ঈদের জামা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

নতুন চাঁদ দেখার আগেই চারদিকে খুশির ঢাকঢোল বেজে উঠল। দুই বোন তনু আর বিনু খুশিতে আত্মহারা! তনু আগেই মাকে বলে রাখল, সে এবার রোজা রাখবে। সঙ্গে সঙ্গে বিনু তার বড় বোনকে বলল, ‘বুবু, আমিও কিন্তু রোজা রাখব।’ তনু বলল, ‘চল, আগে চাঁদ দেখে আসি! চাঁদ না দেখে রোজা রাখব কি করে?’ তনু আর বিনুর বাবা বললেন, ‘তাইতোরে! চাঁদ না দেখে রোজা রাখবে কী করে? তাড়াতাড়ি যাও। দেখ, চাঁদ উঠেছে কি না? আমি যাই, এই ফাঁকে একটু বাজার করে আসি।’

তনু আর বিনুর বাবা আনিসুর রহমান একজন স্কুলশিক্ষক। আর মা মোমেনা বেগম ঘরের কাজকর্ম নিয়েই ব্যস্ত। মফস্বল শহরের দুই কামরার একটি ছোট্ট ঘরে তাদের সুখের নীড়।

আনিসুর রহমান এক ছড়ি কলা হাতে বাড়ি ফিরলেন। মোমেনা বেগম আধা সের দুধ রাখলেন। আজ রাতে খেয়ে কাল থেকে রোজা। এক ছড়ি কলা আর আধা সের দুধেই দুই কামরার ছোট বাড়িখানা আনন্দ–খুশিতে ঝলমল হয়ে উঠল। বিনু বলল, ‘বাবা, আমি রোজা রাখতে চাই। মা শুধু বলে, আমার রোজা রাখার বয়স হয়নি! বাবা, তনু বুবু বলেছে, আমরা দুজনেই রোজা রাখব।’ বাবা বললেন, ‘আচ্ছা, তোরা দুই বোন এবার রোজা রাখিস, হলো তো? তনুর মা, তনু আর বিনু এবার রোজা রাখবে। ভালোই হলো, কাল থেকে বাড়ির সবাই রোজা। তনুর মা, দিনেরবেলা তোমার কাজ অনেকখানি কমে গেল!’

ভূগোলের শিক্ষক আনিসুর রহমান। স্কুলে শিক্ষকতা করে কতই বা বেতন পান তিনি। অনেকগুলো টাকা ঘর ভাড়া দিতেই খরচ হয়ে যায়। খুব কষ্টে সংসার চলে তাঁদের। মেয়ে দুটোর মুখে কোনো দিন ভালো কিছু তুলে দিতে পারেন না তাঁরা। ঈদ আসা মানেই বাড়তি দুশ্চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক করতে থাকে। মেয়ে দুটো এখন বড় হচ্ছে। আজকাল বিভিন্ন রকমের বায়না তাদের। দুই বোন রোজা রাখতে চায়। ভোর রাতে রোজকার মতো ভর্তা, ডাল ছাড়া তো আর কিছু জোটে না। আর ইফতারিতে কোনো দিন ছোলা আর বরা জোটে। আবার কোনো দিন পানি মুখে দিয়েই ভাত খাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। এই কারণেই মোমেনা বেগম মেয়েদের বললেন, ‘তোরা আর একটু বড় হয়ে তারপর রোজা রাখিস।’

মোমেনা বেগমের এত সব চিন্তা করতে করতে রাতের ঘুম হারাম হওয়ার জোগাড় হয়েছে। স্বামী যেটুকু টাকা মাইনে পান, তা দিয়ে ঘরভাড়ার পর বাকি টাকা সারা মাসের চাল, ডাল, নুন, তেল কিনেই শেষ হয়ে যায়। টানাপোড়েনের সংসার। তাই মোমেনা বেগম স্বামীকে বললেন, ছুটির দিন দুই–চারজন ছাত্র পড়ালেও তো পারেন।

আনিসুর বললেন, ছাত্র পড়াতে চাইলেই কী পড়ানো যায়? অঙ্ক অথবা ইংরেজির মাস্টার হলেও কথা ছিল! ভূগোল পড়তে কে আসবে তাঁর কাছে?

