আমার আম্মি আমার আইডল

মায়ের সঙ্গে লেখিকা
মায়ের সঙ্গে লেখিকা

কিশোরী বয়সে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের সময়ের ছোট্ট চুড়িগুলো দেখলেই তা বোঝা যায়। অতটুকু বয়সে স্কুলে স্কিপিং প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে লাল পাউডার কেস পেয়েছিলেন। ডিবেট করে জিতেছেন। স্কুলে নাচ দেখে শিখে নিয়েছিলেন নাচ। রক্ষণশীল পরিবার হওয়ায় আমরা তিন ভাইবোন ছাড়া সে নাচ আর কেউ দেখেনি কখনো।

এসএসসি পরীক্ষার পরপর বিয়ে আর তারপর আমার বোনের জন্ম। বিএসসি পর্যন্ত সায়েন্স পড়ে তিন বাচ্চাসহ এমএ করেছিলেন পলিটিক্যাল সায়েন্স নিয়ে। কারণ, আমাদের তিনজনকে রেখে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস ইত্যাদি করা সম্ভব ছিল না। ছোটবেলায় অঙ্কগুলো মুখে মুখে করে ফেলতেন তিনি। ইন্টারমিডিয়েটে কেমিস্ট্রির সব ফর্মুলা যিনি আবিষ্কার করেছিলেন, তাঁকে কাঁচা খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করত, তখন মুখে মুখে বলে দিতেন সব। এত রসকষহীন সাবজেক্ট যে কারও প্রিয় হতে পারে না দেখলে বিশ্বাস হতো না।

অতি ছোট বয়সে তাঁর প্লেটো অ্যারিস্টটল পড়া বা কলেজে গিয়ে টেবিলের ওপর বসে থাকার স্মৃতি আবছাভাবে মনে আছে। তারপর বছর কয়েক আগে আমেরিকার সিটিজেনশিপের মৌখিক পরীক্ষার জন্য যখন পড়তে বসেছি, তখন আমেরিকার কনস্টিটিউশন এত সহজ করে বলে দিলেন যেন ওটা কোনো ব্যাপারই না।

আমাদের বাসার প্রতিটা বেডকভার বা টেবিল ক্লথ সব নিজের হাতে কাজ করা। সুতার কাজ, কুরুশ কত–কী। ছোটবেলায় সব জামা বা সোয়েটার ছিল তাঁর বানানো। শীতকালে ময়ূরপুচ্ছ ফ্রক পরে দৌড়ে বেড়াচ্ছি এখনো মনে আছে। নিজে কাজ চালানোর মতো কিছু সেলাই জানি শুধু। একজনের বিয়েতে উপহার হিসেবে আম্মি নিজের হাতে কাজ করা বেডকভার সেট উপহার দিয়েছিলেন। তাঁর দেওয়া বেডকভার সেট এখনো তিনি রেখে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন আম্মিকে।

সেই ছোটবেলায় খেলার মাঠ দখল করা নিয়ে ছোট্ট রুশোর সঙ্গে মারামারি করেছিলাম। হাঁটতে বের হওয়া চাচি খুব অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘দেখেন ভাবি, ছেলে আর মেয়ে মারামারি করছে।’ আমার মার জবাব ছিল, ‘কেন ভাবি মেয়ে বলে কি মার খাবে শুধু?’ তখন মনে মনে ধারণা হয়েছিল, কেন পারব না যা চাই তা অর্জন করতে? আসলে বিকেল হলেই খেলতে চলে যেতাম আমরা। ভৈরব নদী পুরোটা বেড়া দিয়ে আলাদা করা। নদীর এদিকে ফুলের বাগান আর বিশাল মাঠ। মাঠে বড় ছেলেরা ফুটবল খেলে। ক্লাব আছে আর পুল টেবিল আছে যাতে শুধু বাবারা খেলবে। লন টেনিস কোর্টে বড় ছেলেরা খেলবে। সুতরাং সবেধন নীলমণি এই মাঠ যেখানে আমাদের বয়সী ছেলেরা গরমকালে সময় দেবে ৪-৬টা আর শীতকালে সময় ৬-৭, যার কোনোটাই খেলার উপযুক্ত সময় না। তবে ওই মারামারির পর এক ঘণ্টা করে দুই পক্ষই খেলতে পারতাম। ঝগড়ার কারণটা আম্মি জানতেন।

তখন কখনোই বুঝিনি সপ্তাহে একদিন মাত্র ছুটি তাঁর। এর মাঝে সুইমিং করতে গিয়ে একবার পানিতে নামতে পারলে ঘণ্টা দুই নষ্ট করে আসতাম। শাড়ি পরে তিনি তো আর কান ধরে টেনে তুলতে পারবেন না। অথচ ঘরে রাজ্যের কাজ পড়ে আছে। বাকি সব দিনগুলো সুইমিং পুলের গেট বন্ধ থাকত। কলোনিতে সবাই নিজ পরিবারের মতোই থাকতেন। সুতরাং সাইকেল চালানো, খেলা সবকিছুতেই সবাই সবাইকে দেখে রাখতেন। একবার কিছু বড় ভাইয়ের পাল্লায় পড়ে কী এক অনুষ্ঠানের জন্য চাঁদা তুলতে সাথি হয়ে গিয়েছিলাম। চাচির কাছ থেকে শুনে হতভম্ব চেহারা করে শুধু বলেছিলেন, ‘কোথাও যাওয়ার আগে বলে যেও কেমন?’ কোনো বকাঝকা না, একটা কথাতেই আমার চাঁদাবাজ জীবনের ইতি।

