সড়ক দুর্ঘটনা, আইন ও বাস্তবতা: দায়িত্ব কার

ছবি: প্রথম আলো
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশে প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক মানুষের মৃত্যুর খবর পত্রিকা, অনলাইন নিউজ পোর্টাল বা টিভি চ্যানেলে পাওয়া যায়। আশ্চর্য হলেও সত্য, এই মৃত্যুর মিছিল আমরা চাইলে প্রতিরোধ করতে পারি। কিন্তু সে জন্য প্রয়োজন যথাযথ সড়ক আইন, আইনের প্রয়োগ ও গণসচেতনতা। আমাদের দেশে মূল সমস্যাটা এখান থেকেই শুরু। মূলত সড়কে পরিবহন, যাত্রী ও পথচারীর বিপরীতে উপযুক্ত সড়ক আইন ও আইনের বাস্তবায়ন প্রয়োজন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, সমাধানের পথ না খুঁজে, কাগজে-কলমে আইন পরিবর্তন, পরিবর্ধন করে এবং সুযোগমতো পরস্পরের ওপর দায়ভার চাপিয়ে দেওয়ার ঐতিহ্য এখন পর্যন্ত বহাল তবিয়তে আছে। দায়িত্ব, কর্তব্য ও জবাবদিহি—এগুলোর অস্তিত্ব শূন্যের কোটায়। প্রশ্ন থেকেই যায়, সড়কের এই অনিয়ম দেখার ও নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব, ক্ষমতা ও বাধ্যবাধকতা কোন প্রতিষ্ঠান বা বিভাগের। উপরন্তু তাঁরা কীভাবে এর দায়ভার এড়িয়ে যান।

শুধু ঢাকা শহরের সড়ক ব্যবস্থার দিকে একটু ভালো করে নজর দিলে দেখা যাবে, আমাদের সড়ক আইন কতটা অসহায়, ভঙ্গুর ও বিপজ্জনক। লাইসেন্সবিহীন ও ট্রাফিক আইন না জানা চালকের সংখ্যা ভয়াবহ রকমের বেশি। সড়ক দুর্ঘটনার অনেক কারণের মধ্যে এটি একটি প্রধান কারণ। শহরের সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থা হচ্ছে রাস্তা পারাপারের ক্ষেত্রে। শহরজুড়ে পথচারী পারাপারের জন্য মাত্র হাতে গোনা কয়েকটা ফুটওভারব্রিজ রয়েছে, যার অধিকাংশ আবার পথচারীরা ব্যবহার করেন না। এভাবে ঝুঁকিপূর্ণভাবে রাস্তা পার হতে গিয়ে অনেক দুর্ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। অন্যদিকে পদচারী-সেতুগুলোর অবস্থান ও কাঠামোগত নির্মাণে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিকল্পনার অভাব। এ ছাড়া পদচারী-সেতুগুলো শুধু সড়ক সংযোগস্থলে থাকায় এবং দূরত্ব বেশি হওয়ায় অনেকই এগুলো ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হয়ে থাকেন। আমার জানামতে, ঢাকা শহরে পথচারী পারাপারের জেব্রা ক্রসিং খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যে কয়েকটি আছে সেগুলো ব্যবহারের নিয়মগুলো পথচারী বা চালক সঠিকভাবে জানেন তো? বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, গুলশানসহ অনেক স্থানে দেখেছি স্বেচ্ছাসেবী যাঁরা পথচারীদের যত্রতত্র রাস্তা পারাপারে সতর্ক করেন, তারা রীতিমতো হিমশিম খান এই কাজ করতে। তারপরও অনেকেই যত্রতত্র রাস্তা পার হচ্ছেন নিয়মিত। সুতরাং রাস্তা পারাপারে ঝুঁকি কার্যত থেকেই যাচ্ছে।

শহরের অধিকাংশ জনবহুল এলাকার ফুটপাতগুলো অবৈধ দোকানপাট দখল করে নিয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে পথচারীরা চলাচলের জন্য সড়কের একটা অংশ ব্যবহার করেন। এভাবে পথের পাশ দিয়ে চলতে গিয়ে ছোটখাটো দুর্ঘটনার শিকার হয়নি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। একটা সময় ছিল যখন সিটিং সার্ভিস বাসগুলো নির্ধারিত বাসস্টপে থামত। এখন সিটিং সার্ভিসের বাসগুলোও যত্রতত্র যাত্রী উঠানামা করে। লোকাল বাসের কথা না হয় বাদই দিলাম। মাঝেমধ্যে মনে হয় পুরো সড়কটিই একটা চলমান বাসস্টপ। পাল্লা দিয়ে ওভারটেক করার একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা সব বাসের মধ্যে সব সময়ই কমবেশি দেখা যায়। এভাবে পাল্লা দিয়ে ওভারটেক করতে গিয়ে অনেকে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। এ কারণে নিহত মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম না। এ রকম অনিয়ন্ত্রিত সড়কব্যবস্থা, নৈরাজ্য, যানবাহন পরিচালনায় নিয়মনীতিহীনতা নিয়ন্ত্রণে আমাদের সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর বা কর্তৃপক্ষ আদৌ কি প্রস্তুত?

সুতরাং আমাদের অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পথচারী, চালক, সড়ক পরিবহন সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবাইকে সবার দায়িত্বটুকু পালন করতে হবে। সবার সহযোগিতা ছাড়া আমাদের সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। সবকিছু রাতারাতি হয়ে যাবে, এমনটা ভাবা চরম বোকামি হবে। সময় লাগবে, সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্বশীল হতে হবে। তবেই আমাদের সড়ক হবে নিরাপদ।