তবে তিনি তাঁর দুই মেয়েকে নিজেই পড়ান। মেয়েদের রেজাল্টও মাশা আল্লাহ অনেক ভালো। সেই জের ধরেই মোমেনা স্বামীকে বললেন, ‘আপনি ভূগোলের মাস্টার তাই কী হয়েছে? আপনি তো সব বিষয়েই কত পারদর্শী। আপনি যে কত উঁচুদরের মাস্টার তার প্রমাণ আপনার নিজের দুই মেয়ে দিয়েই।’

শোনো মোমেনা, ‘আমি যতই ভালো মাস্টার হই না কেন, আমার নামের ওপর সিল মারা। আমি হইলাম গিয়া ভূগোলের মাস্টার!’

: আপনি যাই বলেন, আপনার মতো এত ভালো মাস্টার কজন আছে এই এলাকায়? আপনার মেয়ে তনু আর বিনু সব বিষয়ে কত ভালো করছে। আর ওই দিকে দেখেন, ওই বাড়ির জহুর ভাইয়ের ছেলেমেয়েকে? দুই তিনজন মাস্টার বাড়ির ওপর এসে পড়িয়ে যায়। অথচ আপনার মেয়েদের মতো তো এত ভালো করছে না তারা!

: মোমেনা, আজকে কয়টা রোজা হলো, দশটা না?

: না, আজকে নয়টা, কালকে দশটা হবে। আপনি কি কিছু চিন্তা করছেন?

: না, সে রকম কিছুই না। মেয়েদের চোখের সামনে সবাই নতুন জামাকাপড় পরে ঘুরে বেড়াবে। জামা তো দূরের কথা, আমরা ওদের ভালোমন্দ একবেলা খাওয়াতেও পারি না! লম্বা শ্বাস ফেলে আনিসুর বললেন, কেমন বাবা আমি?

স্বামীর কথায় সায় দিয়ে মোমেনা বললেন, ‘আমার এক হাঁড়ি মুষ্টি চাল জমেছে!’

সারা বছর মোমেনা বেগম ভাত রান্নার সময় সেখান থেকে এক মুঠি চাল সরিয়ে রাখতেন। এই করে তাঁর বড় এক হাঁড়ি চাল জমেছে। কুড়ি কেজির ওপর তো হবেই।

মোমেনা স্বামীকে বললেন, ‘আপনি মাসের চাল থেকে এই পরিমাণ চাল কম কিনে টাকাটা আমার হাতে দিয়েন। আমি ওই পাশের বাড়ির করিমের সঙ্গে কথা বলে রেখেছি। ওকে বলেছি, দুটো জামার কাপড় এনে দিতে। আর আমি নিজেই তা সেলাই করে দিতে পারব। একসময় আমি খুব ভালো সেলাই করতাম। ভাবছি ঘরে বসে টুকিটাকি কাজ শুরু করলে কেমন হয়!’

স্ত্রীর কথায় মাথা থেকে পাহাড় সমান বোঝা নেমে গেল আনিসুরের। তা হলে মেয়েদের দুটো জামা হচ্ছে। মোমেনা হলো গিয়ে ঘরের লক্ষ্মী! বউকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চান না​ আনিসুর। ভাগ্যগুণে মোমেনার মতো বউ পেয়েছিলেন তিনি। মোমেনা তাঁর বাপের বাড়ি থাকতে অনেক সেলাই করত। আনিসুরের খুব ইচ্ছা মোমেনাকে একটি সেলাই মেশিন কিনে দেওয়া। কিন্তু অভাবের সংসারে সেই ইচ্ছা শুধু ইচ্ছাই রয়ে গেছে। আনিসুর মনে মনে ভাবছেন, মোমেনা যতই রাগ করুক প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে অল্প কিছু টাকা তুলে মোমেনাকে একটি সেলাই মেশিন কিনে দেবেন তিনি। মেয়েদের বিয়ের কথা ভেবে মোমেনার কড়া নির্দেশ, ওই টাকাতে যেন হাত না দেওয়া হয়।