গানের প্রতি ছিল তাঁর একটা অসম্ভব ভালোবাসা। আমাকে গান ভালোবাসতে শিখিয়েছেন সেই ছোট্টবেলায়। ‘ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে’ শুনে কত দিন ঘুম ভেঙেছে। তারপর ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি’, ‘বনের তাপস কুমারী আমি গো’, ‘স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’। আমি স্কুল আর কলেজজীবনে হামদ নাত, কবিতা আবৃতি, ডিবেট, গান, কৌতুক, ব্লু বার্ড, গার্লস গাইড আর কম্পিটিটিভ স্পোর্টস করেছি। সবকিছুতেই তাঁর প্রচ্ছন্ন সায় ছিল।

আমাদের যিনি কোরআন শরিফ শেখাতেন, তিনি ছিলেন কারি সাহেব। কথাটা জানামাত্র আবদার করে বসলাম আমাকেও শেখাতে হবে। এক্সট্রা ১০ মিনিট সুন্দর সুর করে পড়াতে হয়েছিল দেখে হুজুরের বিরক্ত মুখ এখনো মনে আছে। আম্মি আব্বুকে বলে দিয়েছিলেন যেন আমার এই ছোট শখ অবশ্যই পূর্ণ করা হয়। তাঁর দান করা শুধু না, আমাদের দান করানোর কৌশলগুলো এত বেশি সুন্দর। সব সময় বলেন, ‘দান করলে ভালো থাকবে তোমরা।’ এতিমখানা, বৃদ্ধাবাস, হাসপাতাল, অভাবী মানুষের লিস্ট করে সারা বছর নিজে সাহায্য দেন আর আমাদের উৎসাহিত করেন। বলেন অতি সামান্য দানে অন্য মানুষের যৎসামান্য উপকার হয় আর আমাদের হয় পাহাড় সমান উপকার। নিয়মিত নামাজ তিনি ভালোবেসে পড়তে শিখিয়েছেন, ভয় দেখিয়ে না। তাই ভালোবাসাটা আজীবন রয়ে গেছে।

ছোট্টবেলা থেকে বই পড়া নেশা আমার। মানে অক্ষরজ্ঞান হওয়ামাত্র থেকে পাঠকজীবনের শুরু। খুলনায় বইয়ের দোকানে মই বেয়ে উঠে বই নিয়ে আসতাম। বালিশের সঙ্গে আড়ি, মালাকাইটের ঝাঁপি থেকে শুরু করে হ‌ুমায়ূন আহমেদের তোমাদের জন্য ভালোবাসা। একটু বড় হয়ে আম্মির কলেজে প্রায়ই যেতাম বই পড়তে আর বই আনতে। ক্লাসের ফাঁকে আম্মি দেখে যেতেন। ইন্টারনেটের আগের যুগ সেটা। ডিবেটের পয়েন্ট আম্মি আর আমি কত খুঁজে লিখে নিয়েছি। এখন যেকোনো বই বা পত্রিকা ভালো লাগলে আম্মি দুটি কিনে রাখেন। তিনি নিজেও যে পড়ার পোকা। জগন্নাথ কলেজে আম্মি চলে আসার পর আমি তখন মেডিকেল কলেজ আর পরে আমেরিকার পথে চলে এসেছি। ওই কলেজের লাইব্রেরি কেমন খুব জানতে ইচ্ছে করে। ছাত্রদের পাগলামি দেখে বহুদিন আম্মির ক্লাস করতে ইচ্ছে করেছে। কেন যেন রোকেয়া ম্যাডামের ক্লাস আমার করা হয়ে ওঠেনি।

রান্না নিয়ে আমার খুব হাস্যকর ধারণা ছিল বহু দিন। আম্মি এত ভালো রান্না করেন। কিছু পিঠা, মিষ্টি বা রান্না যে দোকানে পাওয়া যেতে পারে বহু বছর সেটা আমার ধারণার বাইরে ছিল। আচার প্রতিযোগিতায় বহু বছর তিনি বিবি রাসেলের কাছ থেকে প্রাইজ এনেছেন জানি। এখন দেশ থেকে আচার নিয়ে আসি। শুধু আমার ছেলের সঙ্গে শেয়ার করি। বছর দুই যেতে হবে তো রিফিল আনতে। জোড়াতালি দেওয়া যে রান্না করি তাতেও প্রায়ই জেনে নিতে হয়, চপ ভেঙে যাচ্ছে কেন?

আম্মির লেখা অনেক গল্প ছাপা হয়েছে বহু পত্রিকায়। তাঁর উৎসাহে বহু বছর পর লেখালেখির জগতে ফিরেছি আমি। আম্মি আমার লেখা খুব আগ্রহ নিয়ে পড়েন। আব্বুও। মা দিবসের আগে পরে কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম। তাই আজকে লিখেই ফেললাম আম্মি। কোনো দিন কঠিন সময়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেলেও যুদ্ধ করে আবার দাঁড়াতে শিখিয়েছেন আপনি। সবার মামণিরা তো এমনই। দোয়া করি সবার মা হাজার বছর এমন ছায়া দিতে বেঁচে থাকুন। আমাদের পথ দেখান।