কোনো এক রবীন্দ্রজয়ন্তীতে

লেখিকা
লেখিকা

ছোটবেলা থেকেই রবিঠাকুরের গানের ভীষণ ভক্ত শ্রাবণ। মনে আছে ছোটবেলায় প্রথম গান শিখেছিল ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায়...’। নিজেরা লুকোচুরি খেলতে গিয়ে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা খুঁজত সাথিদের সঙ্গে। বড় হয়েছে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের কলোনিতে। একটু বড় হতেই হয়ে গেল খুলনা বেতারের নিয়মিত শিল্পী। বাংলোর সামনে ঝিরিঝিরি বরষায় ভরাট কণ্ঠে শুনল, কে যেন গাইছে একদিন, ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে/ জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না...’। মনটা উদাস হয়ে বলে উঠেছিল, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়/ এমন ঘনঘোর বরিষায়...’।

স্কুল আর কলেজের দিনগুলো চলে গেল বসন্তের রাগে। শ্রাবণ জানল, ছেলেটার নাম নির্ঝর। সেও গান গায়। প্রায়ই বাসার সামনে সাইকেল চালিয়ে বা কলেজের সামনে গাড়ির পাশে একটা লাজুক মুখ দেখল। কী পড়ে, কোথায় থাকে, সব অজানা। শুধু ওর গানের গলাটা খুব চেনা হয়ে রইল। আর মায়াভরা দুটি চোখ।

কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে শ্রাবণ চলে এল ঢাকা মেডিকেল কলেজে। কত কত নতুন বন্ধু, কিন্তু কোথাও নেই সেই চেনা মুখ। এর মাঝে শ্রাবণের বাবা-মা বদলি হয়ে চলে এলেন ঢাকা। প্রচণ্ড কষ্টে মনে হলো কেন সে একবার কথা বলে দেখল না? গান গাওয়া ছেড়ে দিল। শুধু রিন রিন করে মনে বাজে—‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাই নি...’।

ডাক্তার হয়ে শ্রাবণকে চলে আসতে হলো আমেরিকায়। ওর বাবা-মা খুব চাইছিল শ্রাবণ যেন বিয়ে করে যায়। কিন্তু ও চলে এল। ছেলেদের সম্পর্কে সব আগ্রহ কেউ চুরি করে নিয়েছে, ছোট্ট জীবন ওকে খুঁজে কেটে যাবে। রেসিডেন্সি শেষ করে চাকরি নিয়ে চলে এল লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে। এদিকে প্রচুর বাংলাদেশি থাকে। অনেক অনুষ্ঠান হয়। এক রবীন্দ্রজয়ন্তীতে শ্যাটো রিক্রিয়েশন সেন্টারে গান শুনতে গেল। হঠাৎ মাইকে নিজের নাম শুনল শ্রাবণ। সেই হারিয়ে যাওয়া মাদকতায় ভরা ভরাট গলায় কেউ ডাকছে, শ্রাবণ চলে এসো। আজ গান গাইব তোমার সঙ্গে। শ্রাবণ ঘোরলাগা চোখে দেখল নির্ঝরকে। কীভাবে? কখন? শুনল, ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী, তুমি থাক সিন্ধুপারে...’। আর দুজনে মিলে গাইল ‘পুরানো সেই দিনের কথা...’। তারপর ওরা চলে গেল গ্রিফিত পার্কে।

শ্রাবণ জানতে চাইল, কেন হারিয়ে গেলে? কে তুমি? নির্ঝর বলল, বুয়েটে পড়ি তখন, খুব সাধারণ ঘরের ছেলে। কেমন করে আকাশের চাঁদকে চাই বলো? আমি তো চাইনি আমাদের জীবনটা অমিত আর লাবণ্যের ‘শেষের কবিতা’ হোক। ছায়ার মতো তোমাকে অনুসরণ করে এসে নিজেকে যোগ্য করেছি। হাত বাড়ালে ধরবে? শ্রাবণের মনে বেজে চলেছে—‘মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি’।

শ্রাবণ হাত ধরল। ওদের বিয়ে হলো পরের মাসেই। বিয়েতে বাজল ‘এসো এসো আমার ঘরে এসো’।

কয়েক বছর পরের রবীন্দ্রজয়ন্তী। ওদের ছোট্ট মেয়েটা গাইছে, ‘এ দিন আজি কোন ঘরে গো’ আর শ্রাবণের চোখে সুখের জল, ‘সখী ভালোবাসা কারে কয়’।