নেই অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র? আগুনে আটকে পড়া মানুষগুলোকে উদ্ধারের জন্য নেই কোনো আধুনিক সরঞ্জাম। পুরান ঢাকার সরু গলির ভেতরে না হয় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ করতে সমস্যা হয়, কিন্তু বনানীতে ফায়ার সার্ভিসের এতগুলো ইউনিট প্রবেশ করার পরও কেন আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে না? কেন আগুনের হাত থেকে বাঁচার জন্য বিল্ডিংয়ের ওপর থেকে টপ টপ করে মানুষগুলো ঝরে পড়ছে নিষ্ঠুর পৃথিবীর বিবেকহীন বুকে? এত এত উৎসুক জনতা ছবি তুলছে, ভিডিও করছে কিন্তু কেউ তো নিচে একটা নেট বা অন্য কোনো ব্যবস্থা রাখেনি যেন ঝাঁপিয়ে পড়া মানুষগুলোর বাঁচার শেষ আকুতিটুকু রক্ষা হয়! পুরান ঢাকার জ্ঞানহীন, মূর্খ মানুষগুলো না হয় কিছুই বোঝে না, কিন্তু অভিজাত পাড়ায় কেন বিবেকের অবক্ষয়?

প্রিয়ন্তীর নিশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে। অজানা এক আতঙ্ক হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ভেতর বাড়িতে কান্নার রোল। আবীরকে ফোন দেওয়ার সাহস নেই প্রিয়ন্তীর। শক্ত করে বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আগুনের উত্তাপে যেন আকাশের নীলাভ বর্ণ ম্লান হয়ে গেছে। প্রিয়ন্তীর দুই চোখে এক সমুদ্র নোনা জলের ঢেউ। বুক ফাটা আর্তনাদ নিয়ে প্রিয়ন্তীর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, ঝলসে যাওয়া এই শহরে বেঁচে থাকার কি কারও অধিকার নেই?
...