অন্যদিকে পাশের বাড়ির আনিকা আর মনিকা ঈদের খুশিতে মেতে উঠেছে। ওদের বাবা জহুর সাহেব কী কাজ করেন, সেটা কারও জানা নেই। তবে শোনা যায়, তিনি নাকি অনেক বড় কন্ট্রাক্টর। সময়-সময় তাদের দেখা যায় আধমরা ভাব। আবার হঠাৎ করে ফুলে–ফেঁপে কলাগাছ! মোমেনা বেগম মনে মনে খুব বিরক্ত। এদের পাশে আর থাকা যাবে না। এদের বাড়াবাড়ি দেখলে মেজাজটা খুব খারাপ হয় তার। তারা কী বাজার করল, ঈদ উপলক্ষে ছেলেমেয়ের জন্য কী কিনবে, সবকিছু আমাদের বাড়িতে এসে না ঢাললে মন ভরে না রানু বেগমের। আরে বাবা! যা ফুর্তি করার নিজের বাড়িতে বসে করো, তাতে তো কেউ মানা করেনি। কাঁচা পয়সা হলে মানুষের যা হয়! এই দেখা যায় সময়-সময় বাড়িভাড়া দিতে হিমশিম খায়, আবার দেখা যায় বাজারঘাটে উপচে পড়ছে। এদের ঘটনা বোঝা বড় দায়! মোমেনা বেগম আজই তাঁর স্বামীকে বলবেন, বাড়ি বদলাতে। মেয়ে দুটো ছোট, এসব দেখে ওদের ছোট মনটা ভেঙে যায়। ওদের মুখের দিকে তাকাতে পারেন না তিনি। তেমনি বেচারা স্বামীর মুখখানা চোখের সামনে ভাসতে থাকে মোমেনা বেগমের। তিনি মনে মনে ভাবেন, বাড়ি বদলাতে হবে তাঁদের। আবার পরক্ষণেই ভাবেন, বাড়ি বদলাতে চাইলেই কি বদলান যায়? এত কম ভাড়ায় বাড়ি তাঁরা আর কোথায় খুঁজে পাবেন? তবে জহুর সাহেব আনিসুরকে বলেছেন, তাঁরা নাকি খুব তাড়াতাড়ি একখানা ফ্ল্যাট কিনবেন। তাই মোমেনা বেগম আল্লাহ আল্লাহ করছেন, এরা জানি খুব তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যায়। অন্তত মেয়ে দুইটা চোখের সামনে এত সব দেখে মনে কষ্ট পাবে না।

কেন যে বারবার ঘুরেফিরে ঈদ আসে। চিন্তা করতেই মোমেনা বেগমের মনটা ব্যথায় ভরে ওঠে। চারদিকে তার মেয়েদের চেয়েও আরও কত গরিব ছেলেমেয়ে রয়েছে। তবে নিম্নমধ্যবিত্তদের কষ্ট অনেকটা বিষ খেয়ে বিষ হজম করার মতো। তারা না পারে ভিক্ষা করতে, আবার না পারে আত্মীয়–পরিজনদের কাছে হাত পাততে। কী কষ্টসাধ্য জীবনযাপন তাদের! এত কষ্টের মধ্যেও মোমেনা পাশের বস্তির রহিমার ব্লাউজ নিজের হাতে সেলাই করে দেন। তা–ও আবার বিনা পয়সায়। বস্তির রহিমা মেয়েটা মোমেনাকে খুব শ্রদ্ধা করে। রহিমা তাকে সব সময় বলে, খালা আপনি ক্যান বিনা পয়সায় সেলাই করবেন। আমাগো থিক্যা অল্প কিছু পয়সা নিয়া কাম করেন। আমি আপনারে মেলা কাম আইনা দিমু। দরজির কাছে গেলে ছুইলা পয়সা নেয়। রহিমার কথা শুনে মোমেনার খুব ভালো লাগল।

মোমেনা রহিমাকে বললেন, দাঁড়া, একটা সেলাই মেশিন কিনে নিই। তারপর দেখা যাবে! তবে ঈদের সময় আমি গরিবদের কাছে থেকে কোনো দিন পয়সা নিয়ে সেলাই করব না।

: খালা, আপনের মনডা কত ভালা! খালা, কত বড়লোকের বাড়ি কাম করি। তয়, আপনের মতন মানুষ আমি খুব কম দেখছি!

দেখতে দেখতে হরহর করে অনেক রোজা পার হয়ে গেল। পাশের বাড়ির আনিকা আর মনিকার নতুন ঈদের জামা চলে এল। তা দেখে বিনু তনুকে বলল, ‘বুবু, আনিকা, মনিকার নতুন জামা দেখলাম। কী সুন্দর!’ ছোট বোনের কথায় তনুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে ছোট বোন বিনুকে বলল, ‘আমার জামার দরকার নাই। মাকে বলব তোকে যেন একটা নতুন জামা বানিয়ে দেন।’ এর মধ্যে মায়ের ডাক ভেসে এল।

: তনু, বিনু, এদিকে আয় মা। দেখ, তোদের জন্য কী এনেছি? দেখত পছন্দ হয় কিনা? সাদার ওপর রংবেরঙের ফুলে ভরা জামার কাপড়। তনু আর বিনু জামার কাপড় বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরল। মনে হলো দুই বোন আকাশের চাঁদ হাতে পেল। মোমেনা জামা সেলাই করছেন আর মেয়েরা গোল করে বসে দুই চোখ ভরে দেখছে। এমন সময় আনিসুর বাড়ি ফিরলেন। তাঁর হাতে ছোট বড় দুটি প্যাকেট। স্বামীর হাতে এত বড় প্যাকেট দেখে দুই মেয়ে আর মোমেনা বেগমের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। মোমেনা দৌড়ে এসে স্বামীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওমা, তোমার হাতে এটা কী? তুমি টাকা পেলে কোথায়?’

আনিসুর বউকে বললেন, ‘আমি তোমাকে কোনো দিন কোনো কিছু কিনে দিতে পারিনি। আমার খুব ইচ্ছা ছিল, তোমাকে একটি সেলাই মেশিন কিনে দিই। আর তনু বিনুর জন্য এই সামান্য একটু মিষ্টি। মোমেনা, তুমি এই নিয়ে আমাকে কোনো প্রশ্ন করবে না। সব সময় মনে রাখবে, তোমার স্বামী এমন কোনো কাজ করবে না, যাতে করে তুমি এবং আমাদের মেয়েরা মানুষের কাছে ছোট হয়ে যায়।’

মোমেনার বুঝতে বাকি রইল না তাঁর স্বামী প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে কিছু টাকা তুলেছেন। তাঁর অনেক দিনের স্বপ্ন পূরণ করতেই তাঁর স্বামীর এই সেলাই মেশিন কেনা। মোমেনা দুই চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না। সুখ, আনন্দ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা তাঁর নিজের ধারায় আপনি আপনিই বেড়িয়ে আসে। শত চেষ্টা করেও তাকে আটকে রাখা যায় না! চোখের এই পানিটুকু তারই প্রমাণ। তনু আর বিনুর নতুন জামা সেলাইয়ের মধ্যে দিয়ে মোমেনার যাত্রা শুরু হলো। রহিমা মোমেনাকে অনেক কাজ এনে দিতে লাগল। রহিমা মানুষের বাড়ির ছুটা কাজ ছেড়ে দিল। তার কাজ এখন শুধু অর্ডার আনা আর সেলাই হয়ে গেলে কাপড়গুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া।

তনু আর বিনু মায়ের হাতের বানানো জামা পরে ভাঙা আয়নায় নিজেদের বারবার দেখতে লাগল। মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘মা, দেখ, কী সুন্দর লাগছে!’ মেয়ে দুটোকে জামা না দিতে পারার কথা চিন্তা করতেই মোমেনার বুকটা কেঁপে উঠল। ভাগ্যিস, মুষ্টি চাল মানে সারা বছর এক মুঠো করে চাল জমিয়েছিল। মেয়ে দুটো জামা পরে চোখের সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তাই দেখে মোমেনার চোখের কোনাটা আবার পানিতে ভিজে এল।
...

ডিনা চৌধুরী : মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া।